বাংলা গানের কিংবদন্তি সুরকার শহীদ আলতাফ মাহমুদ। ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি’ গানটির সুর করেছেন এই সুরকার। মুক্তিযুদ্ধে আলতাফ মাহমুদের অবদান অসামান্য। ১৯৭১ সালের ৩০ আগস্ট পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তাঁকে ঢাকার আউটার সার্কুলার রোডের বাসা থেকে ধরে নিয়ে যায়। পরবর্তীকালে তাঁকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে সংবাদ প্রকাশের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বাবার স্মৃতিচারণ করেন তাঁর কন্যা শাওন মাহমুদ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রুমি প্রভা।
সংবাদ প্রকাশ : আপনি শহীদ বুদ্ধিজীবীর সন্তান। আপনার বাবা কালজয়ী সুরকার। এটা কীভাবে অনুভব করেন?
শাওন মাহমুদ : মানুষের সঙ্গে মিশে বাবাকে আমি সবচেয়ে বেশি অনুভব করার চেষ্টা করি। একটা সময় ছিল যখন বাবাকে শুধু একুশের গানের সুরকার হিসেবে একটা বাক্সবন্দী অবস্থায় রাখা হয়েছিল। শুধুই বুদ্ধিজীবী বলা হতো। এখন বিষয়টা শুধু সেখানে না থেকে অনেক দূর এগিয়েছে। ১৯৫২—১৯৭২ সাল পর্যন্ত যতটুকু তথ্য পেয়েছি, আমি সবাইকে জানাতে চেষ্টা করেছি। আমার মনে হয়েছে, মানুষটা আসলে ধূমকেতুর মতো এসেছিলেন। অসম্ভব রকমের ভালো লাগা কাজ করে যে, আমি তেমনই একটি মানুষের রক্ত বয়ে বেড়াচ্ছি, যে কিনা মুক্তিযুদ্ধ ও ভাষা আন্দোলন দুটোতেই তাঁর নিজস্ব একটা অংশ রেখে গেছেন।
একটা জায়গায় ঐশ্বরিক জায়গা থেকে তাঁর সুর সৃষ্টি করে গেছেন। আরেকটা জায়গায় তাঁর শরীরকে বিসর্জন দিয়ে গেছেন।
সংবাদ প্রকাশ : সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলনের যে নির্দেশনা উচ্চ আদালত দিয়েছেন, তা কতখানি বাস্তবায়িত হচ্ছে বলে মনে করেন?
শাওন মাহমুদ : সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলনটা তো ভাষা আন্দোলনের পর থেকেই চালু হওয়ার কথা। কারণ, আন্দোলনটা মফস্বল, বন্দর সবখানে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা। বিভিন্ন জেলায়, মহকুমায় র্উদু ভাষায় যে সাইনবোর্ড লেখা হয়েছিল, সেটা নামিয়ে বাংলা ভাষায় লেখা হয়েছিল। প্রতিবাদটা কোন পর্যায় ছিল, সেটা বোঝা যায়। সুতরাং যতই আইন করেন না কেন, তৃণমূলে কাজ করতে হবে। না হলে এসব সমস্যা থেকেই যাবে।
সংবাদ প্রকাশ : একুশে ফেব্রুয়ারি ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’। তবে দিনটি বাংলাদেশের মানুষের কাছে প্রধানত ‘ভাষা শহীদ দিবস’। একটি নামের কারণে অন্য নামটি কি ম্লান হয়ে যাচ্ছে না?
শাওন মাহমুদ : আমরা আসলে দিবসভিত্তিক হয়ে গেছি। আমাদের সময়ে দিবস বলে কিছু ছিল না। সবকিছু মাসভিত্তিক ছিল। বিজয়ের মাস, স্বাধীনতার মাস, ভাষার মাস এ রকম ছিল। এখন আসলে আমরা দিবসভিত্তিক করপোরেট একটা চক্রের মধ্যে পড়ে গেছি। এই বিষয়গুলো একটা নীতিমালার ভেতর থেকে আসতে হবে। রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিকভাবে আসতে হবে। তবে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হওয়ার পর মনে হয়েছে যে, তাদের কাছে আর কিছু না হোক একুশের যে আন্দোলন, আমরা যে আমাদের ভাষার জন্য লড়েছি—এই বার্তাটা পৌঁছাচ্ছে। তাই কোনোটাকেই আমি নেতিবাচকভাবে দেখি না।
সংবাদ প্রকাশ : দেশে বিভিন্ন মাধ্যমে, বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাষার যে বিকৃতি ঘটছে, সেটা আপনি কীভাবে দেখেন?
শাওন মাহমুদ : আমি মনে করি মিডিয়া যেকোনো দেশের জন্য সবচেয়ে শক্তিশালী একটি মাধ্যম। যারা মিডিয়ায় নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে রয়েছেন, তাদেরও কিছু দায়িত্ব রয়ে যায় যে, কোনটা প্রচার করব আর কোনটা করব না। এটি গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলোকেই দেখতে হবে। তবে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ইংরেজিও একটা ভাষা। আমি ইংরেজিকে বিকৃত করছি না। কিন্তু আমি আমার ভাষাকে বিকৃত করছি, সেটা মেনে নেওয়া যায় না। সেটাই আমাদের খেয়াল রাখা উচিত।
সংবাদ প্রকাশ : বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে দেশের অন্যান্য ক্ষুদ্র জাতিসত্তার জনগোষ্ঠীর ওপর বাংলা ভাষা আধিপত্যবাদী হয়ে উঠছে কি না? বিশেষ করে আদিবাসীদের মাতৃভাষা রক্ষায় বাংলাভাষীদের দায় কী?
শাওন মাহমুদ : আমার মনে হয়, আমি নিজেকে দিয়ে যেটা বুঝেছি, যে আদিবাসী শিক্ষিত হয়ে আসছেন, তাদেরই দায়িত্ব নিতে হবে। তাদের নিজেদের ভাষাটা নিজেদেরই রক্ষা করতে হবে।
সংবাদ প্রকাশ : ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’ গানটা নিয়ে কিছু বলবেন?
শাওন মাহমুদ : এই গান সাংবাদিক ও লেখক আবদুল গাফ্ফার চাচা ১৯৫২ সালের রচনা করেন। প্রথমে আবদুল লতিফ চাচা সুরারোপ করেন। ১৯৫৩ সালে বাবা দ্বিতীয়বার সুরারোপ করেন। পরবর্তী সময়ে ১৯৫৪ সালের প্রভাতফেরিতে প্রথম গাওয়া হয়। তবে মজার এবং বিস্ময়কর ব্যাপার জেনেছি সেটি হলো, গানটি যখন লেখা হয়, তখন ১৯৫২ গাফ্ফার চাচার বয়স ছিল ২১ বছর, আর যখন সুর করা হয় বাবার বয়সও ছিল ২১ বছর। গানটি গাওয়া হয়েছিল ২১ ফেব্রুয়ারিতে। এটি আমার কাছে খুব আশ্চর্য মনে হয়। আসলে তারুণ্যের জয় সব সময় হয়েছে। তরুণরাই আমাদের আগামীর পথ দেখাবে, দেখিয়ে এসেছে। তারুণ্যের জয় হোক।