• ঢাকা
  • শনিবার, ২৩ নভেম্বর, ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
জলবায়ু পরিবর্তন

বাংলাদেশের জন্য ঝুঁকিটা অনেক বেশি: আনু মুহাম্মদ


বিধান রিবেরু
প্রকাশিত: নভেম্বর ৮, ২০২১, ০৮:১০ পিএম
বাংলাদেশের জন্য ঝুঁকিটা অনেক বেশি: আনু মুহাম্মদ

এ বছরের জলবায়ু সম্মেলন (কপ-২৬) শুরু হয় গত ৩১ অক্টোবর। এরপর ২ নভেম্বর সংবাদ প্রকাশের পক্ষ থেকে ‘সাম্প্রতিক’ অনুষ্ঠানে এ বিষয়ে কথা বলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা কমিটির সদস্য সচিব আনু মুহাম্মদ। ‘জলবায়ু সম্মেলন ও বাংলাদেশের অবস্থান’ নিয়ে তিনি এসময় কথা বলেন সংবাদ প্রকাশের প্রধান নির্বাহী বিধান রিবেরুর সঙ্গে। সেই অনুষ্ঠানেরই লিখিত রূপ এখানে প্রকাশ হলো। শ্রুতিলিখন করেছেন তাহনিয়া ইয়াসমিন।


বিধান রিবেরু: কপ-২৬, অর্থাৎ জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলন চলছে। সেখানে উন্নত দেশগুলোর পাশাপাশি অনুন্নত দেশগুলো দর কষাকষির ভেতরে আছে। বৈশ্বিক তাপমাত্রা গড়ে ১.৫ ডিগ্রী সেলসিয়াসের বেশি না বাড়ে, সেদিকে যেন সবার নজর কম, সবাই ব্যস্ত জলবায়ু বিপর্যয়কে সামনে রেখে কতটুকু অর্থ পাওয়া যাবে, বা কতটুকু কম অর্থ দিয়ে পাড় পাওয়া যাবে। অনুন্নত দেশগুলো তাকিয়ে আছে উন্নত দেশগুলোর দিকে তারা কতটুকু সাহায্য পাবে। আর উন্নত দেশগুলো কমাতে চাচ্ছে না তাদের মুনাফার পরিমাণ, তাই তাপমাত্রা, কার্বণ ইত্যাদি কমানোর ব্যাপারে তারা খুব একটা আগ্রহী নয়। পরিবেশ বিপর্যয়ের বিষয়টির পুরোটাই দেখা হচ্ছে মুনাফা ভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। জি-২০ গ্রুপের ৮০ ভাগই বড়লোক দেশ। তারাই বেশিরভাগ কার্বনের নিঃসরণ ঘটাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে সঙ্কটের সমাধান হবে কি না তা জানতে চাইব আপনার কাছে।

