রকিবুল হাসান ব্যাট হাতে বার বার জ্বলে ওঠা সত্ত্বেও বাঙালি ক্রিকেটার বলে অবহেলা করে দূরে সরিয়ে রাখা হয়েছিল তাকে। কিন্তু আন্তর্জাতিক একাদশের বিরুদ্ধে সেই ঐতিহাসিক টেস্টের আগের মৌসুমে তিন তিনটি দর্শনীয় শত রান করে নিজের টেস্ট খেলার দাবি জোরালো করেন তিনি। এমন ঈর্ষনীয় পারফরম্যান্সে একমাত্র বাঙালি ক্রিকেটার হিসেবে টেস্ট দলে ওপেনার হিসেবে খেলার সুযোগ আদায় করে নেন রকিবুল। তবে উচ্ছ্বসিত ছেলেটির স্বপ্নভঙ্গ হলো ম্যাচের আগের দিন।
দেখা গেল, পাকিস্তান দলের সব খেলোয়াড়দের দেওয়া হয়েছে ‘গ্রে নিকোলস’ ব্র্যান্ডের ব্যাট; যার ওপরে আইয়ুব খানের নির্বাচনী প্রতীক তলোয়ার চিহ্ন লাগানো! কিন্তু রকিবুলের মাথায় ঘুরছিল অন্য কিছু। ম্যাচের আগের দিনই বঙ্গবন্ধুর ছেলে শেখ কামালের সঙ্গে তার আলাপ হয়। নানা ভাবনা-চিন্তার পর অবশেষে আসল সেই ঐতিহাসিক মুহূর্ত ১৯৭১ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি।
ভয়াল কালরাত্রির ঠিক এক মাস আগে। মাঠে পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ড একাদশের হয়ে একমাত্র বাঙালি ক্রিকেটার হিসেবে আন্তর্জাতিক একাদশের বিরুদ্ধে সেই টেস্টে আজমত রানার সঙ্গে ইনিংস ওপেন করতে নামেন তারুণ্যে উদ্দীপ্ত রকিবুল। সব ভয়ভীতি উপেক্ষা করে তার গান অ্যান্ড মুরের ব্যাটে ‘জয় বাংলা’ স্টিকার লাগিয়ে খেলতে নেমে তাক লাগিয়ে দিলেন সবাইকে।
ব্যাপারটি খেয়াল করলেন একজন আলোকচিত্রী। ছুটে এলেন ছবি তুলতে। খানিকপরই স্টেডিয়ামজুড়ে খবর ছড়িয়ে পড়ল ‘জয় বাংলা’ স্টিকার নিয়ে পাকিস্তানের হয়ে খেলছে একটি বাঙালি ছেলে। স্টেডিয়ামে থাকা প্রায় ১৫ হাজার দর্শক স্লোগান তুলল ‘জয় বাংলা’। পরদিন দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সব গণমাধ্যমে এলো সেই ছেলেটির ছবি।
ব্যাটে জয় বাংলা স্টিকার ব্যবহার করে কেবল যে প্রশংসা কুড়িয়েছেন তা নয়, নির্যাতিতও হতে হয়েছিল রকিবুলকে। ‘জয় বাংলা’ স্টিকার লাগানোর কারণে টিম ম্যানেজার শোকজ করেছিল তাকে। কঠিন জেরা করে জানতে চেয়েছিল জয় বাংলার মানেটা কি? পরে দেশদ্রোহী ঘোষণা করা হয় তাকে। এক সময় হামলা চালানো হয় তার বাসায়, করা হয় লুটপাটও।
সেই ব্যাট এখন উত্তরসূরি দামাল ছেলেদের হাতে। রকিবুলের স্বপ্ন ছিল এমনই। তবে স্বাধীনতার আগে পাকিস্তানিদের কাছে যে বৈষম্যের শিকার হয়েছিলেন, সেটি মনে পড়লে আজও সিংহমূর্তি হয়ে ওঠেন ৭৪ বছর বয়সী এই সাবেক ক্রিকেটার।
রকিবুলের স্মৃতিকথায় সেই সময়
২৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭১। সেই সময় কোনো দল পাকিস্তান সফরে এলে ঢাকাতে সব সময়ই একটা টেস্ট হতো। করাচিতে হতো, লাহোরে হতো, ঢাকাতেও হতো। এটা একটা অনানুষ্ঠানিক টেস্ট ম্যাচ ছিল। পাকিস্তানের সঙ্গে কমনওয়েলথ একাদশের খেলা। আমার তখন ১৮ বছর বয়স। ঢাকা টেস্টের ওই দলে সুযোগ পেলাম আমি। দ্বাদশ খেলোয়াড় ছিলেন আমাদের তানভীর মাজহার তান্না।
