লেখক, গবেষক ও প্রকাশক মফিদুল হক। তিনি মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের একজন প্রতিষ্ঠাতা ট্রাস্টি, জাদুঘরের শিক্ষার্থী প্রকল্পের একজন পরিচালক, প্রকাশনা সংস্থা সাহিত্য প্রকাশের পরিচালক এবং আন্তর্জাতিক থিয়েটার ইনস্টিটিউট-ইউনেস্কো প্রকাশিত দ্বিবার্ষিক সংকলন ‘ওয়ার্ল্ড অব থিয়েটার’–এর অন্যতম সম্পাদক। তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সাংগঠনিকভাবে যুক্ত ছিলেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চে তিনি ঢাকা ত্যাগ করেন কিন্তু ১৪ এপ্রিল ঢাকা ফিরে ছাত্র ইউনিয়ন ও কমিউনিস্ট পার্টির গেরিলা তৎপরতায় সহযোগিতা করা শুরু করেন। সংবাদ প্রকাশের সঙ্গে একান্ত আলাপনে এমন অনেক কিছু উঠে এসেছে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন খাদিজা নিপা।
সংবাদ প্রকাশ : আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি কিন্তু রক্ষা করতে পারছি কি?
মফিদুল হক : মুক্তিযুদ্ধ তো একটা বিশাল অভিজ্ঞতা এবং ভয়ংকর অভিজ্ঞতা। বলা যায় যে অনেক অর্জনের অনেক প্রতিরোধের। গোটা জাতি ঐক্যবদ্ধ হলো বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে এবং বিপুল বাধার বিরুদ্ধে লড়াই করে বাঙালি স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনল। মুক্তিযুদ্ধে এমন কোনো পরিবার ছিল না, যে পরিবার কোনো না কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি কিংবা কোনো না কোনোভাবে অবদান রেখেছে। তো স্বাধীনতার পর একটা বড় বিষয় ছিল এবং তখন মনে হয়েছিল আমরা হয়তো কখনোই এটা ভুলব না। এবং অনেকগুলো দায়দায়িত্ব চলে এসেছে। আর স্বাধীনতার পর যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ এই দায় মোচনের কাজ শুরুও করেছিল। তখন তাকালে বোঝা যায় যারা শহীদ হয়েছেন, তাদের একটা স্বীকৃতি প্রদান তাদের স্মৃতিটার প্রতি সম্মান জানানো জাতীয় স্মৃতিসৌধ তৈরি, বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ তৈরি বিভিন্ন যেখানে যারা সমাধিস্থ হয়েছেন, সেখানে একটা স্মৃতি স্মারক তৈরি। আর যারা এই নিষ্ঠুরতা করেছে, তাদের বিচারের সম্মুখীন করা এবং ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা করা তার সঙ্গে সত্যের প্রতিষ্ঠা করা। ফলে এটা বলা যায় যে যেমন মুক্তিযুদ্ধের বিপুলতা তেমনি বিপুল দায়িত্বও রাষ্ট্র, সমাজ ও মানুষের ওপর পড়েছিল। আর এটা পালনে বঙ্গবন্ধু অনেক উদ্যোগ নিয়েছিলেন। ১০ জানুয়ারি যখন তিনি ফিরে এসেছিলেন, তখন কিন্তু তাঁর ভাষণ খুব আবেগযুক্ত ছিল স্বাভাবিকভাবে খুব আবেগতাড়িত ছিলেন। কিন্তু তাঁর সেই প্রজ্ঞা, দূরদৃষ্টি এবং বলা যায় রাষ্ট্রনায়কত্ব যে অবস্থান, সেটারও কিন্তু প্রকাশ ঘটল। তিনি ভাষণ শেষ করলেন জাতিসংঘের প্রতি আহ্বান জানিয়ে যে আপনারা আসুন, দেখুন তদন্ত করে সেই হত্যাযজ্ঞের বিচারের ব্যবস্থা করুন। কিন্তু জাতিসংঘ তো সেই উদ্যোগে সাড়া দিতে পারেনি। তখন বিশ্বজুড়ে স্নায়ুযুদ্ধে বিভক্ত ছিল। সে রকম পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে যখন প্রথম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো, তারপর যে আইনগুলো গৃহীত হলো, সেখানে ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইম ট্রাইব্যুনাল অ্যাক্ট ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ সেটা গ্রহণ করল। যুদ্ধাপরাধীদের গণহত্যাকারীদের বিচারের জন্য পাকিস্তানের ঘাতকরা ও তাদের দেশীয় সহচররা আর যারা দেশীয় দালাল ছিল তাদের জন্য তো দালাল আইন প্রবর্তিত হয়েছিল। যারা মুক্তিযুদ্ধের বিপুলভাবে নির্যাতিত হয়েছিল যে নারীরা তাদের কিন্তু বীরাঙ্গনা হিসেবে বরণ করা হয়েছিল। যাদের মধ্যে পরিবারে ফিরে যেতে পারেনি