আনু মুহাম্মদ: আমরা যে পুঁজিবাদী বিশ্ব ব্যবস্থাপনার মধ্যে আছি, এই অর্থনৈতিক ব্যবস্থার প্রধান লক্ষই হচ্ছে যে কোনোভাবে মুনাফা অর্জন করা। মুনাফা অর্জনই যদি প্রধান লক্ষ হয় তাহলে তার প্রধান শিকার হয় মানুষ এবং প্রকৃতি। নদী-নালা, খাল-বিল, বন-জঙ্গল, পাহাড়-সমুদ্র সমস্ত কিছুই আক্রান্ত হয়। অনিয়ন্ত্রিত এবং সীমাহীন মুনাফার হার বাড়ানোর জন্য ক্রমাগত একটার পর একটা ক্ষেত্র বিনিয়োগের ভিতরে আনতে হয়। আবার এমন ধরনের বিনিয়োগ করতে হয় যাতে মুনাফা বেশি হয় অথবা তাদের নিশ্চিত মুনাফা হয়। প্রকৃতি যদি নষ্ট হয়, প্রকৃতির ভারসাম্য যদি নষ্ট হয়, ইকোলজিকাল সিস্টেম যদি নষ্ট হয়, মানুষ যদি বিপর্যস্ত হয়, ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যদি বিপর্যস্ত হয় সেটা যারা মুনাফার ভাগিদার তাদের তাতে কিছু আসে যায় না। এটারই পরিণতিতে আমরা দেখতে পাচ্ছি—এই কয়েকশ বছরে এখন মানব জাতির অস্তিত্বই বিপন্ন। এর পেছনে যারা প্রভাবশালী দেশ বা যাদের বিনিয়োগ সবচেয়ে বেশি এবং বহুজাতিক কোম্পানি তাদের হাত তো আছেই, বিশেষ করে ফসিল ফুয়েল এখানে একটি বড় ভূমিকা পালন করছে, বিশেষত কয়লা, তেল পাশাপাশি এমন ধরনের ইন্ডাস্ট্রি যেগুলো থেকে কার্বন নিঃসরণ হয়, পরিবেশ দূষণ হয়। নদী-নালা, খাল-বিল ক্ষতিগ্রস্ত হয় এই ধরনের বিনিয়োগ যেখানে হচ্ছে, সেখানেই মূলত ইকোলজিকাল সিস্টেম ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বেশি। এতে অসুখ-বিসুখ বেড়ে যাচ্ছে, তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। যার ফলস্বরূপ আমরা দেখতে পাই, ঝড়বৃষ্টি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ বিভিন্ন দেশে ব্যাপক হারে বেড়েই চলেছে। এবং যে সমস্ত দেশ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত, তার মধ্যে বাংলাদেশ একটি। সারা বিশ্বই ক্ষতিগ্রস্ত হবে কোনো না কোনো ভাবে। ইতিমধ্যে বাংলাদেশের এক তৃতীয়াংশ ডুবে গেছে। ঘনবসতি হওয়ার কারণেই বাংলাদেশের জন্য বিপদ হবে। এখানে যদি ইকোলজিকাল সিস্টেম বিপদগ্রস্ত হয় তাহলে ক্ষতিটা হবে অন্য যেকোনো দেশের চেয়ে বেশি।

রিবেরু: প্রধানমন্ত্রী জলবায়ু সম্মেলনে বলেছেন, পরিবেশ রক্ষার জন্য বাংলাদেশ ১২ বিলিয়ন ডলারের ১০টি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ বাতিল করেছেন, এছাড়া তিনি আরও চারটি দাবির কথা জানিয়েছেন উন্নত বিশ্বের দেশগুলোর সামনে। এগুলো আসলে যথেষ্ট কি না, বাংলাদেশ ক্ষতির যে প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে তার তুলনায়?  

মুহাম্মদ: বাংলাদেশের জন্য ঝুঁকিটা অনেক বেশি, কারণ বাংলাদেশ ঘনজনবসতিপূর্ণ একটি দেশ। দেশে বন খুব কম। বাংলাদেশ নদী এবং পানি কেন্দ্রিক সুতরাং জলবায়ু পরিবর্তনের যে চাপ তাতে বাংলাদেশের সামগ্রিক নদী-নালা, খাল-বিলের উপরে চাপ পড়বে, লবণাক্ততা বেড়ে যাবে। বন শেষ হয়ে যাবে। প্রাকুতিক দুর্যোগ বৃদ্ধি পাবে। এটা থেকে বের হওয়ার জন্য আমাদের ২টা পদক্ষেপ নিতে হবে। একটা হচ্ছে বিশ্বব্যাপী ক্যাম্পেইন করা, যাতে শিল্পেন্নত দেশগুলো ক্ষতিকর কার্বন নিঃসরণ কমায়। দ্বিতীয়টি বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, বাংলাদেশের সরকার নিজে যেন এমন ধরনের উন্নয়ন প্রকল্প করে যাতে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি আরও বেশি না হয়। যেমন আমি উদাহরণ দিয়ে বলি, জলবায়ু পরিবর্তনের মুখে বাংলাদেশ খুব নাজুক। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের যে উপকূল অঞ্চল সবার আগে তা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কারণ সমুদ্রের পানি যদি বেড়ে যায়, তাপমাত্রা যদি বেড়ে যায়, সবচেয়ে প্রথম আক্রন্ত হবে এই উপকূল অঞ্চল। সেজন্য বাংলাদেশের উন্নয়ন পরিকল্পনা এমনভাবে দাঁড় করাতে হবে যাতে উপকূল অঞ্চলে প্রাকৃতিক রক্ষা পর্ব আরও শক্তিশালী হয়, আরও বনায়ন হয়, সেখানে যাতে নদীর পানির ফ্লো বেশি থাকে।

