বারো মাসের তেরো পার্বণের দেশ বাংলাদেশ। এই তেরো পার্বণ উদযাপিত হতো ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে। এসব উৎসবের মধ্যে ছিল হরেক রকমের রসনাবিলাস। ভোজনরসিক বাঙালির পাতে নিজস্ব ঐতিহ্যের খাবার। বৈচিত্র্যের অভাব ছিল না কোনো কালেই। ঋতু আর উৎসবভেদে সেই খাবারে থাকত ভিন্নতা। তেমনই শীতের শুরু মানেই ছিল গ্রাম কিংবা শহুরে সব জায়গাতেই ম ম করে ওঠা পিঠার স্বাদ আর ঘ্রাণ। হেমন্তের পাকা ধান কৃষক ঘরে তুলত। অমনি ধুম পড়ে যেত পিঠা বানানোর। খেজুরের রস, গুড়, চালের গুড়ার মিশ্রণের ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়ত বাড়িজুড়ে।
গ্রামবাংলার পিঠা বানানোর আয়োজন ছিল শীতকালীন উৎসবের একটি অংশ। উৎসবমুখর পরিবেশে তৈরি হতো পিঠা। গ্রামবাংলায় পৌষ মাসে নতুন চালের গুঁড়ায় পিঠা তৈরি হয় বলে, এই উৎসবের নামকরণ করা হয় ‘পৌষ পার্বণ’। ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের কবিতা ‘পৌষ পার্বণে’ এই উৎসবের যে বর্ণনা পাই তা শুনলেই খিদে পেয়ে যায়।
‘আলু তিল গুড় ক্ষীর নারিকেল আর।
গড়িতেছে পিঠেপুলি অশেষ প্রকার।
বাড়ি বাড়ি নিমন্ত্রণ, কুটুম্বের মেলা।
হায় হায় দেশাচার, ধন্য তোর খেলা।’
সময়ের পরিক্রমায় অনেক পুরাতন অভ্যাসের পরিবর্তন ঘটেছে। বর্তমান নাগরিক জীবনে এখন আর সেই উৎসব আমেজ নেই। কৃষকের ঘরে হেমন্তের পাকা ধান ওঠে। কিন্তু হয় না সেই পিঠার আয়োজন। পাড়ায় পাড়ায় খুঁজেও পাওয়া যাবে না গাছিদের। খেজুরের রসের হাঁড়ির সন্ধানও পাওয়া এখন দুষ্কর। এভাবেই অবহেলায় হারিয়ে যাচ্ছে বাঙালির নিজস্ব সংস্কৃতি পিঠা উৎসব।
যেসব বাহারি স্বাদের পিঠা ছাড়া গ্রামবাংলার মানুষ বিয়ে, উৎসবের কথা চিন্তা করত না, এখন সেখানে জায়গা করে নিচ্ছে বিদেশি খাবার। অথচ বাঙালি কত শত রকমের পিঠা যে তৈরি করত, তা তালিকায়ন করা আজও সম্ভব হয়নি। ধারণা করা হয়, এ দেশে শতাধিক রকমের পিঠা তৈরি হতো। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য পিঠাগুলো হলো চিতোই পিঠা, পাকানো পিঠা, পাকোয়ান পিঠা, পক্কন পিঠা, পাটিসাপটা, কুশলি পিঠা, ভাপা পিঠা, ভাত পিঠা, কাটা পিঠা, নকশি পিঠা, পুলি পিঠা, দুধ পিঠা, লাউ পায়েস, ছিট পিঠা, লবঙ্গ পিঠা, গোকুল পিঠা, গড়গড়া পিঠা, ম্যারা পিঠা, মুঠা পিঠা, সিদ্ধ পিঠা, পুতুল পিঠা, লরি পিঠা, চাছি পিঠা, সাগুদানা, ঝুড়িসীতা, তারাজোড়া, জামাই