• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর, ২০২৪, ৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

গরমে শিশুদের প্রতি বিশেষ নজর দিতে হবে : সুস্মিতা বড়ুয়া


বিজন কুমার
প্রকাশিত: এপ্রিল ২৭, ২০২৪, ০৯:১৪ পিএম
গরমে শিশুদের প্রতি বিশেষ নজর দিতে হবে : সুস্মিতা বড়ুয়া
পুষ্টিবিদ সুস্মিতা বড়ুয়া শুচি। ছবি: সংবাদ প্রকাশ

দেশজুড়েই চলছে তীব্র তাপপ্রবাহ। অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে জনজীবন। তবুও পেশা ও জরুরি প্রয়োজনে প্রখর রোদ উপেক্ষা করে বাইরে বের হতে হচ্ছে। স্কুল বা কলেজপড়ুয়ারাও যাচ্ছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। এতে অসুস্থতা বাড়ছে। ডায়ারিয়া, জ্বর, সর্দি, কাশিসহ নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে অনেকেই ভর্তি হচ্ছেন হাসপাতালে।

এমন পরিস্থিতিতে পুষ্টি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তাপপ্রবাহের মধ্যেও নিয়ম মেনে চললে অসুস্থতা থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব। চলমান তাপপ্রবাহে সাধারণ মানুষের করণীয়সহ বিভিন্ন বিষয়ে সংবাদ প্রকাশের সঙ্গে কথা বলেছেন বাংলাদেশ মাল্টিকেয়ার হাসপাতালের পুষ্টিবিদ সুস্মিতা বড়ুয়া শুচি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বিজন কুমার

সংবাদ প্রকাশ: চলতি মাসের শুরু থেকেই তাপপ্রবাহ চলছে। এতে দেখা যাচ্ছে হাসপাতালগুলোতে রোগীর অনেক চাপ। এই গরমে কোন কোন রোগের প্রকোপ বেড়ে যায়, কেন বেড়ে যায়?

সুস্মিতা বড়ুয়া শুচি : অতিরিক্ত গরমে আমরা যখন ঘেমে যাই, তখন ঘামের মধ্য দিয়ে পানির পাশাপাশি বেশ কিছু খনিজ উপাদান শরীর থেকে নির্গত হয়। যেমন- সোডিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, ক্লোরাইড, পটাশিয়াম ইত্যাদি। ফলে এ অবস্থায় রক্ত চাপে অসামঞ্জস্যতা ও শরীরে পানিস্বল্পতা দেখা দেয়। এছাড়া সঠিক নিয়ম মেনে না চলার কারণে শরীর অনেক দুর্বল হতে শুরু করে। সঠিক খাদ্যাভ্যাসের অভাবে শরীর খারাপ থেকে আরও খারাপ হতে থাকে। এমনি এক বা একাধিক কারণে আমরা বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকি। অবশ্য ব্যক্তির স্বাস্থ্যের ধরনভেদে কোনো না কোনো রোগ হতেই পারে।

সাধারণত গরমের সময় অনেক ধরনের অসুখ হতে দেখা যায়। যেমন- ডায়রিয়া, জ্বর, হাঁপানি, কোষ্ঠকাঠিন্য, টাইফয়েড, আমাশয়, হজমের গোলযোগ, প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া,  সর্দি-কাশি, ত্বকের এলার্জি, হিট ক্র্যাম্প বা পেশীতে যন্ত্রণা, হিট সিনকোপ বা অজ্ঞান হওয়া, হিট স্ট্রোক, হিট এডেমা বা হাত-পায়ের পাতা ফোলা ইত্যাদি।

সংবাদ প্রকাশ: গরমে খাদ্যাভ্যাসের বিষয়ে আপনার পরামর্শ কী?

সুস্মিতা বড়ুয়া শুচি: গরমে সাধারণ খাবার যেমন- ভাত, ডালের পাশাপাশি বেশি করে বিশুদ্ধ পানি, রসালো ফল ও সবজির দিকে মনোযোগ দিতে হবে। রসালো খাবার বলতে, যেমন- শসা, লাউ, পেঁপে, চিচিঙ্গা, লেবু, কমলা, তরমুজ, বেল, পাকা পেঁপে, আনারস, ডাবের পানি, এলোভেরা ইত্যাদি। এছাড়াও ইসবগুলের ভূষি মেশানো পানি, মৌরি ভেজানো পানি এবং ফলের রসের সঙ্গে একটু পুদিনা ও লেটুস পাতার রস যোগ করা যেতে পারে। যতটুকু সম্ভব সহজপাচ্য, হালকা মসলা দিয়ে অল্প তেলে রান্না খাবার গ্রহণ করতে হবে।

সংবাদ প্রকাশ: গরমে তৈলাক্ত খাবার থেকে বিরত থাকা কেন জরুরি বলে মনে করেন?

