• ঢাকা
  • শনিবার, ২৩ নভেম্বর, ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

বিজনেসটা আগে বুঝতে হবে, তাহলে সফল হবেন: সাহিদ রেজা শিমুল


শাহাদাত হোসেন তৌহিদ
প্রকাশিত: জুলাই ১৯, ২০২১, ০২:৩০ পিএম
বিজনেসটা আগে বুঝতে হবে, তাহলে সফল হবেন: সাহিদ রেজা শিমুল

মার্কেন্টাইল ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান এ কে এম সাহিদ রেজা শিমুল। তৈরি পোশাক শিল্প ও বস্ত্র উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান রেজা গ্রুপের চেয়ারম্যান। বীমা, আর্থিক, সেবা, সংবাদপত্র ও ইলেকট্রনিক মিডিয়াসহ বহুবিধ ব্যবসা ও শিল্পের সঙ্গে জড়িত তিনি। তিনি ফেনী চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সাবেক সভাপতি,এফবিসিসিআই’র পরিচালক ও সিআইপি। এছাড়া ও তিনি ফেনী ইউনিভার্সিটির ট্রাস্টি বোর্ডের ভাইস-চেয়ারম্যান, ফেনী ডায়াবেটিক সমিতি, ধলিয়া ও বাগেরহাট উচ্চ বিদ্যালয়ের সভাপতিসহ অসংখ্য শিক্ষা, ধর্মীয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের সাথে সম্পৃক্ত রয়েছেন। এই শিল্পোদ্যোক্তা ১৯৬৫ সালের ৩১ মার্চ ফেনীতে জন্মগ্রহণ করেন।

সম্প্রতি তার উদ্যোক্তা জীবনের গল্প, ব্যাংক খাত, নতুন উদ্যোক্তার জন্য নানা পরামর্শসহ কয়েকটি বিষয়ে সংবাদ প্রকাশের সঙ্গে কথা বলেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শাহাদাত হোসেন তৌহিদ


সংবাদ প্রকাশ: বর্তমানে আপনি দেশের অন্যতম একজন শিল্পোদ্যোক্তা, কীভাবে শুরু হয়েছিল এ যাত্রা?

সাহিদ রেজা: আমি বাই চয়েস শিল্পোদ্যোক্তা। হঠাৎ করে আসিনি। পড়াশোনা করেছি। তারপরে প্রায় সাত বছরের মতো একটি বেসরকারি ব্যাংকে চাকরি করেছি। একটা সময় মনে হলো যে, চাকরির গতিটা একটা সীমিত জায়গায় গিয়ে চাকরিটা আর যায় না। এ জন্য আমি ভাবলাম, নিজে কিছু করা যায় কি না। তিরানব্বই সালের দিকে এ নিয়ে ভাবতে শুরু করি। তখন আমার ছোট ভাই পড়াশোনা শেষ করেছে। ভাবলাম যে, আমি চাকরি করেছি, আমার ভাই যেন চাকরি না করে। আমরা যেন চাকরিদাতা হই। তাকে বললাম যে, তুমি কোনো চাকরি আবেদন করার দরকার নেই। চলো, আমরা ব্যবসা শুরু করি।  যদিও এটা কঠিন সিদ্ধান্ত ছিল। কারণ, আমার পুরো পরিবারই চাকরিজীবী ছিল। আমার দাদা-বাবা, আত্মীয়স্বজন সবাই চাকরি করতেন। আমার দাদার পরিবার বড় কৃষিজীবী পরিবার ছিল। আমার দাদার চার ছেলে। চার ছেলের মধ্যে বাবা তৃতীয়। বাবা এন্ট্রাস পাস করে পোস্টমাস্টার হিসেবে কাজ করেছেন। শেষ বয়সে বাবা সমবায়ের বিভাগীয় পর্যায়ের কর্মকর্তা ছিলেন। সাধারণভাবে আমিও চাকরিতে  এসেছি।