আমরা পূর্বানী হোটেলে ছিলাম। তখন কিন্তু রাজনৈতিক অঙ্গনে একটা উত্তাপ টের পাওয়া যাচ্ছিল। নির্বাচন হয়ে গেছে। তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করবে। একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছিল আওয়ামী লীগ। আমরাও খুব উৎসাহিত, উজ্জীবিত ছিলাম।
বয়স কম হলেও আমাদের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা ছিল। সবার মধ্যে রোমাঞ্চ খেলা করছিল। সবার মধ্যেই একটা ব্যাপার ছিল, এই প্রথমবারের মতো পাকিস্তানের প্রশাসনে, রাষ্ট্রীয় প্রশাসনে যেতে চলেছি আমরা। তো ওই সময়ে কিন্তু একটা টালবাহানা চলছিল যে, আদৌ বাংলাদেশকে ক্ষমতায় যেতে দেবে কি দেবে না। ইলেকশন জেতার পরও আমরা দেখতে পেলাম যে ছয় দফার ভিত্তিতে বঙ্গবন্ধু নির্বাচন করেছিল, যেটা ছিল আমাদের জনগণের ম্যান্ডেট সেটাকে মানতে রাজি না জুলফিকার আলী ভুট্টোরা।
এই প্রেক্ষাপটের মধ্যেই ম্যাচটি আসে। আমরা নিজেরাও খুব সচেতন ছিলাম। যখন পাকিস্তান টিম নিয়ে হোটেলে উঠে গেলাম, তখন আমাদের সব সরঞ্জাম দেওয়া হলো। হঠাৎ দেখি ম্যাচের আগের দিন পাকিস্তানের খেলোয়াড়ের ব্যাটে তলোয়ারের স্টিকার ছিল। আমাকে অবশ্য ওই স্টিকারের ব্যাট দেওয়া হয়নি। বিষয়টি হঠাৎ করে আমার মনকে অন্যরকমভাবে নাড়া দিল। ভাবলাম, ব্যাপারটা কী?
তখন পূর্বানী হোটেলে এটা দেখার পর আমি সিদ্ধান্ত নিলাম আমার ব্যাটেও স্টিকার লাগাব, তবে সেটা জয় বাংলার। তখন বাংলাদেশে গাড়িতে, দরজায় লাগানোর জন্য তিনকোণা একটা স্টিকার বের হয়। সেই স্টিকারটায় ছিল পূর্ব পাকিস্তানের মানচিত্র; লাল-সবুজের মধ্যে হলুদ আর ওপরে ‘জয় বাংলা’ লেখা।
আমি মনে করলাম, ওই তলোয়ার হলো জুলফিকার আলী ভুট্টোর নির্বাচনের মার্কা। ওই মার্কা যখন পাকিস্তানের ব্যাটসম্যানদের ব্যাটে গেছে, তো আমিও তখন আমার ব্যাটে জয় বাংলার স্টিকার লাগাব।
সেই সময় হোটেলে সন্ধ্যার দিকে আমার রুমে শেখ কামাল আসল। তাকে বললাম, আমি আমার ব্যাটে স্টিকারটা লাগাতে চাচ্ছি, স্টিকারটা দরকার। কারণ, আমি মনে করেছিলাম এটা সময়ের দাবি। আমরা বাঙালিরা তখন যার যার অবস্থান থেকেই সেই নির্বাচন পূর্ব বা পরবর্তী সময়ে বিভিন্নভাবে আমাদের প্রতিবাদ চালিয়ে যাচ্ছিলাম।
ওদের ব্যাটে ওই মার্কা দেখে আমার কাছে খটকা লাগল। আমার কাছে ওটা ভালো লাগেনি। আমি ভাবলাম, অন্তত আন্তর্জাতিকভাবে এটাকে ফোকাস করার এই সুযোগ। কারণ, এটা তো আন্তর্জাতিক খেলা; দেশে ও দেশের বাইরের পত্রিকায় আসবে। ইংল্যান্ডেও আসবে হয়ত। কামালকে বলি, আমি তো এটা করতে চাচ্ছি। যেমন কথা তেমন কাজ। কামাল সঙ্গে সঙ্গে জালালকে পাঠিয়ে দিল স্টিকার সংগ্রহ করে আনতে।
