• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর, ২০২৪, ৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

বিভক্ত শিক্ষানীতি প্রজন্মের জন্য কল্যাণকর নয় : আবুল কাসেম ফজলুল হক


খাদিজা নিপা
প্রকাশিত: জুলাই ৩০, ২০২৩, ০৭:৩১ পিএম
বিভক্ত শিক্ষানীতি প্রজন্মের জন্য কল্যাণকর নয় : আবুল কাসেম ফজলুল হক

সংবাদ প্রকাশের দ্বিতীয় প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উপলক্ষে এক সাক্ষাৎকারে মুখোমুখি হয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক। কথা হয় দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে। তিনি একাধারে প্রাবন্ধিক, লেখক, গবেষক, অনুবাদক ও সমাজ বিশ্লেষক। তার উল্লেখযোগ্য রচনাগুলোর মধ্যে কালের যাত্রার ধ্বনি, আশা আকাঙ্ক্ষার সমর্থনে উল্লেখযোগ্য।

প্রশ্ন : বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা কেমন হওয়া উচিত?

আবুল কাসেম ফজলুল হক : বাংলাদেশের শিক্ষানীতি এবং শিক্ষাব্যবস্থা ভাল নেই। অনেককাল ধরেই খারাপ অবস্থায় আছে। এর অবসান ঘটাতে হবে। যা করলে শিক্ষাব্যবস্থা সবচেয়ে ভাল করা সম্ভব সেটা করতে হবে। যে সরকার এই কাজগুলো করতে চাইবে। সেরকম সরকার বাংলাদেশে এখন নেই। গণতন্ত্র সম্পর্কে ন্যূনতম কিছু ধারণা নিয়ে হলেও রাজনৈতিক দল যখন সরকার গঠন করবে কেবল তখনই সম্ভব হবে। 

শিক্ষানীতির কথায় প্রথমে যেটা ভাবা দরকার, সেটা হলো শিক্ষা নেওয়ার পর কারা কি করবে এসব বিষয়ে প্রচ্ছন্ন ধারণা। আগে যেমন ছিল অতীতের দৃষ্টিভঙ্গির শিক্ষাচিন্তা সেটা এইকালে পৃথিবীর কোনো রাষ্ট্রে নেই। এমনকি যেগুলো ধর্মীয় রাষ্ট্র হিসেবেও পরিচিত সেগুলোতেও আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত নানা বিষয় শেখানো হয়। হয়ত ধর্মের বিষয়ে গুরত্ব বেশি দেয়। কিন্তু বিজ্ঞানের যে অগ্রগতি, আধুনিকতা এটাকে তারা মেনে নেয়। 

যেমন ইরানের কথা বলা যায়। এসব রাষ্ট্র পাশ্চাত্যজ্ঞান পাশ্চাত্যশিক্ষা এগুলো গ্রহণ করতো। পাশাপাশি ইসলামের ইতিহাস এবং মুসলমানদের আবিষ্কারগুলো সম্পর্কে জ্ঞান নিচ্ছে। ওইরকম শিক্ষনীতি দরকার।

শিক্ষানীতিতে থাকবে কী করে একজন শিক্ষার্থী ভাল নাগরিক হয়ে উঠতে পারে সেই চিন্তা। শিক্ষানীতিতে যে বিষয়গুলো থাকে, সেগুলো কেন থাকবে সেটারও উল্লেখ থাকবে। তাছাড়া ভাষা শেখার ব্যাপারে স্পষ্ট নির্দেশনা থাকতে হবে। বাংলা এবং কোনো একটা বিদেশি ভাষা শিখতে হবে। এক্ষেত্রে একটা না, একাধিক ভাষা শিক্ষার ব্যবস্থা রাখতে হবে। 

প্রথমে বিদেশি ভাষার মধ্যে ইংরেজি গুরুত্ব পাবে, যেহেতু জ্ঞান বিজ্ঞানের সবেচেয়ে অগ্রসর ধাপগুলো ইংরেজি ভাষার বই থেকে পাওয়া যায়। তাছাড়াও বিভিন্ন ধর্মের ভাষার প্রতিও এদেশের মানুষের আগ্রহ আছে। সেজন্য এটাকেও বিবেচনায় রাখতে হবে। 

শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য জীবনকে জানা, জগতকে জানা, আমার কর্তব্য কী সেটা অনুসন্ধান করা; পৃথিবীতে কাজ করে চলতে হবে—এমন কিছু কাজ করতে শেখা। যেটাকে অবলম্বন করে আমরা চলতে পারবো। এগুলো দরকার। যারা বিশেষভাবে জ্ঞানানুরাগী, তারা যাতে বিশেষ জ্ঞান চর্চা করতে পারেন তার সুযোগ সৃষ্টি করা। আবিষ্কার উদ্ভাবন—এগুলোর দিকে যেসব ছাত্রছাত্রী যেতে চাইবে সে পথকে উন্মুক্ত রাখা। সেই লক্ষ্যগুলো ঠিক করে শিক্ষানীতি তৈরি করতে হবে। প্রযুক্তির বিকাশের কালে কম্পিউটার ইন্টারনেট এগুলো ভালোভাবে জানা রাষ্ট্রের প্রয়োজনেই।