ব্যবসায় শুরুর দিকে প্রথম কাজের অভিজ্ঞতা দারুণ। একটি কাজে আমি ঢাকা জেলা সিভিল সার্জন অফিসে গেলাম। সেখানে একজন ব্যক্তির জন্য অপেক্ষা করছিলাম। এসময় আমার নজর পড়ল নোটিশ বোর্ডের দিকে। সেখানে দেখলাম যে, ওষুধ কোম্পানি আছে অ্যাসেনসিয়াল ড্রাগস। অ্যাসেনসিয়াল ড্রাগস তেজগাঁওয়ে কাঁচ, বোতল ইত্যাদি কিছু ভাঙা জিনিস বিক্রি করে। আমার হঠাৎ আগ্রহ তৈরি হলো যে, আমি এটাতে অংশগ্রহণ করতে পারি কি না। আমার একজন আত্মীয় আছেন, তিনি এ ধরনের ব্যবসা করতেন। কাঁচের জিনিস তৈরি ও সরবরাহ করতেন। ছোট ভাইকে বললাম, ওনার সঙ্গে আলাপ করতে, আমি এ রকম একটা জিনিস দেখে এসেছি সেটাতে অংশগ্রহণ করতে পারি কি না। পরে আমি সেটাতে অংশগ্রহণ করি। এটাতে লাভের মুনাফা তৈরি হলো। সেখান থেকে ধরতে গেলে আমার ব্যবসা শুরু। ওই লাভের টাকা থেকে আমি ট্রেড লাইসেন্স করি। 

সংবাদপ্রকাশ: তারপর?

সাহিদ রেজা: এর মধ্যে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পরে রাশিয়াতে একটা বিরাট পরিবর্তন আসছে। আমাদের পাড়ার কিছু ছেলেপেলে যারা রাশিয়াতে পড়াশোনা করত, ওদের কাছে শুনলাম রাশিয়াতে বাংলাদেশের বড় একটি পোশাকশিল্পের বাজার আছে। রাশিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ শুরু হচ্ছিল তখন। বিশেষ করে পোশাকশিল্পের যে উদ্বৃত্ত পণ্য আছে সেগুলোর। রাশিয়াতে পরিচিত ছাত্র যারা ছিল তাদের সহযোগিতা নিয়ে ব্যবসা শুরু করি। পরে মস্কোতে ধীরে ধীরে অফিস করি। অল্প অল্প করে প্লেনে করে পণ্য নিয়ে যেতাম। ধীরে ধীরে বড় আকারে নিতাম। এরপরে আমি ‘ন্যাশনাল টি’ কোম্পানি থেকে চা নিয়েছিলাম একবার। এভাবে এ রকম কিছু কাজ করি। 

রাশিয়ায় যে পরিবর্তনটা হচ্ছিল, সেটার সঙ্গে আমরাও নিজেদের মানিয়ে নিই। অন্য বাঙালিরা যা করছিল আমরাও তাই করি। এভাবে রাশিয়াতে আমরা ‘৯৮ সাল পর্যন্ত এ কাজগুলো করেছি। ৯৩-তে চাকরি ছেড়ে দেওয়ার জন্য যখন প্রস্তাব দিই তখন আমার অব্যহতিপত্র একসেপ্ট (গ্রহণ) হচ্ছিল না। পরে আমি খোঁজ নিলে আমাকে ম্যানেজিং ডিরেক্টরের সঙ্গে দেখা করার জন্য বলা হয়। ম্যানেজিং ডিরেক্টর ছিলেন বিশিষ্ট ব্যাংকার কাজী আবদুল মজিদ সাহেব। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি চাকরি ছাড়বেন কেন? আমি বললাম, আমি চাকরি ছেড়ে ব্যবসা করব। তিনি জিজ্ঞেস করলেন যে, ফ্যামিলি ব্যবসা? আমি বললাম না, আমিই ব্যবসা করব। তিনি আমাকে বললেন ভেবে দেখছেন, রিস্ক ফ্যাক্টর কী কী আছে? আমি বললাম, স্যার দেখছি। আমার মনে হলো আমি নিজে যদি কিছু করি তাহলে ভালো করেতে পারব। তিনি আমাকে বললেন ঠিক আছে করেন। যদি কোনো দিন ব্যাংকিং করার দরকার হয় আমার কাছে আসবেন। আমি খুব আশা নিয়ে ন্যাশনাল ব্যাংকের চাকরিটা ছেড়ে দিই। পরে কিন্তু তিনি আমার কথাটা রেখেছেন। পরে আমি গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি করার সময় একপর্যায়ে আমি ওনার সঙ্গে দেখা করে বললাম যে, স্যার তিন-চার বছর আগে আপনি আমাকে বলেছিলেন যে ব্যবসা করলে আপনার সঙ্গে করার জন্য। আমি এসেছি। উনি আমাকে স্বাগত জানান এবং ব্যবসায়ের জন্য সুযোগ তৈরি করে দেন। ওভাবেই আসলে আমাদের শুরু। আমরা প্রথমে ঢাকার গ্রিন রোড়ে ছোট্ট একটা গার্মেন্ট ফ্যাক্টরি করি। একদমই ভাড়া বাসা, পুরোনো মেশিন। কিছুই নেই, শুধু ফ্লোর আছে, ২২-২৩টা মেশিন দিয়ে যাত্রা শুরু।