পিঠা, জামদানি পিঠা, হাদি পিঠা, পাটা পিঠা, তেজপাতা পিঠা, তেলেভাজা পিঠা, ঝুরি পিঠা, ফুলঝুরি পিঠা, বিবিয়ানা পিঠা, চষি পিঠা, খান্দেশা, গোলাপফুল পিঠা, পাতা পিঠা, সবুজ পিঠা, কেক পিঠা, গুলগুলা, ফুলকুচি, সেওই পিঠা, লবঙ্গ পিঠা, ক্ষীরডুবি, খাস্তা পিঠা, পেঁপের সন্দেশ, কড়ি পিঠা, সি রিনচ পিঠা, ঝিকমিক পিঠা, পয়সা পিঠা, সংসার পিঠা, শিঙাড়া পিঠা, বিবিখানা পিঠা, চান্দ পাকোড়া, ঝালপোয়া পিঠা, মালপোয়া পিঠা, মালভোগ, ক্ষীরকুলি, মালাই পিঠা, নারকেল ভাজা পুলি, নারকেল সিদ্ধ পুলি, নারকেল ঝুরি পিঠা, পাকোন পিঠা, সাজ পিঠা, তেলপোয়া পিঠা, ঝাল পিঠা, বিস্কুট পিঠা, খাস্তা পিঠা, গজা, রুটি পিঠা, দুধ পায়েস, কুলি পিঠা, দুধকুলি পিঠা, জামাই কুলি পিঠা, জামদানি পিঠা, হাঁড়ি পিঠা, চাপড়ি পিঠা, চুটকি পিঠা, রসপুলি, কাটা পিঠা, মুরালি পিঠা, খান্দাশ, পয়সা পিঠা, চুষি পিঠা ইত্যাদি অন্যতম।
অঞ্চল্ভেদে এর নাম ও উপকরণের ভিন্নতাও ছিল। স্বাদে আহ্লাদে একসময়ে খাওয়া এই পিঠার নাম এখন কেবলই পুঁথিবদ্ধ হয়েই আছে। হাতে গোনা কিছু পিঠা থাকলেও এর সিংহভাগই সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে যাচ্ছে। হারিয়ে যাওয়া বাঙালির ঐতিহ্যের এসব পিঠা নিয়ে থাকছে বিশেষ আয়োজন।
গোকুল পিঠা
গোকুল পিঠা এখন অনেকের কাছেই অপরিচিত। মধ্য যুগ থেকে এই দেশে নানান অঞ্চলে বেশ প্রচলিত একটি পিঠা। চালের গুড়া, খেজুরের গুড়, নারিকেলে কোরা দিয়ে বানানো পুর দিয়ে তৈরি হতো। এই পিঠার অন্যতম উপকরণ ছিল এলাচ। পুরের সঙ্গে এলাচের মিশ্রণটি খুব ভালোভাবে মিশিয়ে দেওয়া হতো। চালের গুঁড়ার ডো বানিয়ে এর মধ্যে পুরটি ভরে নেওয়া হতো। এরপর তেলে ভেজে রসে অথবা দুধে সারা রাত ভিজিয়ে রেখে বানিয়ে নেওয়া হতো গোকুল পিঠা।
সেমাই পিঠা বা হাত সেমাই পিঠা
উৎসবের আরেকটি পিঠা হলো কাটা সেমাই পিঠা বা হাত সেমাই পিঠা। দুই কাপ চালের গুঁড়ার সঙ্গে ১/৪ কাপ ময়দার মিশ্রণে মণ্ড তৈরি করা হতো। এরপর ভাগ করে নিয়ে হাতের তালুর সাহায্যে লম্বা সরু লতার মতো করে বেলে নিতে হয়। এরপর এক হাতে ধরে অন্য হাতের তালু দিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেড় থেকে দুই ইঞ্চি অন্তর কাটা হয়। কোনো কোনো অঞ্চলে আবার শুধু চালের গুঁড়ার মন্ড দিয়েই পিঠাটি তৈরি হয়। এই পিঠা কাটার কৌশল সবাই রপ্ত করতে পারে না। বাড়ির বয়োজ্যেষ্ঠ নারীরাই সেমাই পিঠা তৈরিতে বেশি পারদর্শী। সেমাই বানানো পর এই পিঠা খেজুরের গুড়, দুধ ও নারিকেল দিয়ে রান্না করা হয়। আবার অনেকে কড়া রোদে শুকিয়ে সেমাই পিঠা বয়ামে তুলেও সংরক্ষণ করতেন।
