আব্বার আল্ট্রাসনোগ্রাম রিপোর্ট দেখেই বুকটা মোচড় দিয়ে উঠেছিল, কারণ চিকিৎসককে দেখানোর আগেই আমি বুঝে গিয়েছিলাম আব্বার মরণব্যাধী ক্যানসার হয়েছে এবং আমি অচিরেই আমার প্রাণাধিক প্রিয় বাবাকে হারাতে যাচ্ছি। অবশ্য আমি হাল ছেঁড়ে দেইনি। বারডেম, বিএসএমইউ, পপুলার ইত্যাদি হাসপাতালে দৌড়াদৌড়ি করেছি, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী যাবতীয় পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছি। নিয়মিত ওষুধ সেবন করিয়েছি। কিন্তু আব্বাকে বাঁচাতে পারিনি। কারণ মৃত্যু এমন এক নির্মম সত্য ও অনিবার্য বাস্তবতা, যা ঠেকানোর কোনো উপায় অদ্যাবধি আবিষ্কার হয়নি। অথচ মৃত্যু মিথ্যা হওয়ারই দরকার ছিল।
আব্বার ক্যানসার ধরা পড়ার ১৪ দিনের মাথায় তিনি ইন্তেকাল করেন। এই ১৪ দিন আমি তাকে মিথ্যা আশ্বাস বা সান্ত্বনা দিয়েছি যে তার তেমন কিছু হয়নি। চিকিৎসার ফলে কিছুদিনের মধ্যে তিনি ঠিক হয়ে যাবেন। আব্বা কিন্তু ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন, তার সময় ফুরিয়ে এসেছে। কিন্তু তিনিও আমাকে মিথ্যা আশ্বাস বা সান্ত্বনা দিতেন, যেন আমি ভেঙে না পড়ি।
২
আব্বা মারা যাওয়ার আগে মাঠা খেতে চেয়েছিলেন। আমি ভালো মাঠা না পেয়ে আব্বার জন্য লাবান এনেছিলাম। আব্বা লাবান পান করে বলেছিলেন, মজা! খুব মজা! আব্বা মাছ ভাজাও খেতে চেয়েছিলেন। আমি বলেছিলাম, আমি আপনাকে তাজা রুই মাছ ভাজা খাওয়াবো। আব্বা যেদিন মারা যান সেদিন সকালেই আব্বাকে রুই মাছ ভাজা খাইয়েছিলাম।
৩
মারা যাওয়ার আগে মাহে রমজানে ইফতারে আলুর চপ খেয়ে আব্বার পেটব্যথা হয়েছিল। তখন ডাক্তার যদি গ্যাস আর পেটব্যথা কমানোর ইনজেকশন না দিয়ে কারণ নির্ণয়ে আল্ট্রাসনোগ্রাম টেস্ট দিতেন, তবে হয়তো আব্বার গল ব্লাডার ক্যানসার প্রাথমিক অবস্থায় ধরা পরতো এবং অপারেশন করা যেত। এভাবে হয়তো আব্বা বেঁচেও যেতেন। আব্বার যখন ক্যানসার ধরা পড়ে, তখন পরামর্শের জন্য আমি প্রফেসর ডা. কামরুজ্জামান খানের নিকট যাই। তিনি আল্ট্রাসনোগ্রাম রিপোর্ট দেখে বললেন, এত দেরিতে কেন টেস্ট করেছেন। ইটস টু লেট। বাবাকে মনে পড়ে আমার বাবাকে মনে পড়ে। বাবা কতদিন, কতদিন দেখি না তোমায়। কেউ বলে না, মানিক কোথায় আমার ওরে বুকে আয়।
৪
আমার বাবা আমাকে তার প্রাণের চেয়ে বেশি ভালবাসতেন। কোনোদিন দিন আমাকে বকা দেননি, মারা দূর কি বাত। আমাকে ছোটবেলা থেকেই পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছেন। স্কুল জীবন থেকেই আমার পাঠ্যবইয়ের বাইরে বিচিত্র বই পড়ার অভ্যাস। একাধিক পাঠাগার থেকে আমি বই এনে পড়তাম। বাবা কখনো বই পড়তে নিষেধ করেননি বরং উৎসাহ দিয়েছেন। আমার লেখালেখি বাবা খুব পছন্দ করতেন। পত্রিকায় আমার লেখা প্রকাশিত হলে বাবা মনোযোগ দিয়ে আমার লেখা পড়তেন। আমার লেখক ও সাংবাদিক হিসেবে গড়ে ওঠার নেপথ্যে বাবার অবদান অপরিসীম ।
৫
আমার বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. রহমতুল্লাহ ১৯৬২ এর শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬-এর ৬ দফা আন্দোলন, ১৯৬৯-এর স্বৈরাচার জেনারেল আইয়ুব খান বিরোধী গণআন্দোলনে জেল খেটেছেন। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে ১১ নম্বর সেক্টরের কোম্পানি কমান্ডার হিসেবে একাধিক গেরিলা ও সম্মুখ যুদ্ধ পরিচালনাকারী ও এসব যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। তিনি বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক ছিলেন। তিনি বীর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। কিন্তু সেই পরিচয় পুঁজি করে জীবনে কোনোদিন কোনো বেনিফিট নেননি। শেরপুরের কিংবদন্তি মুক্তিযোদ্ধা হয়েও কেন জীবনে কোনো বৈষয়িক লাভের ভাগীদার হননি, সেজন্য তিনি জীবিতকালে আত্মীয় স্বজন ও বন্ধুবান্ধবের গালি খেয়েছেন। মারা যাবার পরও গালি খেয়ে যাচ্ছেন ।
বাবাকে মনে পড়ে আমার, বাবাকে মনে পড়ে। বাবাকে মনে পড়ে শুধু বাবা-দিবসে নয়; প্রতি মুহূর্তে। শত সহস্র বাবা-দিবস এলেও বাবার স্মরণ ফুরাবে না।