শিশুর শিক্ষার হাতেখড়ি পরিবার থেকেই। ছোট্ট থেকেই শিশুকে বাংলার বর্ণমালা শেখানো হতো আদর্শলিপিতে। সেখানে বিভিন্ন ছবির সংযোগে বর্ণ পরিচিতি থাকতো। এরপর হতো শিশুকে বানান শেখানো। বানান শেখার পর পুরো বাক্য গঠন। এরপর পুরো লাইন জুড়ে পড়ে যেতে বলা হতো শিশুকে। ধীরে ধীরে বর্ণমালার সঙ্গে শিশুর পরিচিতি ঘটতো এভাবেই।
যুগ বদলেছে। শিক্ষায় এসেছে নতুনত্ব। নতুনত্বের ছাপ পড়েছে শিশুর লেখাপড়ায়ও। আদর্শলিপি থেকে বেরিয়ে এখন আবিস্কার হয়েছে বিভিন্ন মাধ্যম। শিশুরা এখন বর্ণমালা শুনেও শিখতে পারে। বর্ণমালার খেলনা দিয়েও বাবা মা শিশুকে হাতেখড়ি দেন। হরেক রকম খেলনাই পাওয়া যাচ্ছে। তাই শেখানোর রীতিতেও এসেছে আমূল পরিবর্তন।
বর্ণমালার গাড়ি, কাপড়ের তৈরি বর্ণমালা, ম্যাজিক স্লেট, ম্যাজিক স্টিক বুক সেট, সুডোকুর মতো বর্ণমালা ও সংখ্যার ব্লক, পাজলসহ বর্ণমালা শেখান নানা সামগ্রী এখন পাওয়া যায়। সবই বর্ণমালা শেখার অভিনব পদ্ধতি। তবে শিশুকে বর্ণমালা শেখানোর কৌশলটা কিন্তু আপনাকেই জানতে হবে। কীভাবে শুরু করবেন, কীভাবে শিশু সহজেই বর্ণমালা শিখতে পারবে সবটাই করতে হবে কৌশলে। এর জন্য় শিশুর মনের সঙ্গে মিশে যেতে হবে। মানে শিশুকে তার মতো করেই শেখাতে হবে।
বাংলার স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণ শিশুকে শেখানো হয় ধারাবাহিকভাবে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায়, বর্ণমালা শেখানোর এই ধারাবাহিকতা পরিবর্তন হলে শিশুর শেখাটা আরও সহজ হয়। কী উপায়ে সহজে শিশুকে বাংলার বর্ণমালা শেখাবেন তা নিয়ে থাকছে আজকের এই বিশেষ আয়োজন।
- বর্ণমালা শেখার আগের বইগুলোতে নির্দিষ্ট নিয়মে পড়া শুরু করতে হতো। কিন্তু এখন সেই নিয়মের বাইরে খেলার ছলেই শিশুকে অনেক কিছু শেখানোর সুযোগ রয়েছে। নিত্যনতুন শিক্ষাসামগ্রী বাজারে আসছে। যা দিয়ে ছোট্ট শিশুরা খেলতে খেলতেই বর্ণমালা শিখতে পারে। তাই বর্ণমালা শেখার শুরুটা হোক খেলার ছলেই।
- শিশুর বয়স যখন আড়াই বছর তখনই বর্ণমালার সঙ্গে পরিচিত করাতে পারেন। খেলনার সামগ্রী দিয়ে শিশুকে বর্ণমালা চেনাতে পারেন। ওই সময়টা শিশুকে যা শেখাবেন তাই সহজে ধারণ করবে।
- জোর করে শিশুর ওপর কিছু চাপিয়ে দেওয়া যাবে না। শেখা শুরু করতে হবে আনন্দদানের মাধ্যমে। বর্ণমালা মুখস্থ না করিয়ে আগে শিশুর সঙ্গে এর পরিচয় করাতে হবে। বর্ণ চেনাতে হবে। সব শিশুর শেখার ধরন এক নয়। যে শিশুর কাছে যেভাবে সহজ হবে তাকে সেভাবেই শেখাতে হবে।
- অনেকে শিশুকে বাংলা বর্ণমালা না শিখিয়ে প্রথমে ইংরেজি বর্ণগুলো শেখান। তাদের ধারণা, ইংরেজি বর্ণগুলো শিশুরা সহজে শিখতে পারে। আবার শিশুর বিদেশি বর্ণ বা ভাষা আয়ত্ত করা অনেকের কাছে আনন্দের হয়। এটা ঠিক নয়। বরং প্রথমে বাংলা বর্ণ শেখান। মাতৃভাষার প্রতি শিশু শ্রদ্ধাশীল হবে।
- বাংলার বর্ণমালা শেখানোর সময় ভুল উচ্চারণ করা যাবে না। শিশুও ভুলটাই শিখবে। তাই আগে সঠিক উচ্চারণ জেনে নিন। এরপর শিশুকে শেখান।