চন্দ্রপুলি পিঠা
চন্দ্রপুলি আবহমান গ্রামবাংলার একটি ঐতিহ্যবাহী পিঠা। শুধু গ্রামেই নয়, শহরেও প্রায় সবাই এই পিঠা বানিয়ে থাকে। বাংলাদেশের মতো ভারতেও এ পিঠা খুবই জনপ্রিয়। শুকনা কিংবা দুধ বা রসে ভেজানো সব ভাবেই এ পিঠা খেতে ভালো লাগে। চালের গুঁড়ায় তৈরি পিঠার কাইয়ের ভেতরে নারকেল, দুধ ও চিনি বা গুঁড়ের মিশ্রণের পুর থাকে। দেখতে অর্ধচন্দ্রাকৃতি এই পিঠা বানাতে বেশ সময় সাপেক্ষ। ফলে জনপ্রিয়তা থাকলেও এই পিঠা অনেকটাই এখন অবহেলিত।
ক্ষীর মোহন পিঠা
দুধ, ছানা, চিনির সংমিশ্রণে তৈরি হওয়া এই পিঠাটি খেতে দারুণ মিষ্টি। সাধারণত বিয়ে, জন্মদিনের মতো উৎসবে অতিথি অ্যাাপায়নে এই পিঠার বেশ কদর ছিল।
গোলাপ পিঠা
গোলাপ ফুলের মতো দেখতে হওয়ায় এই পিঠার নাম ছিল গোলাপ পিঠা। চালের গুড়া দিয়ে রুটি বানিয়ে কেটে কেটে তৈরি করা হতো এটি। বানিয়ে তেলে ভেজে নিতে হতো প্রথমে। এরপর চিনির সিরা তৈরি করে পিঠাটিকে কিছুক্ষণ চুবিয়ে পরিবেশন করা হতো।
ম্যারা পিঠা
ম্যারা পিঠা আর চেপা শুঁটকির ভর্তা বৃহত্তর ময়মনসিংহের খুবই জনপ্রিয় খাবার। প্রায়ই এই অঞ্চলের মানুষগুলোর শীতের সকাল হয় গোশতের ঝোলের সঙ্গে কুড়মুড়ে ম্যারা পিঠা দিয়ে। একেক স্থানে একেকভাবে খাওয়া যায় এই পিঠা। বানানোও খুব সোজা। তাই নিয়মিতই এই পিঠা তৈরি হতো। অনেক অঞ্চলে এটি মুঠি পিঠাও বলে পরিচিত।
জামদানি পিঠা
গাজীপুর, ময়মনসিংহ অঞ্চলে অতিথি আপ্যায়নে জামদানি পিঠার কদর ছিল কয়েক বছর আগেও। চালের গুড়ার কাই বানিয়ে সিরিঞ্জে ঢুকিয়ে কলাপাতার ওপর চলত নানান নকশা। কড়া রোদে কয়েক দিন শুকিয়ে তবেই তা ঘরে তোলা হতো। খাওয়ার আগে মুচমুচে করে ভেজে এর ওপর চিনি ছিটিয়ে দেওয়া হতো।
মুগপুলি
মুগ পুলি পিঠা সকাল কিংবা বিকেলের নাশতায় রাখা হতো। মুগ ডাল দিয়ে এর পুরটা তৈরি হয়। আলাদা একটা ঘ্রাণ থাকে। গরম গরম চায়ের সঙ্গেও খুব ভালো লাগে এই পিঠা। ওপরে মুচমুচে আর ভিতরে ডালের পুর থাকে। যেহেতু, এটা ঝাল পুর দিয়ে তৈরি করা তাই স্বাদে ছিল ভিন্নতা। যারা মিষ্টি পুলি পিঠা পছন্দ করেন না তাদের জন্যই এই পিঠা বানানো হতো।
অঞ্চলভিত্তিক ঐতিহ্যের যেসব পিঠা