সুস্মিতা বড়ুয়া শুচি: সাধারণত গরমের সময় শরীরকে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে অনেক বেশি কাজ করতে হয়। এই সময়ে একজন ব্যক্তি যত বেশি তৈলাক্ত খাবার গ্রহণ করবে তার হজম প্রক্রিয়া ততই হ্রাস পাবে। অর্থাৎ সেসব খাবার শরীরের পক্ষে হজম অনেক কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। কারণ, কার্বোহাইড্রেট থেকে প্রোটিন ও ফ্যাট হজম হতে বেশি সময় নেয়। যদি কেউ গরমে অধিক পরিমাণে তৈলাক্ত খাবার গ্রহণ করে, তবে তার হজম প্রক্রিয়ার ব্যাঘাত ঘটানোর পাশাপাশি পেট ব্যথা, পেট ফাঁপা, অস্বস্তিকর অনুভূতি, চুলে ও ত্বকে নানা ধরনের জটিলতাও দেখা দিতে পারে।

সংবাদ প্রকাশ: বয়স অনুপাতে পানির চাহিদার কি ভিন্নতা রয়েছে? যদি থাকে তবে তা সম্পর্কে জানতে চাই।

সুস্মিতা বড়ুয়া শুচি: বয়স অনুপাতে পানির চাহিদার ক্ষেত্রে ভিন্নতা রয়েছে। যেমন- ৭ মাস থেকে ১ বছর বয়সী শিশুদের পানির চাহিদা হাফ গ্লাস থেকে এক গ্লাস বা ১২৫ মিলি থেকে ২৫০ মিলি। একইভাবে দুই থেকে তিন বছর বয়সীদের দুই গ্লাস থেকে চার গ্লাস বা ৫০০ মিলি থেকে ১ লিটার, চার থেকে আট বছর বয়সীদের ৫ গ্লাস থেকে ছয় গ্লাস বা ১২৫০ মিলি থেকে ১৫০০ মিলি, নয় থেকে ১৩ বছর বয়সীদের ৭ থেকে ৮  গ্লাস বা ১৭৫০ মিলি থেকে ২ হাজার মিলি এবং ১৪ থেকে ১৮ বছর বয়সী কিশোরদের পানির চাহিদা আট গ্লাস থেকে ১১ গ্লাস বা ২ হাজার থেকে ২৭৫০ মিলি।

এছাড়াও ১৯ বা তার বেশি বয়সী নারীদের পানির চাহিদা ৮ থেকে ১০ গ্লাস বা ২ হাজার মিলি থেকে ২৫০০ মিলি এবং একই বয়সী পুরুষদের পানির চাহিদা ৮ থেকে ১৩ গ্লাস বা ২ হাজার থেকে ৩২৫০ মিলি। অপরদিকে, গর্ভবতী মায়েদের পানির চাহিদা ১০ থেকে ১১ গ্লাস বা ২৫০০ মিলি থেকে ২৭৫০ মিল। আর যেসব মা শিশুদের বুকের দুধ খাওয়ান তাদের পানির চাহিদা ১০ থেকে ১৫ গ্লাস বা ২৫০০ মিলি থেকে ৩৭৫০ মিলি। বর্তমানে যেহেতু ভীষণ গরম পড়ছে, তাই এই সময়ে পানির পরিমাণ উল্লিখিত পরিমাণের চেয়ে প্রয়োজন অনুযায়ী বৃদ্ধি করা যেতে পারে।

সংবাদ প্রকাশ: অনেকে আছেন একবারে বেশি করে পানি পান করতে চান। সে ক্ষেত্রে কি পানি পান করার নির্দিষ্ট কিছু নিয়ম রয়েছে?

সুস্মিতা বড়ুয়া শুচি: আমরা বারবার একটি কথা বলে যাচ্ছি, খাবার ও পানি সবকিছুই একবারে বেশি করে না খেয়ে বারে বারে অল্প পরিমাণে যেন গ্রহণ করা হয়। হিসাব অনুযায়ী, পানি পান করার একটি নিয়ম রয়েছে। যেমন- কমপক্ষে প্রতি ২০ থেকে ২৫ মিনিটে অন্তর অন্তর এক কাপ করে পানি পান করতে হবে। এক কাপ মানে আধা গ্লাস। আপনি যতক্ষণ জেগে আছেন সেই সময়টাতে প্রতি ২০ বা ২৫ মিনিটের মধ্যে যদি কমপক্ষে এক কাপ সমপরিমাণ পানি পান করতে হয়, তবে আপনার বয়স অনুপাতে কতটুকু পানি পান করছেন সেটা হিসাব করে ফেলুন।

 পুষ্টিবিদ সুস্মিতা বড়ুয়া  শুচি

সংবাদ প্রকাশ: গরমের এই সময়ে শিশুদের কী কী বিষয়ে যত্ন নেবেন অভিভাবকরা?