রাতে কামাল নিজেই স্টিকারটা ব্যাটের উপর লাগাল। সাদা ধবধবে ব্যাট। সেই ব্যাট নিয়েই পরের দিন আমি নামলাম। আমি আর আজমত রানা। আজমতের বড় ভাই সাফাকাত রানা; ও অনেকদিন ধরেই পাকিস্তান দলে খেলেছে। আর আজমতের ছোট ভাই সুলতান রানা; এই এশিয়া কাপে ও এসিসির পক্ষ থেকে টুর্নামেন্ট ডিরেক্টর ছিল। আমার বন্ধু এরা।
ক্রিকেটারদের মধ্যে আসলে তেমন কিছু থাকে না। কিন্তু রাজনীতি যখন সবকিছুর মধ্যে ঢুকে যায়, তখন এগুলো মনকে নাড়া দেয়। আমিও সেই সময় মনে করলাম, এটা আমার প্রতিবাদ। আমি আর আজমত রানা মাঠে নামলাম। মাঠে নামার সেই মুহূর্তের অনুভূতিটা এখনও আমার মনে শিহরণ জাগায়।
তখন তো আর এ সময়ের মতো এত মিডিয়া ছিল না। আর ফটো সাংবাদিকদেরও অত ভালো ক্যামেরা ছিল না। তারা খুব কাছাকাছি থাকত। আমার যদ্দুর মনে পড়ে, তখন ফটো সাংবাদিক ছিলেন রশিদ ভাই। এ ছাড়া আলম ভাই ছিলেন। তারা তখন তরুণ ছিলেন।
আমি আর আজমত মাঠে নামছি; আমার ব্যাটে স্টিকার লাগানো। ফটো সাংবাদিকরা আমাদের একটু দাঁড় করাল। একটু স্লো করিয়ে দিল আমাদের। রশিদ ভাই, আলম ভাইরা ছবি তুললেন।
ব্যাট নিয়ে নামার সময় আমাকে কেন ছবি তুলতে থামানো হল সেটা বুঝতে দর্শকদের মিনিট খানেক সময় লেগেছিল। বুঝতে পারার পর ১২ থেকে ১৫ হাজার দর্শক এক সঙ্গে ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে স্টেডিয়াম প্রকম্পিত করল। আমি যে এখন এই কথাগুলো বলছি, এখনো আমার শিহরণ লাগে। সেই জয় বাংলা ধ্বনি এখনো আমার কানে বাজে। ব্যাটে জয় বাংলা স্টিকার লাগানোর ছবি পরের দিন পত্র-পত্রিকায় বড় আকারে প্রকাশ করা হলো। বড় খবর বের হলো।
মজার ব্যাপার হলো, ওই দিনই দুপুরে লাঞ্চের সময় আমাকে শোকজ করা হল। বার বার শোকজ। পাকিস্তান দলের ম্যানেজার আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘এটা কী?’ আমি বললাম, ‘এটা একটা স্টিকার।’ আবার চুপ। একটু পরে আবার জিজ্ঞেস করল, ‘রকিবুল, এখানে কী লেখা আছে?’ আমি বললাম, ‘এখানে জয় বাংলা লেখা আছে।’
পাকিস্তানের খেলোয়াড়রা তখন মুচকি হাসছিল। সবাই মিলে মজা নিচ্ছিল। আমাকে তখন ও বোঝাতে বলল, জয় বাংলা আসলে কী। আমি তখন ওকে বোঝানোর জন্য বললাম, ‘জয় বাংলা মিনস ইস্ট পাকিস্তান জিন্দাবাদ’। ও বলল, ‘ও আচ্ছা’। আর কিছু বলল না।
পরের দিন সব পত্রিকায় এটা ছাপা হয়। ইংরেজি পত্রিকা, দৈনিক পাকিস্তানে। পরে শুনলাম, ইংল্যান্ডের পত্রিকায়ও এটা ছাপা হয়েছিল। তখন তো একটা গরম আবহ ছিল। একটা পট পরিবর্তন হতে যাচ্ছে। এরকম সময়ে আমি খেলার মধ্যে এমন ঘটনা ঘটিয়ে ফেললাম।
পরে অবশ্য আমাকে এর মূল্যও দিতে হয়েছে। পয়লা মার্চ ছিল ম্যাচের চতুর্থ দিন। সেদিন দুপুরের মধ্যে খবর আসল ৩ মার্চ যে অ্যাসেম্বলি বসার কথা ছিল, সেটা তদানীন্তন পাকিস্তানের সামরিক জান্তা জেনারেল ইয়াহিয়া খান ভুট্টোর পরামর্শে বাতিল করেছেন। এটা শোনার পর মাঠের মধ্যে যেন স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে পড়লো।