আরও যেসব পিঠা মোগল আমল থেকে এই বাংলায় রাজত্ব করে যাচ্ছে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে পাটিসাপটা, গুজা পিঠা, ডালরুটি, ছিটপিঠা, ছানার মালপোয়া, দুধ পুলি।
এছাড়া ঢাকা ও ঢাকার আশেপাশের অঞ্চল যেমন- নবাবগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জ, সোনারগাঁ এলাকায় ঐতিহ্যবাহী অন্যান্য পিঠার মধ্যে মুখশলা পিঠা, চাপড়ি পিঠা, গুলগুলা পিঠা, খেজুর পিঠা, ডিমের ঝাল পুয়া, ঝাল পাটিসাপটা, বিবিখানা পিঠা, কলা পিঠা, তিল পুলি, সাবুর পিঠা, ম্যারা পিঠা, লবঙ্গ লতিকা, মুঠি পিঠা, ছিটরুটি, জামাই পিঠা অন্যতম।
নোয়াখালী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, ফরিদপুর, খুলনা, যশোর, মাগুরা, বরিশাল, সিলেট, দিনাজপুর তথাপি সারা বাংলাদেশেই পিঠা তৈরি হয়। সব অঞ্চলের পিঠাতেই নিজস্ব লোক ঐতিহ্য রয়েছে। নোয়াখালী, কুমিল্লা অঞ্চলের নিজস্ব পিঠা হলো খোলাজা পিঠা, ম্যাড়া পিঠা, ডিমের বিস্কুট পিঠা, নারিকেল পুলি পিঠা, গোলাপ পিঠা, সুজির পিঠা, ডিমের পানতোয়া, ঝাল পানতোয়া, ঝুনঝুনি পিঠা ও নারিকেলের চিড়া।
আবার চট্টগ্রামের ঐতিহ্য হলো বিন্নি ভাত বা মধু ভাত। চট্টগ্রামে কলা, নারিকেল, বিন্নি চাল, চিনি দিয়ে কলাপাতায় মুড়ে ভাপে পিঠা তৈরি করা হয়। স্থানীয় ভাষায় এ পিঠার নাম আতিক্কা পিঠা। আবার বিন্নি চালের গুঁড়ার সঙ্গে নারিকেল ও গুড় দিয়ে তৈরি হয় বিন্নি পুলি যা স্থানীয় ভাষায় পরিচিত হাফাইন্না পিঠা বা গোইজ্জা পিঠা নামে।
শরীয়তপুর বিখ্যাত বিবিখান পিঠার জন্য। জামালপুরের রোট পিঠা বা ওট পিঠা তৈরি হয় রান্না করা মাংস, চালের গুঁড়া, পেঁয়াজ, মরিচ সব মিশিয়ে। মাটির কলসিতে মিশ্রণটি ঢেলে চুলার আগুনে পুড়িয়ে তৈরি হয় বিচিত্র পিঠাটি।
সিলেটের গ্রামাঞ্চলের একটি পিঠা হলো চুঙ্গাপুড়া পিঠা। বাঁশের মধ্যে কলাপাতা দিয়ে তার মধ্যে ভেজানো বিন্নি চাল (সিলেটি ভাষায় বিরণ চাল) ভরে খের (খড়) দিয়ে মুখ আটকে চুলায় পোড়াতে হয়।
এছাড়া সিলেটের আরেকটি জনপ্রিয় পিঠা নোনতা বা নুনগড়া পিঠা। খুলনা, বাগেরহাট অঞ্চলের একটি জনপ্রিয় পিঠা হাত সেমাই পিঠা। সেমাই কাটার মেশিনে চালের গুঁড়ার মন্ড দিয়ে চিকন চিকন সেমাই কাটা হয়। তারপর ভাপে সেদ্ধ করে হাঁস ভুনা দিয়ে খাওয়া হতো। এমন সব বাহারি পিঠা আজ নাই বললেই চলে। অঞ্চল ভিত্তির পিঠার চলও এখন প্রায় বিলুপ্তর পথে।