একটা কাস্টমার ছিল তিনি বললেন যে, তুমি যদি ফ্যাক্টরি করো আমি তোমাকে কাজ দেব। তিনি কাজ দিলেন। ‘৯৬ সালের কথা। কারণ আমার তো কোনো পুঁজি ছিল না। তবে বুকে সাহস হচ্ছে আমার সবচেয়ে বড় পুঁজি। ভরসা, নিজের প্রতি বিশ্বাস এবং সিনসিয়ারিটি।


জলিল ভাই প্রায়ই বলতেন, আমি বড় লোকদের টাকা দেব না। তেলা মাথায় তেল দেব না। গরিব মানুষকে টাকা দেব। দোকানদারকে টাকা দেব। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের দেব। তখন বুদ্ধি এলো, একটা দোকানকে লোন দেব পাশের দোকান যদি গ্যারান্টি দেয়। তাইলে আমি তাকে এক লাখ, ‍দুই লাখ টাকা দেব।

আমিও অন্য কোনো দিকে তাকাইনি। কারণ, আমি যে ব্যবসাটা করেছি সেটাই করেছি। যখন যা করেছি সিনসিয়ারলি করেছি। পরে গ্রিন রোড়ে আমাদের দুটো ফ্যাক্টরি হয়। এরপর আমি আশুলিয়ার দিকে শিফট করি। আশুলিয়ায় আমরা নিজেরা জমি কিনি। আস্তে আস্তে ফ্যাক্টরি বিল্ডিং শুরু করি। ব্যবসায়িক জীবনে আমি ব্যাংকারদের সহযোগিতা পেয়েছি। আমাদের ব্যাংকাররা সহযোগিতা করেছেন। তারা আমাকে একটি আস্থায় নিয়েছেন। বিশেষ করে ম্যানেজমেন্টে যারা ছিলেন তাদের কাছ থেকে সহযোগিতা পেয়েছি। আমি যেহেতু ব্যাংকিংয়ে কিছুদিন কাজ করেছি সেটাও আমাকে কিছুটা সাহায্য করেছে। এ ছাড়া আমি অর্থনীতি ও ব্যবস্থাপনা নিয়ে পড়াশোনা করেছি, এগুলো আমাকে সাহায্য করেছে। এর মধ্য দিয়ে আশুলিয়াতে আমাদের মাঝারি সাইজের দুটো ফ্যাক্টরি আছে। এর বাইরে আমরা ভার্টিক্যাল সেট-আপ তৈরি করেছি। টেক্সটাইল মিল আছে আমাদের। সেটাতে এখন মাসে প্রায় ২০ লাখ গজ কাপড় উৎপাদন করতে পারি। ইটস আ কম্পোজিট (কটন) ফ্যাক্টরি এবং ওভেন (সুতা) টেক্সটাইল মিল। মোটামুটি আমরা রেডিমেট গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে ভার্টিকেল লাইফ শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আমাদের কাছে আছে। সাড়ে তিন থেকে চার হাজারের মতো কর্মী আমাদের সঙ্গে কাজ করছেন। আমাদের ফ্যাক্টেরিগুলো সবগুলো কমপ্লায়েন্ট (কম জ্বালানি দিয়ে উৎপাদনকারী) এবং মোস্টলি গ্রিন।

সংবাদপ্রকাশ: রেজা গ্রুপ নিয়ে জানতে চাই?

সাহিদ রেজা: এটাই হচ্ছে রেজা গ্রুপ। কোম্পানিগুলোর আলাদা আলাদ নাম। সব মিলিয়ে আমাদের সাতটা কোম্পানি আছে। এ ছাড়া আমরা নতুন এক্সপানশনে যাচ্ছি। নতুন ডাইভারসিফিকেশনে (বৈচিত্র্য) যাচ্ছি। এর বাইরে ব্যক্তিগতভাবে আমার বিভিন্ন জায়গায় বিনিয়োগ আছে। আর্থিক কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত আছি। ক্রেডিট রেটিং কোম্পানির সঙ্গে রয়েছি, ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত আছি। সংবাদপত্রের সঙ্গে যুক্ত আছি। ইলেকট্রনিক মিডিয়া। একদিকে বিনিয়োগ, আরেক দিকে হলো আমাদের নিজেদের ব্যবসা। নিজেদের ব্যবসা হলো টেক্সটাইল-গার্মেন্টস। এর বাইরে এখন আমরা অন্য ধরনের ব্যবসায় যাওয়ার চেষ্টা করছি। সেটা হচ্ছে আমদানি বিকল্প। অর্থাৎ যে জিনিসগুলো আমদানি করা লাগে সেটার বিকল্প নতুন ফ্যাক্টরি করার জন্য চিন্তা করছি। আমরা নতুন প্রজেক্টে যাব।