বাংলাদেশে উন্নয়ন প্রকল্প যেভাবে নেওয়া হচ্ছে যেমন সুন্দরবন বিনাশী রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প কিংবা সুন্দরবনের ঘাড়ের উপরে প্রায় ২০০টি বিষাক্ত শিল্পকারখানা করা হয়েছে। কয়দিন আগে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বললেন, রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্পের তুলনায় অনেকবেশি কার্বন নিঃসরণ হবে সিমেন্ট কারখানা থেকে। তাহলে এটার অনুমতি তো সরকারই দিয়েছে। এই যে প্রধানমন্ত্রী ১০টা বিদ্যুৎ কেন্দ্র বাতিল করে, এটাকে কৃতিত্ব হিসেবে উপস্থাপন করছেন, কিন্তু এই ১০টা বিদ্যুৎ প্রকল্পের কিন্তু কার্যত কোনো প্রসেসিং হয়নি, এগুলো ছিল খুবই প্রাথমিক পর্যায়ে। এগুলো কোনো ফিন্যান্স পাচ্ছিল না, এগুলো আসলে বাস্তবায়ন যোগ্যই ছিল না আসলে। তো সেগুলো বাতিল করে সরকার আন্তর্জাতিক দরবারে কৃতিত্ব হিসেবে হাজির করছে। কিন্তু যে কয়লা প্রকল্পগুলো বাংলাদেশের সর্বনাশ করতে যাচ্ছে, তার মধ্যে রামপাল বিদ্যৎকেন্দ্র সবচেয়ে বেশি সর্বনাশ করবে এবং পাশাপাশি আছে মাতারবাড়ি ও বাঁশখালি প্রকল্প। এই তিনটার সঙ্গে যুক্ত তিনটা দেশ ভারত, জাপান এবং চীন। এই তিনটা দেশ কিন্তু শিল্পোন্নত দেশ হিসেবে বা জি-২০ এর মধ্যে তারা একটা নেতৃত্বস্থানীয় জায়গায় আছে। এই তিনটা দেশের কোম্পানি কিন্তু বাংলাদেশের উপকূলে আরও বড়ধরনের ক্ষতি করার প্রকল্প নিয়ে হাজির হয়েছে। বাংলাদেশ সরকার এখানে কার্বন নিঃসরণের কথা অনেক সময় বলা হয়, প্রধানমন্ত্রীও বলেছেন, হ্যাঁ আমাদের এখানে কার্বন নিঃসরণ কম হচ্ছে। বাংলাদেশের জন্য বিবেচনা কিন্তু কার্বন নিঃসরণের মাধ্যমে গ্লোবাল এনভায়রনমেন্ট কতটা ক্ষতি করছেন, তারচেয়ে বড় প্রাসঙ্গিক বিষয় হচ্ছে, সেটা বাংলাদেশের জন্য কতটা ক্ষতি করছে। যেমন রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রসহ এইযে কয়লা প্রকল্প, এটা কার্বন বৈশ্বিক বায়ুমণ্ডলে যতটা ক্ষতিগ্রস্ত করবে, তারচেয়ে অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবো আমরা নিজেরা। বাংলাদেশের সরকারকে এই কথাগুলো আমরা বহুদিন থেকে বলি আসছি। বাংলাদেশ সরকার জনগণের স্বার্থ যেখানে, আন্তর্জাতিক দরবারে তাদেরকে সন্তুষ্ট করার জন্যে একটা তথ্য দিচ্ছে যে—আমরা ১০টা প্রকল্প বাতিল করছি, কিন্তু জনগণের স্বার্থরক্ষার জন্য, আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রক্ষা করার জন্য এবং আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষা করার জন্য, আমাদের প্রধান প্রাকৃতিক সম্পদ সুন্দরবন রক্ষা করার জন্য সরকারের প্রথমেই উচিত রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র বাতিল করা। কক্সবাজার থেকে সুন্দরবন এই উপকূলকে রক্ষার জন্য মাতারবাড়ি, বাঁশখালি, রামপাল এসব প্রকল্প বাতিল করতে হবে। এগুলোর প্রত্যেকটিই কিন্তু ক্ষতিকর। এবং সেখানে যুক্ত যারা আছেন, তারা বিশ্বের দরবারে অনেক উচ্চস্বরে কথা বলছে। বাংলাদেশের সরকার দেশের ভেতরে দেশকে জলবায়ু পরিবর্তনের মুখে আরও বিপদগ্রস্ত করছে, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক দরবারে গিয়ে দাবি করছে আমাদের টাকা-পয়সা দিতে হবে। এটা খুবই লজ্জাজনক, স্ববিরোধী এবং প্রতারণামূলক।