রেডিওতে সবাই খেলার ধারা বিবরণী শুনছিল। সেখানেই অ্যাসেম্বলি বাতিলের খবর আসল। চারদিকে প্রতিবাদ শুরু হয়ে গেল। আমাদের মাঠ থেকে ড্রেসিংরুমে নিয়ে এলো। আমাদের বলল, অসুবিধা নেই। অবশ্য নিরাপত্তা ছিল। তবে মানুষ খেপে গিয়েছিল, স্টেডিয়ামে তখন আগুন জ্বলছিল।
আমাদের বলল, ক্যান্টনমেন্ট থেকে সেনাবাহিনীর ট্রাক আসবে। আমাদের সেখানে নিয়ে যাবে। কিন্তু আমি না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। কারণ, মনে হচ্ছিল বোধ হয় শেষ ঘণ্টা বেজে যাবে। সবাই গেল। কিন্তু আমি আর তান্না গেলাম না।
ম্যানেজারকে আমি বোঝালাম যে, হোটেলে গিয়ে আমি সবকিছু নিয়ে আসি। উনি আমাকে বললেন, তুমি তো এভাবে যেতে পার না। কারণ, তুমি পাকিস্তান দলের খেলোয়াড়। যেতে হলে তোমাকে মুচলেকা দিয়ে যেতে হবে।
মুচলেকা দিয়ে আমি ক্রিকেটের পোশাক ছেড়ে সাধারণ পোশাক পরে বের হলাম। আস্তে আস্তে বের হয়ে মানুষের ভিড়ে হারিয়ে গেলাম। কিন্তু পূর্বানী হোটেলে গিয়ে আর ভেতরে ঢুকতে পারছিলাম না। কারণ, সেদিন সেখানে বঙ্গবন্ধুর একটা সভা ছিল। দেশি-বিদেশি সংবাদিকে ভরা হোটেল। আমি হোটেলের পেছন দিক দিয়ে ঢুকলাম। সিঁড়ি দিয়ে সাত তলায় গেলাম।
৪ মার্চ পাকিস্তানের অন্য খেলোয়াড়রা ফিরে গেল। কেউ গেল লাহোরে, কেউ গেল করাচি। সবাই তাদের শহরে চলে গেল। আমি ৬ মার্চ হোটেল ছাড়লাম। আমার পরিবার তখন গ্রামের বাড়ি চলে গেছে। আমি গেলাম ফুলবাড়িয়া রেলওয়ে কোয়ার্টারে আমার খালুর বাড়িতে।
আসলে ব্যাটে স্টিকার লাগানোর কাজটা করেছিলাম একটা চেতনার জায়গা থেকে। বাঙালি চেতনা থেকে। এর জন্য আমার নামে পরোয়ানা জারি হয়েছিল। আমাকে দেশদ্রোহী ঘোষণা করা হয়েছিল। আমার বাড়ি লুট হয়েছে। আমার বিরুদ্ধে দেখামাত্র গুলির নির্দেশ জারি করা হয়েছিল।
এটা আমি পরে জানি। ২৭ মার্চ শহীদ মুশতাককে যখন গুলি করা হয়েছিল, তখন আমি পুরান ঢাকা থেকে তাকে দেখতে গিয়ে এটা শুনি। আমাকে হাতে ধরে ক্রিকেট শেখানো মুশতাককে কবরস্থ করে ফেরার সময় ফুটবলার দীপু ভাই আমাকে বললেন, ‘তুমি এখনও শহরে? ভাগো।’ তিনি বলেছিলেন, তোমাকে তো মেরে ফেলবে। আমি বললাম কেন? উনি বললেন, তুমি ব্যাটে স্টিকার লাগিয়েছিলা বলে তোমাকে মেরে ফেলার নির্দেশ জারি হয়েছে।
আমি দীপু ভাইকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আপনি এই খবর কোথায় পেয়েছেন? উনি বললেন, ‘পাকিস্তানের ফুটবলার ক্যাপ্টেন ইউনুস আমাকে খবর দিয়েছে যে ওর ব্যাটালিয়ান পাকিস্তান থেকে মুভ করছে।’
দীপু ভাই মারা গেছেন। কিন্তু উনি আর ইউনুস আমাকে অনেক বড় উপকার করেছে। এরা জানানোর পরই আমি ঢাকা থেকে পালালাম। আসলে বেঁচে গেলাম।