সংবাদপ্রকাশ: দীর্ঘ সময় আপনি মার্কেন্টাইল ব্যাংকের পরিচালক হিসেবে কাজ করেছেন, মার্কেন্টাইল ব্যাংকের সঙ্গে কখন কীভাবে যুক্ত হলেন?

সাহিদ রেজা: এটা আসলে মজার বিষয়। ব্যাংকিং বলতে বিত্তশালীদের যে বিষয়টা, সেটা আমার কখনোই ছিল না। এখনো নেই। হঠাৎ করেই হয়ে গেছে আরকি। ১৯৯৬ সালে যখন আওয়ামী লীগ সরকার প্রথমবার ক্ষমতায় আসে, তখন আমাদের কিছু জানাশোনা মানুষজন যারা ব্যাংকিংয়ের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তারা হঠাৎ করে চিন্তা করেন যে একটি ব্যাংক তৈরি করবেন। প্রয়াত জননেতা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিল সাহেবের সঙ্গে তারা যোগাযোগ করেন। এই প্রাথমিক যোগাযোগে আমার সঙ্গে হঠাৎ করেই উদ্যোক্তাদের একটা সম্পর্ক হয়ে যায়। তাদের কাছে তথ্য আছে যে, আমি ’৯৩ সালে চাকরি ছেড়ে দিয়ে ব্যবসা করি, বিদেশের সঙ্গে কাজ করি। ওদের ধারণা আমি ভালো ব্যবসা-বাণিজ্য করি। আমার প্রতি তাদের একটা আস্থা ছিল। যার ফলে তারা মনে করল, আমাকেও সঙ্গে নেওয়া যেতে পারে। এইভাবে জুনিয়র একজন সদস্য হিসেবে আমি তাদের সঙ্গে যুক্ত হই। ৯৯ সালে ব্যাংকটি যাত্রা শুরু করে। ৯৬ থেকে ৯৯ পর্যন্ত জলিল ভাইয়ের সঙ্গে আমার সম্পৃক্ততা গভীর হয়। ব্যাংক করার পরে তিনি আমাকে একটা কনফিডেন্সের জায়গায় আনেন এবং জলিল ভাই আমাকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করলেন। এতে করে আমার ব্যক্তিগত ব্যবসায় যদিও সংকট তৈরি হয়েছে কিন্তু ব্যাংকের জন্য আমি কিছু কাজ করতে পেরেছি। মার্কেন্টাইল ব্যাংকের একজন উদ্যোক্তা হিসেবে তাঁর সঙ্গেই আমি শুরু থেকে ছিলাম এবং আমি ওনার নীতি-আদর্শগুলো ধারণ করার চেষ্টা করি। যতক্ষণ আমি পরিচালক ছিলাম বা ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিলাম, ব্যাংকে আমি তাঁর চিন্তার দিকে পরিচালনার চেষ্টা করি। আমি ব্যাংকের যেকোনো পলিসিগত সিদ্ধান্ত যদি নিতে যাই তখন ভাবতাম যে, জলিল ভাই থাকলে ওনি কীভাবে ভাবতেন। ব্যাংকটি যখন হয় তখন কথা ছিল যে, মূলধনের পরিমাণ হবে ১০ কোটি টাকা। আমরা বিশজন মানুষ। তাদের প্রত্যেকের কাছ থেকে নেওয়া হবে ৫০ লাখ টাকা করে। হঠাৎ করে এটা বেড়ে ২০ কোটি টাকা হয়ে গেল। আমার জন্য এক কোটি টাকা জোগাড় করা বেশ কঠিন ছিল। তখন আমি ওনার কাছে গিয়ে বললাম, ভাই আমি থাকতে পারব না। আপনি অন্য কাউকে নিয়ে নেন। জলিল ভাই আমাকে বললেন, কষ্ট করে হলেও থেকো। এসো, একটা জাতীয় প্রতিষ্ঠান তৈরি করি। মানুষের যেন কাজে লাগে। আমরা একটা ব্যাংক প্রতিষ্ঠান বানাই। থাকো কষ্ট করে। এই যে তিনি আমাকে ছোট্ট কথা বলেন, সেটা আমার জন্য অনেক অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করে। যে নিজেকে জাতীয় প্রতিষ্ঠানের অংশ হিসেবে চিন্তা করা। আমরা সবসময় জলিল ভাইকে নিয়ে এ জিনিসটা চিন্তা করতাম। মার্কেন্টাইল ব্যাংকের অনেকগুলো ইনিশিয়েটিভ (উদ্যোগ) আছে, আজকে যে লোন নেওয়ার বা দেওয়ার যে নীতিমালা আছে, এগুলো মার্কেন্টাইল ব্যাংক থেকে অনেকগুলো শুরু হয়েছে। জলিল সাহেব মানুষের জন্য চিন্তা করতেন। গতানুগতিক বা কনভেনশনাল চিন্তা তিনি করতেন না। জলিল ভাই প্রায়ই বলতেন, আমি বড় লোকদের টাকা দেব না। তেলা মাথায় তেল দেব না। গরিব মানুষকে টাকা দেব। দোকানদারকে টাকা দেব। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের দেব। তখন বুদ্ধি এলো, একটা দোকানকে লোক দেব পাশের দোকান যদি গ্যারান্টি দেয়। তাইলে আমি তাকে এক লাখ, ‍দুই লাখ টাকা দেব। তারপরে তো অনেক ফর্ম চেঞ্জ হয়েছে। এখন সব ব্যাংকেরই এই প্যাটার্নগুলো আছে। জলিল ভাই এমন একটা নেতা ছিলেন, তিনি রেলগাড়ির মতো সবাইকে টেনে নিয়ে যেতেন। মার্কেন্টাইল ব্যাংকের যেকোনো শাখা যখন উদ্বোধন হয় ৮-১০ জন পরিচালক উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকেন। উনি চেয়ারম্যান হিসেবে সবাইকে বলতেন যে, এই চলো সবাই যাই। একবার একটা শাখা ওপেন করে ফিরে আসছিলাম, পদ্মা নদীর ওপর দিয়ে। উনিসহ ফেরিতে চেয়ার নিয়ে আমরা বসছি। তখন তিনি হঠাৎ করে আমাকে বললেন, এই যে একদম পান দোকান করে, তাকে একটা লোন দেওয়া যায় কিনা ৫০ হাজার টাকার। প্রত্যেকটা শাখা থেকে দেব। যদি টাকা না আসে না আসুক, মাফ করে দেব। এই যে চিন্তাটা ওনার মধ্যে কাজ করছিল। বা কেউ যদি আসে যে একটা পান দোকান করব তাকে একটা লোন দেওয়া যায় কি না। গ্যারান্টি লাগবে না। শুধু পরিচয়টা দিয়ে আসুক। তিন বছরে সে একদম কম রেটে সুদ দেবে আমাদের। 