রিবেরু: এটা তো সত্যি যে আমরা এখন ষষ্ঠ মহাবিলুপ্তির পথে হাঁটছি। প্রতিদিন প্রায় ২০০ প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। এমন একটা নাজুক অবস্থার ভেতরে জলবায়ু সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। সেখানে বলা হচ্ছে বাংলাদেশ ২০৩০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণ ২২ শতাংশ কমাতে চায়। এবং যে অর্থের দারকার সেটা হচ্ছে ১৫ লাখ কোটি টাকার সমান। যারা নীতিনির্ধারক পর্যায়ে রয়েছেন তারা বলছেন এই লক্ষমাত্রা অর্জন করা সম্ভব। যদিও এটা উচ্চভিলাসী তবুও অসম্ভব নয়। বাস্তব পরিস্থিতি বিবেচনায় বাংলাদেশ ২০৩০ সালের মধ্যে ২২ শতাংশ কি আসলেই কমাতে পারবে?

মুহাম্মদ: আসলে এই হিসাব-নিকাশগুলো খুবই সুবিধাবাদী এবং প্রতারণামূলক। কারণ আপনি যদি খেয়াল করেন দেখবেন, টাকার অভাবে কার্বন নিঃসরণ কমানো যাচ্ছে না বা পরিবেশ রক্ষা করা যাচ্ছে না, কথাটা পুরো উল্টো আসলে। টাকা খরচ করার কারণে বা ভুল জায়গায় বিনিয়োগ করার কারণেই কিন্তু আমাদের পরিবেশ বিপর্যয় হচ্ছে। যে প্রকল্পগুলোর কথা আমি বললাম, এই কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বা ইটভাটা যেভাবে চালানো হচ্ছে কিংবা ইটিপি নাম ব্যবহার করে বিভিন্ন ধরনের ফ্যাক্টরি চালানো, কিংবা সুন্দবনের ঘাড়ের উপর সিমেন্ট কারখানা বসানো, এগুলোর পেছনে যে টাকাটা খরচ হচ্ছে, এই টাকাটা খরচ না করলেই কার্বন নিঃসরণ অনেক কমে যায়। তারমানে কার্বন নিঃসরণের জন্য টাকা লাগবে বিষয়টা তা নয়। কার্বন নিঃসরণ কমাতে উন্নয়ন প্রকল্পে, উন্নয়ন পরিকল্পনায়, উন্নয়ন দর্শনের একটা পরিবর্তন করতে হবে। যাতে টাকা খরচ আরও কমে যাবে।