বা নানাভাবে পরিত্যক্ত তাদের জন্য আশ্রয়কেন্দ্র তৈরি করা হয়েছিল, সেখানে তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে সমাজে তাদের আবার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা। এসব কিছু পাল্টে গেল পঁচাত্তরের বঙ্গবন্ধুর হত্যার পরে। একটা বিশাল সময় কাটল, একটা অন্ধকার নেমে এলো। সরকারিভাবে ইতিহাসের বিকৃতি ঘটতে লাগল, ফলে একটা বিশাল দায়িত্ব যেটা ছিল রাষ্ট্রের, সরকারের, সেটা তো উল্টো পথে যাত্রা শুরু করল। তবে সমাজ কিন্তু এই স্মৃতিকে জাগ্রত করে রাখল। অনেক রকম বই লেখা হয়েছে, স্মৃতিকথা লেখা হয়েছে, সেগুলো বিপুল প্রভাব সঞ্চয় করেছে। জাহানারা ইমামের কথা বলতে পারি বা নীলিমা ইব্রাহিম যখন ‘আমি বীরাঙ্গনা বলছি’ লিখলেন বাসন্তী গুহ ঠাকুরতা বা মুক্তিযোদ্ধা যারা তারা অনেক স্মৃতিকথা লিখলেন। তো এই হলো আমাদের যুদ্ধ-পরবর্তী বাস্তবতা। মুক্তিযুদ্ধের সৃতি সংরক্ষণের যে প্রক্রিয়া, তা বলা যায় যে সংক্ষিপ্ত একটা চালচিত্র।
সংবাদ প্রকাশ : মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ইতিহাসকে সংরক্ষণ করছে। নতুন প্রজন্ম এই ইতিহাস জানতে কতটুকু আগ্রহী?
মফিদুল হক : ১৯৯৬ সালে যখন স্বাধীনতার ২৫ বছর আমাদের সামনে ডাক দিল, তখন আমরা আটজন বন্ধু, সহযাত্রী বলা যায়, যারা মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা একটা যৌবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ সময় কেটেছে। আর এই সময়ে আমাদের মনে হয়েছিল যে কিছু করা যায় কি না স্মৃতি সংরক্ষণে। তো অনেক রকম চিন্তাভাবনার পর আমাদের সিদ্ধান্ত হলো যে একটা জাদুঘর করা যায় কি না। জাদুঘর বলতে স্মৃতি সংরক্ষণের একটা জায়গা যদি করা যায়। তো আমরা ভালোভাবেই উপলব্ধি করেছি যে আটজন ট্রাস্টি জাদুঘর তৈরি করতে পারে না, যদি না বহু মানুষের সমর্থন সেখানে পাওয়া যায়। তো আমাদের মনে হয়েছিল যদি কোনো উদ্যোগ নেওয়া যায়, যদি অঙ্গীকারবদ্ধভাবে নিরপেক্ষভাবে বস্তুনিষ্ঠভাবে ইতিহাস তুলে ধরার মতো একটা প্রচেষ্টা নেওয়া হয়, মানুষ সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেবে। তখন আমরা সেগুনবাগিচায় একটা বাড়ি ভাড়া নিয়ে আবেদন করি বিশেষ করে স্মৃতি স্মারকের জন্য। জাদুঘর তো স্মারকের মধ্য দিয়ে ইতিহাসের কথা বলবে। তো আমরা বিপুল সাড়া পেয়েছিলাম এবং শুরু থেকেই জাদুঘর একটা পূর্ণাঙ্গ জাদুঘর হিসেবে যাত্রা শুরু করেছিল। আর তখন কিন্তু স্বাধীনতার ২৫ বছর হয়ে গেছে এবং যে একটা নতুন প্রজন্ম গড়ে উঠেছে, তারা কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসটা জানার সুযোগটা পায়নি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠ্যবইয়ের মাধ্যমে গণমাধ্যমে। তখন এটাও আমাদের মনে হয়েছিল যে এই ইতিহাসটা তুলে ধরতে হবে নতুন প্রজন্মের জন্য ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য। তো তরুণদের সেখানে বিভিন্নভাবে সম্পৃক্ত করার অনেক চেষ্টা সেখানে শুরু থেকেই ছিল, সেটা ক্রমে ক্রমে আরও প্রসারিত হয়েছে এবং আজকে সেই ৯৬ সালের পর জাদুঘরও ২৬ বছর অতিক্রম করেছে। মুক্তিযুদ্ধের আমরা ৫০ বছরও পার করেছি, ৫২ বছর এখন আমাদের, কিন্তু দেশ সমাজ জাতি কখনোই ইতিহাসটাকে বিস্তৃত হতে দিতে রাজি ছিল না। এবং আজকে একটা বড় দায় হচ্ছে ইতিহাসটা নতুন প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেওয়। সেখানে অনেক রকম পরিবর্তনও হয়েছে। পাঠ্যবইয়ে, কারিকুলামে এমনকি উচ্চতর পর্যায়েও যে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস, এটা সবাইকে পড়তে হয় যে যেই বিষয়েই পড়ুক না, যারা স্নাতক পর্যায়ে পড়াশোনা করবেন, তিনি কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ুক, তিনি