একবার ব্যক্তিগত একটা কাজে আমরা লন্ডনে গেলাম। সেখানে তিনি হঠাৎ করে আমাকে বললেন, এ দেশে মৌলবাদী শক্তি একটা গ্রুপের মতো আছে। তারা তাদের চিন্তাচেতনার ছেলেমেয়েদের বিদেশে পড়ানোর জন্য সাহায্য করে। আমরা কেন পারি না মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তি যারা আছেন। আমি সেখানে বললাম যে, ঠিক আছে ভাই। এবার দেশে গিয়ে যারা বিদেশে পড়াশোনা করবে তাদের জন্য লোন চালু করব। তখন সিদ্ধান্ত নিলাম যে, কেউ বিদেশে যদি পড়তে চায় তাহলে আমরা বিশ লাখ টাকা লোন দেব। তখন সুদের হার ছিল ১৩-১৪ শতাংশ। আমরা বললাম, এটা হবে ৬ শতাংশ। শুধুমাত্র মুদ্রাস্ফীতিটাকে মিট করার জন্য যা লাগে। সেটা সে যত দিন পড়াশোনা করবে তত দিন ফেরত দেবে না। পড়াশোনা শেষ করে দুই তিন বছর যা লাগে, সে তার টাকা ফেরত দেবে। এরপরে ধরেন যে, প্রবাসীদের চাকরি দেওয়ার জন্য যে ঋণটা, যেগুলো পরে বিভিন্ন ব্যাংক চালু করেছে। চিন্তার জায়গাটা জলিল ভাইয়ের ছিল। যে লোকগুলো ঘরবাড়ি বিক্রি করে বিদেশে চাকরি করতে যান, এই লোকগুলোকে প্রাতিষ্ঠানিক ঋণের মধ্যে আনা যায় কি না। এখনো এগুলো আছে। কিন্তু এগুলো ঠিক কার্যকর হয়ে ওঠে না। কারণ, এর জন্য যেসব কাগজপত্র বা ডকুমেন্টর দরকার হয়, তারা সেগুলো করে উঠতে পারে না বা হয়ে ওঠে না। এই সংকটটার জন্য এগুলো আটকা পড়ে যায়। তো, আমরা সব সময় যেটা চিন্তা করি, মার্কেন্টাইল ব্যাংক শুধু ব্যাংক না, আরও কিছু। জাতীয় দায়িত্ব চিন্তা করতে হবে, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কথা চিন্তা করতে হবে। ওই চিন্তাটা কিন্তু আমাদের এখনো আছে। শুধু মুনাফার জন্য আমরা এই ব্যাংক পরিচালনা করছি না। 