২০১৭ সালে সরকারকে একটা বিকল্প মহাপরিকল্পনা দিয়েছিলাম। সেখানে আমরা দেখিয়েছিলাম কয়লা এবং পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে সরকার যদি সরে আসে তাহলে একটা বিশাল বিপর্যয় থেকে রক্ষা পাবে। আবার খরচও কমে যাবে। টাকার পরিমাণও কমে যাবে, বিনিয়োগও কম করতে হবে, কারণ কম খরচের মধ্যে আমরা সৌরবিদ্যুৎ এবং আমাদের দেশীয় গ্যাস, অনুসন্ধানের জন্য যে সামান্য খরচ, এই দুটো যোগ করলে আমরা পরিবেশবান্ধব, সুলভ এবং টেকসই বিদ্যুৎ উৎপন্ন করতে পারবো। প্রধানমন্ত্রী গতকাল বলেছেন যে, ২০৪১ সালের মধ্যে ৪০ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানী তৈরি করবে। এই কথাটির সঙ্গে যদি সত্যিই তিনি বিশ্বাস করতেন এবং পরিকল্পনা গ্রহণ করা হতো তাহলে আমরা খুব খুশি হতাম। কারণ আমরা বিকল্প মহাপরিকল্পনার মধ্যে বলেছি, ২০৪১ সালের মধ্যে ৫৫ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদন করা সম্ভব। সেখানে প্রধানমন্ত্রী যদি বলেন ৪০ শতাংশ তাও কাছাকাছি হবে। কিন্তু কার্যত কী হচ্ছে? সরকার একের পর এক কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের অনুমোদন দিচ্ছে আর পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র করছে এবং সরকারের যে মহাপরিকল্পনা আছে সেখানে ২০৪১ থেকে ২০৫০ সালের ভেতরে শতকরা ১০ ভাগের বেশি নবায়নযোগ্য জ্বালানী নেই। দেশের উন্নয়নে এক রকম ভূমিকা এবং আন্তর্জাতিক দরবারে গিয়ে যে সমস্ত কাগজপত্র প্লেস করা হয় কিংবা বক্তব্য দেওয়া হয়, এটা সম্পূর্ণ বিপরীত থাকলে কিভাবে বাংলাদেশ এরকম মহাবিপর্যয় থেকে রক্ষা পাবে?

জলবায়ু পরিবর্তনের যে বিপদ এটা তো প্রকৃত বিপদ। আর এই প্রকৃত বিপদটা বাংলাদেশের জন্য আরও বেশি বিপজ্জনক।  এইজন্য বাংলাদেশের উপকূল থেকে শুরু করে বাংলাদেশে ঘনজনবসতি। বাইরের দেশে দেখবেন চায়না, ভারত, অস্ট্রেলিয়াসহ যেসব দেশে কয়লা অনেক বেশি তাদের যে সমস্ত জায়গায় এসব প্রকল্প সেখানে মানুষই নেই। তারা পাহাড়, বন কিংবা মরুভূমিতে এইসব প্রকল্প করেছে। অন্যদিকে বাংলাদেশে প্রকল্পগুলো মানুষের মধ্যেই গড়ে উঠেছে। যেখানে নদীর ওপরে বাংলাদেশের পুরো অর্থনীতিটা নির্ভর করে, সেই নদী বিপর্যস্ত হতে যাচ্ছে। এরকম একটা অবস্থায় বাংলাদেশ ২০৪১ সালের মধ্যে বলা হচ্ছে ৪০ শতাংশ কিন্তু পরিকল্পনা করা হচ্ছে ১০ শতাংশ। এবং পুরো উল্টো যাত্রা করা হচ্ছে। এটা আমাদের খুব উদ্বেগজনক। দেশের ভেতরে উন্নয়ন প্রকল্প যেভাবে নেয়া হচ্ছে উন্নয়ন দর্শনটায় হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনের বিপদটা আরও বাড়ানো। আমরা জানি এটার জন্য টাকা আসছে কিন্তু সেটা খরচের মধ্যে কিরকম অনিয়ম এবং দুর্নীতি হয়। সেগুলোর জন্য অনেকের আকাঙ্ক্ষা থাকতে পারে কিন্তু এই টাকার জন্য মূল প্রয়োজন যেটা সরকারের নীতি পরিবর্তন করা এবং জনগণের দিকে ঘাড়টা ঘুরানো দরকার। কিছু দেশি-বিদেশি গোষ্ঠী সুবিধভোগীদের দিকে না তাকিয়ে সরকার যদি জনগণের দিকে তাকায় এবং পুরো নীতিগত দিকের একটা পূনর্বিন্যাস করে তাহলে একটা নিরাপদ বাংলাদেশ পাওয়া সম্ভব। জলবায়ু পরিবর্তনে বাংলাদেশের যে শক্তি দরকার, আমাদের তো শক্তি থাকতে হবে, বাইরের দেশগুলো কমালেও আমাদের আভ্যন্তরীণ শক্তি যদি না থাকে মোকাবিলা করার, তাহলে যতটা আক্রান্ত হবো আমরা, ক্ষতি হবে তার থেকেও বেশি। সেজন্য এই পুরো উন্নয়ন নীতি এবং পরিকল্পনার একটা পরিবর্তন আনা দরকার। যার জন্য কোনো অর্থের প্রয়োজন নেই্, প্রয়োজন শুধুমাত্র জনগণের স্বার্থ এবং দেশের স্বার্থ বিবেচনা, সেটা করলেই এটা পরিবর্তন করা সম্ভব। উন্নয়ন নীতি বাস্তবায়ন করতে গেলে জনগণকেও সঙ্গে পাওয়া যাবে। এবং সেটা জলবায়ু পরিবর্তনে আমাদের সামগ্রিক প্রতিরোধ করা সম্ভব।