ব্যবসা প্রশাসন পড়ুক, তিনি লিবারেল আর্টস নিয়ে পড়াশোনা পড়ুক, একটা সেমিস্টার সবার পড়তে হয় এটা একটা বড় ঘটনা আমাদের দেশে ঘটছে এবং পাঠ্যবইয়েও অনেকভাবে সেটা আসছে। আর মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরও তরুণদের নিয়ে অনেকভাবে কাজ করে, তার একটা বড় শক্তি হচ্ছে তরুণরা এখানে নানাভাবে সম্পৃক্ত হয় নানা ধরনের কাজ করে। নানা ধরনের উৎসব আয়োজন এখানে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের চত্বরে, অনেক রকমভাবে তাদের সম্পৃক্তি, গবেষণা, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক চলচিত্র নির্মাণ বহু রকম কাজ। আমরা মনে করি যে জাদুঘর একটা প্ল্যাটফর্মের মতো কাজ করে আর তরুণেরা এসে এই কাজের সুযোগগুলো গ্রহণ করতে পারে।
সংবাদ প্রকাশ : সম্প্রতি জাদুঘরে শেষ হয়ে গেল লিবারেশন ডকফেস্ট। এই উৎসবের অর্জন নিয়ে কিছু বলুন।
মফিদুল হক : আমরা প্রতিবছর এখন একটা প্রামাণ্যচিত্র উৎসব করি। সেগুনবাগিচায় খুব ছোট আকারে এটা শুরু হয়েছিল এবং বলা যায় যে একেবারেই ছোট আকারে। আমরা তখন থেকেই বলেছিলাম এটা আন্তজার্তিক উৎসব। আর তখন চেষ্টা ছিল যে এই যে গণহত্যা বা মুক্তির সংগ্রাম, সেসব বিষয়ে যেসব ছবি খুব পরিচিত, সেগুলো সংগ্রহ করে উপস্থাপন করা। আর আমাদের দেশের নির্মাতারা বিশেষ করে তরুণদের প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণে উৎসাহিত করা। তো ইন্টারন্যাশনাল ডকুমেন্টরি ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল অন লিবারেশন অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস এ রকম একটা বড় নাম ছিল। পরে আস্তে আস্তে কিন্তু এই উৎসবটা প্রসারিত হতে থাকে এবং তরুণদের সম্পৃক্তি বাড়তে থাকে। আমরা নানা রকম কর্মশালাও করেছি, যার মধ্য দিয়ে তরুণরা প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণের পেছনে যে নানা রকম চিন্তাভাবনা বা প্রকৌশলগত দিক, সেগুলো জানতে পারেন। বাইরের মেন্টররাও এখানে এসে এই কাজগুলো করেছে। এবং ক্রমে ক্রমে বিশেষ করে ঢাকার ডক ল্যাব যে ফেস্ট করে আন্তর্জাতিকভাবে তারাও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে এই আয়োজনটা শুরু করল, তখন তাদের সঙ্গেও একটা সম্পৃক্তি হলো এবং সব মিলিয়ে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের উৎসবটাও কিন্তু একটা অন্য মাত্রায় চলে গেল। এখন আমরা এটাকে বলি লিবারেশন ডকফেস্ট অর্থাৎ ডকুমেন্টরি ফেস্টিভ্যাল অব ফিল্মস অন লিবারেশন। আর করোনার সময় এটা অনলাইনে হয়েছে, তাতেও কিন্তু আমরা অনেক সাড়া পেয়েছি। এখন এটা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতির দিকে যাচ্ছে। যারা উৎসবে চলচিত্র জমা দেন প্রতিযোগিতামূলক বিভাগে, তাদের জন্য যেমন দেশের জন্য জাতীয় পুরস্কার রয়েছে তেমনি আন্তর্জাতিক পুরস্কারও রয়েছে এবং গত দুই বছরের অনেক উল্লেখযোগ্য ছবি এখানে এখন নির্মাতারা জমা দেন। এবারও প্রায় ৫০টির বেশি দেশের ১০০ ছবি আমরা এই উৎসবে পেয়েছি। তার সঙ্গে তরুণ নির্মাতারা তাদের যে নির্মাণের ভাবনা, সেটা সে স্পিচ করেছে। যেটা বলি যে ইয়াং ফিল্ম ট্যালেন্টসদের যে স্টোরি টেলিং ল্যাব যে কীভাবে গল্পটা বলতে হবে, সেটাও অনুষ্ঠিত হয়েছে। রঞ্জন রায় এসেছিলেন ভারত থেকে। ফরাসি এক চিত্র নির্মামাতা তিনিও এই উৎসবে যোগ দিয়েছিলেন এবং সিঙ্গাপুরের একজন খুব বিখ্যাত নারী নির্মাতা তান পিন পিন, তিনিও এই উৎসবে যোগ দিয়েছিলেন। ফলে এই উৎসবটা ক্রমেই একটা বড় মাত্রা পাচ্ছে এবং আমরা দেখছি তরুণ নির্মাতাদের উৎসাহটা আরও প্রসারিত হচ্ছে। ফলে আমাদের মনে হয় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর এই জায়গাটায় তরুণদের উৎসবের একটা ক্ষেত্র হয়ে উঠছে।