আমি যে জায়গা থেকে উঠে আসছি সেটাকে আমি আমার মূল জায়গা মনে করি। সেই জায়গাটাকে আলোকিত করা, মানুষের জন্য কিছু কাজ করা। যেটা আমার স্থায়ী ঠিকানা তাদের জন্য কিছু করা। ওই ধারণা থেকে আমি সামাজিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হয়েছি এখনো আছি। সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হয়েছি। আমার ধ্যানজ্ঞান ব্যবসা আর আমার এলাকার মানুষের জন্য কিছু করা। এর মধ্যে পাওয়ার কোনো কিছুর চিন্তা নেই। 

সংবাদপ্রকাশ: আমরা জানি আপনি আপনার এলাকার বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত, এ বিষয়ে একটু বলবেন?

সাহিদ রেজা: আমি খুব সাধারণ চাকরিজীবী একটা পরিবার থেকে উঠে এসেছি। ১৯৭৭ সালে আমি আমার গ্রামে ফেনীর ধলিয়াতে যাতায়াত শুরু করি। আমার বাবা সরকারি চাকরি থেকে ৮০ সালে অবসরে যান। পৈতৃক সূত্রে প্রাপ্ত ঘর ছাড়া আর কিছু ছিল না। আমি চলে ‍যাই চট্টগ্রামে। ওখান থেকে মেট্রিক পাস করেছি। তখন থেকে গ্রামমুখী একটা প্রবণতা দেখা দেয়। সে সময় গ্রামে লাইব্রেরি করতাম, খেলাধুলার জন্য ক্লাব করতাম। সেগুলোকে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় নিয়ে যাওয়া। তারপরে ৯৩ সালের পরে যখন আমি ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু করলাম। ১৯৯৬ সালে আমার গ্রামের পাশের একটা স্কুল থেকে প্রস্তাব পেলাম যে, স্কুলটা খুব জীর্ণ-শীর্ণ অবস্থায় আছে। মুক্তিযুদ্ধের পর গরীব মানুষের মুষ্ঠি মুষ্ঠি চাল দিয়ে তৈরি হয়েছে। ধনী মানুষের কেনোরকম অনুদান নেই। যার ফলে ঠিক এগোতে পারছে না। আমি যেহেতু আমার এলাকার সামাজিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম, তাই তারা আমাকে বলল যে, আপনি এই স্কুলটার সভাপতি হন। আমারও তখন আগ্রহ তৈরি হলো যে দেখি এটাকে কী করা যায়। তো আমি সভাপতি হলাম। ওই স্কুলে তখন প্রথম কাজ হলো নতুন একটা ঘর তৈরি করা। শুরু করলাম ১৫ ফুট লম্বা, পাশে ত্রিশ ফুট, তিন হাজার সাড়ে তিন হাজার স্কয়ার ফুট একটা নতুন ঘর। তখন আমার মা একটু আপত্তি করলেন যে তুমি সবেমাত্র ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু করেছ, এখনি তুমি যদি দান-খয়রাত শুরু কর তাহলে তুমি তো ভালো করতে পারবে না। আমি মাকে বললাম, মা, আমার অনেক কিছু করার পরিকল্পনা আছে। আমি ব্যবসাও করব, সমাজের কাজও করব। তখন মা বললেন যে, আমি জানি, মানুষ শেষ বয়সে এসে গ্রামের মানুষের জন্য কল্যাণ করে। তোমার তো টাকাপয়সাই নেই, তুমি কী করবে? আমি বললাম, আমি রোজগার করব, সেই রোজগারের টাকা থেকে কিছু আমি মানুষের কাজে লাগাব। সেই স্কুলটা আমি করলাম, এটার সঙ্গে আমার এখনো সম্পৃক্ততা আছে। স্কুলটা এখন অনেক ভালো হয়েছে। সরকারের কাছ থেকে নতুন বিল্ডিং পেয়েছে। অনেক ছাত্র-ছাত্রী হয়েছে। এরপর আমি এলাকায় অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হই, এখনো আছি। গ্রামে আমি মেয়েদের জন্য একটা স্কুল তৈরি করি। ওই স্কুলটাও এখন চলছে। এ কাজগুলো আবেগ এবং ভালোবাসার জায়গা থেকে। আমি যে জায়গা থেকে উঠে আসছি সেটাকে আমি আমার মূল জায়গা মনে করি। সেই জায়গাটাকে আলোকিত করা, মানুষের জন্য কিছু কাজ করা। যেটা আমার স্থায়ী ঠিকানা তাদের জন্য কিছু করা। ওই ধারণা থেকে আমি সামাজিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হয়েছি এখনো আছি। সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হয়েছি। আমার ধ্যানজ্ঞান ব্যবসা আর আমার এলাকার মানুষের জন্য কিছু করা। এর মধ্যে পাওয়ার কোনো কিছুর চিন্তা নেই। 

