সোহেল রানার ‘অভিনেতা’ পরিচয় যত বেশি পরিচিত, তার ‘মুক্তিযোদ্ধা’ পরিচয় তত বেশি পরিচিত নয়। তবে যারা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে চর্চা করেন তারা হয়তো জানেন ’৭১-এর রণাঙ্গনের একজন সশস্ত্র যোদ্ধা ছিলেন তিনি। শুধু তাই নয় মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে নির্মিত দেশের প্রথম মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সিনেমার প্রযোজকও ছিলেন এই যোদ্ধা।
মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের পেছনে সোহেল রানার একমাত্র প্রেরণা ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তার ডাকেই তিনি দেশকে পাক হানাদার বাহিনী মুক্ত করার শপথ নিয়ে যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েন।
সোহেল রানার ভাষায়, “ছাত্র রাজনীতিতে করার সময় বিভিন্ন আন্দোলনের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে ফেলি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইকবাল হলে থাকাকালীন স্বাধীনতা অন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হই। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ শোনার পর পাকসেনাদের সঙ্গে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি। নিজের জীবন বাজি রেখেই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করি।”
যুদ্ধের সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়লে এখনো শিউরে ওঠেন সোহেল রানা। স্মৃতির পাতা উল্টে তিনি বলেন, “মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোর কথা ভুলে যাওয়া সম্ভব নয়। জীবন বাজি রেখে টানা নয় মাস যুদ্ধ করেছি। প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুর হাতছানি ছিল। তবুও ভয় পাইনি। দেশকে স্বাধীন করা ছিল মূল লক্ষ্য। সেই দিনগুলোর কথা মনে হলে এখনও শিউরে উঠি। আমি হয়তো আজ বেঁচে আছি। কিন্তু মানুষকে দেখেছি রাস্তায় মরে থাকতে। নির্মমভাবে কত মানুষ না খেয়ে, পুড়ে, ধর্ষিত হয়ে মারা গেছে। সে দিনগুলোর কথা মনে হলে কান্নায় ভেঙে পড়ি। আসলে আমরা কতটা নির্যাতিত ছিলাম।”
দেশ স্বাধীনের পর প্রথম মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র ‘ওরা ১১ জন’র প্রযোজক ছিলেন সোহেল রানা। তিনি জানান, এই সিনেমার ১১ জন অভিনেতার ১০ জনই ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা।
সোহেল রানার কথায়, “এক ধরনের তাড়না থেকে আমি ‘ওরা ১১ জন সিনেমাটি’ নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিই। মুক্তিযুদ্ধ শেষে আমি ঢাকায় ফেরার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হলে যাই। তখন হলের একজন আমাকে বললেন, ‘আপনারা যুদ্ধ করে ফিরে এলেন কিন্তু অনেকেই তো ফিরতে পারেননি!’ কথাটা আমার মনে খুব দাগ কাটে। আসলেই তো, আমরা অনেক আপনজন হারিয়েছি। এমন কিছু কি করতে পারি না, যেখানে সব ফুল এক করা যাবে? হয়তো খুব ভালো কিছু হবে না। কিন্তু একটি মালা তো হবে। এই ভাবনা থেকে যুদ্ধে অংশ নেওয়া বন্ধুরা মিলে ‘ওরা ১১ জন’ নির্মাণ করি।”
তিনি আরও বলেন, “ছবির অধিকাংশ শিল্পী পারিশ্রমিক নেননি। এমনও দিন ছিল, প্রযোজক হিসেবে আমি তাদের ভাত পর্যন্ত খাওয়াতে পারিনি। এদের মধ্যে আলতাফ ছাড়া আর কারও অভিনয়ের কোনো প্রশিক্ষণ ছিল না।”
তবে সোহেল রানার আক্ষেপ আছে এই প্রজন্মের ওপর। তার মতে এখনকার প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানে না। তাই তরুণ প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানার আহ্বান জানালেন।
সোহেল রানা বলেন, “আমি অবাক হই যখন দেখি এখনকার প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাসটা জানে না। দেশপ্রেমিক হতে হলে অবশ্যই তাদের সঠিক ইতিহাস জানতে হবে। স্বাধীনতার মর্মার্থ বুঝতে হবে। স্বাধীনতার মানে কী তা জানতে হবে। স্বাধীনতা আমাদের অহঙ্কার। তাই তরুণ প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস জানতে হবে। এর জন্য তাদের আরও বেশি বেশি বই পড়তে হবে। মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র দেখতে হবে। তবেই সুখি-সমৃদ্ধ দেশ গড়ে উঠবে।”
সোহেল রানা এখন জীবনের শেষ ধাপে এসে পৌঁছেছেন। মৃত্যুর আগে তিনি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ দেখে যেতে চান। শুধু তাই নয়, বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াক বাংলাদেশ—সেটাই চান দেশের কিংবদন্তি এই মুক্তিযোদ্ধা অভিনেতা।