সুস্মিতা বড়ুয়া শুচি: এই সময়টাতে শিশুদের অবশ্যই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখাটা ভীষণ জরুরি। নিয়মিত গোসল করতে হবে। ঘরে বাইরে দাওয়াতে যেখানেই যাক না কেন শিশুর জন্য আকর্ষণীয় ভারী পোশাকের পরিবর্তে আরামদায়ক বা হালকা রঙের ঢিলা সুতির পোশাক পরিধান করাতে হবে। চুল ছোট করে রাখতে হবে, সম্ভব হলে সব চুল ফেলে দিলে আরও বেশি ভালো হয়। অতিরিক্ত মানুষের ভিড় থেকে দূরে রাখতে হবে। যদি শিশু ঘেমে যায়,  সে ক্ষেত্রে আবার শরীর পরিষ্কার করে তারপর পোশাক পরিবর্তন করে দিতে হবে। শিশুকে সঠিক সময়ে সঠিক পরিমাণ খাদ্য দিতে হবে। খাবার সুস্বাদু করার চেয়ে স্বাস্থ্যকর হয়েছে কি না সেদিকে একজন অভিভাবকের খেয়াল রাখা জরুরি।

শিশুরা অনেক সময় খাবার খেতে চায় না, সে ক্ষেত্রে আকর্ষণীয়ভাবে সুস্বাদু খাবার পরিবেশন করে খাদ্যের প্রতি শিশুর আগ্রহ বাড়ানো যেতে পারে। আর পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুমাচ্ছে কিনা সেটি খেয়াল রাখতে হবে। আর জেগে থাকলে সঠিকভাবে সক্রিয় আছে কিনা তা লক্ষ্য রাখতে হবে।

শিশুর যেকোনো লক্ষণীয় নেতিবাচক পরিবর্তন দেখা মাত্রই “ঠিক হয়ে যাবে” বা “গরমের সময় একটু এরকম হয়” - এ ধরনের চিন্তায় ডুবে না থাকাই ভালো। যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়া জরুরি।

সংবাদ প্রকাশ: গর্ভবতী মায়েদের কীভাবে যত্ন নিতে হবে?

সুস্মিতা বড়ুয়া শুচি: গর্ভবতী মায়েদের জন্য কিছু নিয়ম মেনে চলাটা আবশ্যক। যেমন-পুষ্টিবিদের দেওয়া খাদ্য তালিকা সঠিকভাবে মেনে চলতে হবে। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী দেওয়া কোনো ওষুধ থাকলে সেটা সঠিক সময়ে সেবন করতে হবে। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ব্যায়াম করা থেকে বিরত থাকুন।

শুধু গরমের সময় নয়, সম্পূর্ণ গর্ভাবস্থায় আরামদায়ক পোশাক ও জুতা পরিধান করার পাশাপাশি অস্বাস্থ্যকর খাবার, অতিরিক্ত লবণ বা লবণাক্ত খাবার, বাইরের খাবার এবং তেলে ভাজা খাবার বর্জন করা জরুরি। এছাড়া একটানা ৮ ঘণ্টা ভালো ঘুম হচ্ছে কিনা খেয়াল রাখতে হবে। তাপের তীব্রতা যখন কম থাকবে তখন প্রয়োজনীয় কাজ সম্পন্ন করতে হবে। ঘেমে যাওয়া শরীর নিয়ে অপেক্ষা করে সেই ঘাম শুকানো যাবে না বরং সাথে সাথেই শরীর পরিষ্কার করে পোশাক পরিবর্তন করে ফেলতে হবে।

সংবাদ প্রকাশ: পুষ্টি বিশেষজ্ঞ হিসাবে সর্বশেষ পরামর্শ কী দেবেন?

সুস্মিতা বড়ুয়া শুচি: একজন পুষ্টি বিশেষজ্ঞ হিসেবে বলতে চাই, অন্য কারও পথ্যতালিকা দেখে বা অনলাইনভিত্তিক কোনো তথ্য অনুসরণ করে নিজের পথ্যতালিকা তৈরি করবেন না। একজন পুষ্টি বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হয়ে আপনার সঠিক খাদ্যতালিকা গ্রহণ করুন এবং সেই অনুযায়ী তালিকাটি অনুসরণ করুন। কারণ, আপনি প্রতিদিন কতটুকু পরিমাণে খাবার কখন এবং কীভাবে গ্রহণ করেন তা নির্ভর করে লিঙ্গ, বয়স, ওজন, আপনার শারীরিক-মানসিক অবস্থা এবং আরো অনেক তথ্যের ওপর।

কথাপ্রকাশ বিভাগের আরো খবর

Link copied!