সংবাদপ্রকাশ: নতুন উদ্যোক্তাদের নিয়ে আপনার পরামর্শ কী থাকবে?

সাহিদ রেজা: আমি নিজেকে সব সময় উদ্যোক্তা মনে করি। উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য প্রথমে আমি যেটা মনে করি, সেটা হচ্ছে বুকে সাহস থাকতে হবে, স্বপ্ন থাকতে হবে। মানুষ তত বড়ই হয়, যত বড় তার স্বপ্ন। কখনো কখনো স্বপ্নকেও মানুষ অতিক্রম করে যায়। সুতরাং স্বপ্ন দেখতে হবে। উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য স্বপ্ন দেখতে হবে আর পরিশ্রম করতে হবে। যেমন আমি ঘুম থেকে ওঠার পরে কাজের ক্ষেত্র ছাড়া দ্বিতীয় কোনো চিন্তা করি না। হয়তো গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি বা অফিসে। আমি যে কোম্পানিতে চাকরি করেছি, সেখানেও আমি নির্দিষ্ট সময়ে অফিসে চলে যেতাম। এমন অনেক সময় ঘটেছে যে, অফিসে পিয়ন বা ক্লিনারের আগে আমি অফিসে চলে এসেছি। এই যে কঠোর পরিশ্রমের মানসিকতা, এটা খুবই জরুরি বিষয়। পাশাপাশি নিয়মানুবার্তিতা ও সততা খুবই জরুরি। আপনাকে জোর দিয়ে বলতে পারি, আমার ব্যবসায়িক জীবনে আমার কাছে কেউ একটা টাকাও পাবে না। আমি ব্যাংক থেকে ধার নিয়ে, সুদ মাফ চাইনি। কর্মসংস্থান তৈরি করেছি, কাউকে ক্ষতিগ্রস্ত করিনি। এবং মিতব্যয়িতাও একজন উদ্যোক্তার জন্য অনেক জরুরি। আমার যা কিছু আছে, তা আমি খরচ করি এবং বাকি যা থাকে তা আমি সমাজের জন্য কাজে খরচ করি। যে আমার কাছে কোনো সহযোগিতা চায় আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করি তাকে সহযোগিতা করার জন্য। কর্মসংস্থান তৈরির একটা স্বপ্ন আমার মধ্যেও কাজ করছে। যেকোনো উদ্যোক্তার জন্য এগুলো বেশ জরুরি। আমার সবচেয়ে ভালো লাগে, যখন ফ্যাক্টরি থেকে আমার পণ্যের ট্রাক বের হয়ে যায়। তখন আমার খুব আনন্দের সময়। আমার চমৎকার ঘুম আসে, যেদিন ফ্যাক্টরিতে আমি বেতন দিই। উদ্যোক্তার এই চিন্তাগুলো থাকা দরকার যে কারো ক্ষতি করা যাবে না। নিয়মানুবার্তিতা এবং কঠোর পরিশ্রম করে যেতে হবে। টাকা কোনো সমস্যা না, ভালো চিন্তা থাকলে টাকা আসবে। অনেকে আপনাকে সাহায্য করবে। আমি এমন অনেকজনের কাছ থেকে সাহায্য পেয়েছি, যেটা আমি চিন্তাও করতে পারিনি। আমি তো সাধারণ জায়গা থেকে এসেছি। আমার পরিবারের কেউ তো আমাকে সহযোগিতা করেনি। তাদের ক্ষমতাই নেই, কারণ সবাই চাকরিজীবী। কর্মক্ষেত্রে যারা আমাকে সহযোগিতা করেছে, এরাই আমার আত্মীয়, এরাই আমাকে সাহায্য করেছে। এদের সাহায্যের মধ্য দিয়ে আমি আজকে আমার জায়গায় এসেছি।