দুঃখ যে, সেই ব্যাটটা এখন আর নেই আমার কাছে। তবে ওই ছবি এখনও আছে আর্কাইভে।
১৯৬৯ সালে পাকিস্তানের অনূর্ধ্ব-২৫ দল শ্রীলঙ্কা সফরে যাবে। সেই দলের হয়ে ক্যাম্প শুরু হয়েছে করাচিতে। পাকিস্তান ন্যাশনাল স্পোর্টস কাউন্সিল মাঠে টিলার উপরে বসে আমরা ক্রিকেটাররা চা-কফি খাচ্ছিলাম। ক্যাম্পে আরেক বাঙালি ক্রিকেটার সৈয়দ আশরাফুল হক ছিলেন। প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে আড্ডা দিচ্ছিলাম। পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আসা উইকেটরক্ষক-ব্যাটসম্যান কামরান রশিদ নামে তুখোড় এক ক্রিকেটার ছিল। এখন কানাডায় থাকে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র। খুব বড় বড় কথা বলছিল। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে খারাপ একটা কথা বলল। গালি দিয়ে বলল, আইয়ুব খানের উচিত ছিল বঙ্গবন্ধুকে মেরে ফেলা।
ওই কথা শুনে আমার ভেতরে আগুন জ্বলে উঠল। জাম্প করে ঘুষি মেরে টিলা থেকে ফেলে দিয়েছিলাম। আমার উচ্চতা ৫ ফুট ৪ ইঞ্চি, আর রশিদ ৬ ফুট উচ্চতার। পেশোয়ারের বালিখান সাহেবের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক আঁতাত ছিল। তার ভাতিজা মনজুরুল্লাহ আমার সঙ্গে যোগ দিল। দুজন মিলে মেরে রক্তাক্ত করলাম।
পরদিন আমাকে শোকজ করল ক্যাম্প কমানডেন্ট মেজর সুজাউদ্দিন। ট্রায়াল রুমে দুটা চেয়ার, একটা টেবিল। সামনে মেজর সুজাউদ্দিন বসা। আমাকে ডাকলেন। তাকে চিনতাম আগে থেকেই। পাকিস্তান টিমের বাঁহাতি স্পিনার ছিলেন। তো উনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কত বড় শৃঙ্খলা ভঙ্গ করেছ জান?’
ভদ্র্র ভাষাতেই তাকে বললাম, ‘মি. কমানডেন্ট স্যার। কামরান রশিদ আমাকে অমুক কথা বলেছে। আবার যদি সে একথা বলে তাকে আবার মারব।’
ওই কথাতেই উনি চলে গেলে। উনি বুঝে ফেলেন আমার সিংহমূর্তি দেখে। যাওয়ার আগে শুধু বললেন, ‘যাও যাও...।’
মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা ফুটবলের মতো স্বাধীন বাংলা ক্রিকেট দলও গঠিত হয়। তাতে নেতৃত্ব দেন রকিবুল হাসান। এজন্য অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ দল গড়ার জন্য তাকে একটি চিঠি দেন। রকিবুল হাসান স্বাধীন বাংলা ক্রিকেট দল গড়লেন। এ দলে ফুটবলার সালাহউদ্দিনসহ আরো অনেকে যুক্ত হন। বাংলাদেশ ১৬ ডিসেম্বর বিজয় লাভ করে, ক্রিকেট দল আর ভারতের সঙ্গে খেলতে পারেনি।
মুক্তিযুদ্ধের পর আবারও রকিবুল বাংলাদেশ ক্রিকেট দলে যুক্ত হন। দুই বার ছিলেন অধিনায়কও। এখনও তিনি ক্রিকেটের সঙ্গে আছেন। আইসিসি’র ম্যাচ রেফারির দায়িত্ব পালন করছেন। অ্যাপেক্স-বিজয়ফুলসহ বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের সঙ্গেও জড়িত তিনি।