- ‘অ’ দিয়ে বাংলা বর্ণমালা শুরু। তাই বলে ‘অ’ দিয়েই শেখাতে হবে এমনটা করবেন না। শিশু যদি ‘ন’ বর্ণটি আগে চিনতে পারে তাকে তাই শেখান। বাংলা বর্ণের সঙ্গে আগে পরিচিতি হলে এরপর ধারাবাহিকভাবে শেখানো সহজ হবে।
- স্বরবর্ণের পর ব্যাঞ্জনবর্ণ শেখানো হয়। বাংলা বর্ণমালা এই পদ্ধতিতেই শেখানো হয় অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। যা শিশুর জন্য় আরামদায়ক নয়। শিশুকে বর্ণমালা ভাগ করে না দিয়ে তার মতো করেই শিখতে দিন। পরে তাকে স্বরবর্ণ ও ব্যাঞ্জনবর্ণের পরিচিতি জানাবেন।
- শিশুকে বর্ণ বা শব্দ শেখানোর আগেই বাক্য পড়ে শোনান। একটি সম্পূর্ণ বাক্য হতে পারে। ছড়া বা গল্প পড়েও শোনাতে পারেন। বাংলা বর্ণমালার ‘অ’ তে অজগর শেখার আগে শিশু পড়বে ‘অজগর সাপ অনেক বড়’। পরে তাকে এর মধ্যে থেকে বর্ণমালা শেখান।
- শিশুকে ‘অ’ দিয়ে পড়ানো শুরু করবেন? বইয়ে ‘অজগর’-এর ছবি রয়েছে। আপনি প্রথমে ছবি দেখিয়ে পরে লেখাগুলোর ওপর আঙ্গুল বুলিয়ে জোরে পড়বেন। যে শব্দটি পড়বেন সেই শব্দের উপরই আঙ্গুল রাখবেন। আপনার পড়ার পর শিশুর আঙ্গুল দিয়ে একইভাবে পড়তে বলবেন। এতে শিশু ছন্দে ছন্দে পুরো বিষয়টি পড়বে। আনন্দ পাবে। বর্ণমালা শেখা সহজ হবে।
- শিশু শব্দ পড়তে পারলে এরপর বর্ণমালা খুঁজে বের করতে বলুন। অজগর শব্দটি থেকে ‘অ’ বর্ণটি বের করতে বলুন। তখনই শিশুর কৌতুহলী মন জিজ্ঞেস করবে বর্ণ কী? উত্তরে বলবেন, ‘অ’ হচ্ছে একটি বর্ণ। এভাবে অন্য বর্ণগুলোও শিখবে শিশু।
- শুধু বইয়ে নয়, পত্রিকা বা কোনো পোস্টার দেখিয়ে শিশুকে বর্ণটি খুঁজে বের করতে বলুন। শিশু আনন্দের সঙ্গে কাজটি করবে এবং কখনোই ভুলবে না।
- শিশুকে বর্ণমালা লেখা শুরু করানোর আগে ধারাবাহিকতা না মানলেও চলবে। প্রথমে সহজ এবং একইরকম দেখতে বর্ণগুলো দিয়ে লেখা শুরু করান। এতে শিশুর বর্ণ লেখা ধরতে সহজ হবে।
- বর্ণমালা শেখানোর আগে বিভিন্ন আকৃতির সঙ্গে পরিচিত করান শিশুকে। সাধারণ দাগ শিখিয়ে শুরু করুন। বর্ণমালা শেখার প্রাথমিক রেখাগুলো আয়ত্ত করতে পারবে। আর একবার আয়ত্ত করতে পারলে শিশু সহজেই বর্ণমালা লিখতে পারবে।
- শিশুকে লেখা শেখানোর আগে ইচ্ছেমতো আঁকতে দিন। যেকোনো কিছু আঁকতে বলুন। পেনসিল বা কলম দিয়ে হাত ঘোরাতে বলুন। এক সময় শিশু বর্ণমালাও লেখা শিখে যাবে।
- আধুনিক অনেক সামগ্রী পাওয়া গেলেও শিশুকে পুরোনো শ্লেট ও চকের মাধ্যমেও বর্ণমালা লেখাটা শেখাতে পারেন। শিশুদের লেখার উপকরণ খসখসে হওয়া উচিত। এতে সহজে বর্ণের গঠন ও আকার লিখতে পারে শিশুরা।
- শিশুর শিক্ষককে অবশ্যই হাসিখুশি হতে হবে। শিক্ষক শিশুকে পড়াতে যাচ্ছেন এটা কোনোভাবেই বোঝানো যাবে না। বরং শিশুর সঙ্গে মিলে শিক্ষক কোনো একটি কাজ করবেন এবং খেলবেন এটাই বোঝাতে হবে শিশুকে। তাহলে শিশুর শেখার আগ্রহ বাড়বে।
- শিশু যতক্ষণ চায় ততক্ষণই পড়াবেন। জোর করে তাকে আটকে রাখবেন না। এতে শিশুর বিরূপ মনোভাব হতে পারে। আর একবার শিশুর বিরূপ মনোভাব এলে তাকে বর্ণমালা শেখানো কষ্ট হয়ে যাবে।