সংবাদপ্রকাশ: নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টিতে কী কী করা যায়?

সাহিদ রেজা: এখন সরকার উদ্যোক্তাবান্ধব। আমাদের দেশের অর্থনৈতিক কাঠামোই বেসরকারি খাতকে উৎসাহিত করা হয়। নিজে যদি এগিয়ে আসতে পারেন, তাহলে খুব একটা সমস্যা নেই। নতুন, মাঝারি এবং পুরোনো উদ্যোক্তাদের জন্য অনেক ধরনের সুযোগ-সুবিধা রয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে। সুতরাং আপনার এখন নতুন ফান্ড দিতে, এই করতে হবে, ওই করতে হবে এ রকম কোনো দাবিদাওয়ার কিছু নেই। সব আছে, আপনি আসতে হবে শুধু। আগে মানুষ গল্প করত যে, মানুষ ব্যাংকে যেতে যেতে জুতোর তলা শেষ হয়ে যেত, এখন ব্যাংক আপনার কাছে যাচ্ছে যদি আপনার কাছে নতুন কোনো চিন্তা বা পরিকল্পনা থাকে। আপনি শুধু চিন্তাটা নিয়ে যান। এক্সেসটা সহজ হয়ে গেছে মানুষের কাছে। বাংলাদেশে ৬১ সরকারি বা বেসরকারি ব্যাংক আছে। তার মধ্যে ৩১টা প্রাইভেট ব্যাংক আছে। শত শত শাখা আছে। লাখ লাখ কর্মকর্তা আছে। আপনি যেকোনো একজনের কাছে শেয়ার করলে দেখবেন আপনি আপনার সমাধান পেয়ে গেছেন। আমাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তো অনেক পলিসি আছে। ওই জায়গাটা থেকে আমরা সরে আসছি যে, সরকারের দিক থেকে নতুন উদ্যোক্তার জন্য কী করতে হবে। কোনো দাবির কিছু নেই।

সংবাদপ্রকাশ: এমন একটি অভিযোগ আছে যে, ব্যবসায়ীদের জন্য সব সুবিধা।

সাহিদ রেজা: এটা আসলে একদিক থেকে ঠিক আছে। কারণ, ব্যবসায়ীকে যদি সাপোর্ট করা হয়, তবে কর্মসংস্থান বাড়বে, বিনিয়োগ বাড়বে, দেশ এগিয়ে যাবে। সুতরাং নতুন উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য কমিটমেন্ট ও সিনসিয়ারিটি দরকার। ব্যাংকের টাকা ফেরত দেওয়ার জন্য আপনি সিনসিয়ার কি না এবং আপনি ব্যবসাটা বোঝেন কি না? এটা খুব জরুরি। না বুঝে শুরু করে দিলে তাহলে আপনি চালিয়ে নিতে পারবেন না।

ধরেন, আমরা যখন রেডিমেড গার্মেন্টস শুরু করি তখন কমপ্লায়েন্স ছিল না। এখন একটা গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি করতে হলে কমপ্লায়েন্সটা মাথায় নিয়ে শুরু করতে হবে। তাহলে আপনাকে তো সেই প্রস্তুতি নিয়ে আসতে হবে। আপনাকে কমপ্লায়েন্সটা বুঝতে হবে। না বুঝে আপনি যদি ব্যবসা শুরু করেন, গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রি, তাহলে ফেল করবেন, চলবে না। আপনাকে অর্ডারই দেবে না। বিজনেসটা আগে বুঝতে এবং কাজটা বুঝতে হবে। ভালোবাসাটা তৈরি করতে হবে, তাহলে আপনি সফল হবেন।

কথাপ্রকাশ বিভাগের আরো খবর

Link copied!