রিবেরু: ইউরোপ আমেরিকার তরুণরা বৈশ্বিক উষ্ণতা ও জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে বিশ্বনেতাদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন করতে শুরু করেছে, তারা অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে। বাংলাদেশের তরুণ সমাজে সেরকম কিছু দেখা যাচ্ছে না। এটা নিয়ে যদি কিছু বলতেন।

মুহাম্মদ: তরুণদের কণ্ঠ সোচ্চার করতে হবে। নীতিগত কাজটি করার এখতিয়ার তো সরকারের। যেমন আমি যে প্রকল্পগুলোর কথা বললাম আমাদের নদী বিনষ্ট হচ্ছে যে সমস্ত নীতি এবং কর্মসূচির কারণে, আমাদের পরিবেশ বিষাক্ত হচ্ছে, সেগুলো পরিবর্তন করা প্রথমত আমাদের সরকারের দায়িত্ব এবং সরকারের এখতিয়ার। কিন্তু সেটার বাইরে জনগণের সজাগ, সচেতন এবং সংগঠিত ভূমিকা নিতে হবে। সবসময় সব কাজে, সবকালে তরুণরাই তো ইতিহাস তৈরি করে। ইউরোপ, আমেরিকা, এশিয়া, আফ্রিকা সব জায়গায় তরুণরা নিজেদের সোচ্চার করে তুলছে। যা খুবই আশাব্যঞ্জক ঘটনা। সুন্দরবনের ঘটনায় আমরা দেখেছি সেখানে তরুণরাই সবচেয়ে বেশি অংশগ্রহণকারী ছিল। আমাদের যে প্রজন্ম বা সরকারে যারা আছে তাদের যে প্রজন্ম তাদের চেয়ে অনেক বেশি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আমাদের তরুণ প্রজন্ম। কারণ এই যে ক্ষতিগুলো হচ্ছে এই ক্ষতিগুলো পরের প্রজন্মকে আরও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করবে। যারা শিশু তারা আরও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে, যারা জন্মগ্রহণ করেনি তাদের জন্য ঝুঁকি অনেক বেশি। সুতরাং তরুণরা এখানে সোচ্চার, সরব এবং সজাগ হলে তাদের কণ্ঠই বাংলাদেশের সরকারকে বাধ্য করতে পারবে। তরুণদের মাধ্যমেই এমন একটা পরিবর্তনের দিকে যেতে পারব আমরা, যেখানে বাংলাদেশ একটি নিরাপদ বাসভূমিতে পরিণত হবে।        

 

কথাপ্রকাশ বিভাগের আরো খবর

Link copied!