এই বিষয়গুলো ১৯৪৭ সালের পর থেকে কিংবা যদি ধরি ১৯৭২ সালের পর থেকে আজ পর্যন্ত সুষ্ঠুভাবে কোনো সরকারই করতে পারেনি। আমাদের দেশে বহু লোকে প্রাইমারি, সেকেন্ডারিতে ভাল ফলাফল করেছে। যেমন জিপিএ ৫ কিংবা গোল্ডেন। এগুলো দেখে শিক্ষানীতি এবং শিক্ষা ব্যবস্থার ভেতরটা বোঝা যায় না। ভেতরটা বুঝতে হলে আমাদের গভীরভাবে দেখতে হবে পাঠ্যপুস্তক ও পাঠ্যসূচি। পাঠ্যপুস্তক, পাঠ্যসূচি ও পাঠ্যক্রম এটা ভাল হলে শিক্ষাব্যবস্থা ভাল হবে, কিন্তু ওইদিকে কোনো সরকারই সুষ্ঠু, স্বাধীন চিন্তাশীলতার পরিচয় দেয় না। শিক্ষাব্যবস্থা যারা প্রণয়ন করেছেন তারা এরকম বিষয়গুলো আনছেন যে, শিক্ষার উদ্দেশ্য পরীক্ষায় ফল ভাল করা এবং পরীক্ষার ফল ভাল করতে বই ভাল করে পড়তে হবে। এই শিক্ষানীতিতে পরীক্ষার ফল ভালো করা, জিপিএ ফাইভ পাওয়ার এই ধারণাটাই সম্পূর্ণ ভুল। প্রত্যেক সরকারকেই দেখা যায় একটা ভুল থেকে নতুন আরেকটা ভুলের দিকে যায়। সুষ্ঠু কোনো ব্যবস্থা করতে পারেনি তারা।

প্রশ্ন: করতে না পারার কারণ হিসেবে কোন বিষয়গুলো কাজ করে?

আবুল কাসেম ফজলুল হক : এর পেছনে দুইটা কারণ কাজ করে। একটা হলো আমাদের রাষ্ট্র বাইরের সাহায্য সহযোগিতা নিয়ে চলে। বিশ্ব ব্যংক, আইএমএফ এসব থেকে সাহায্য নেয়। যারা ঋণ এবং সাহায্য দিয়ে চলে তারা কিছু শর্তের মধ্যে ফেলে সুষ্ঠু শিক্ষানীতি এখানে হতে দেয় না। দ্বিতীয় কারণ হলো যেই দল যখন ক্ষমতায় থাকে, সেই দল তাদের দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী শিক্ষানীতি এবং শিক্ষা ব্যবস্থা চালনা করতে থাকে। এই দুটো বিষয়ই আমাদের যে ধরণের শিক্ষানীতি বা শিক্ষাব্যবস্থা হওয়া দরকার তার পরিপন্থী ভুমিকা রাখে। সরকারের সুযোগ অনেক বেশি ছিল, সুযোগের পরও সুষ্ঠু শিক্ষানীতির চিন্তা আমাদের মন্ত্রীপরিষদের কোনো সদস্যের মধ্যেই পাই নি।

প্রশ্ন: আপনি বলছিলেন ভাষা শেখা গুরত্বপূর্ণ, কেন?

আবুল কাসেম ফজলুল হক : বাংলা ভাষা আমাদের রাষ্ট্রভাষা, বাংলাদেশের জনগণের মাতৃভাষা। এই ভাষার ওপর বাঙালি তথা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের উন্নতি নির্ভর করে। বাংলাভাষা যদি উন্নত ও অগ্রসর না হয়, তাহলে আমাদের রাষ্ট্র দুর্বল হতে থাকবে এবং শেষ পর্যন্ত স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে অস্তিত্ব রক্ষা করা কঠিন হয়ে যাবে। বাংলা ভাষাকে গুরুত্ব দেওয়ার পাশাপাশি জ্ঞান বিজ্ঞানের চর্চায় যে দেশগুলো সবচেয়ে বেশি অগ্রসর হয়েছে যেমন, ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি ইউএসএ এসব রাষ্ট্র। এই উন্নত রাষ্ট্রগুলো থেকে আমাদের অনেক কিছু গ্রহণ করতে হবে। আমাদের বাঙালি বৈশিষ্ট্যকে উন্নত করার জন্য। বাংলা ভাষা বাঙালি জাতীয় চেতনা ভুলে যাওয়ার জন্য নয়। পৃথিবীতে ইংরেজি, ফরাসি, জার্মান, চীনা, রাশান, আরবি এবং আরও নানান ভাষা আছে। সব ভাষা শেখারই ব্যবস্থা বাংলাদেশে রাখতে হবে। কিন্তু সব শিক্ষার্থীকেই ইংরেজি শিখতে হবে, সেটা দরকারি না। আমাদের রাষ্ট্রীয় চাহিদা, জাতীয় চাহিদা বিবেচনা করে সেই অনুযায়ী স্কুল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যবস্থা রাখতে পারে।

প্রশ্ন: তিন ধারার শিক্ষা ব্যবস্থা দেশকে কোন দিকে নিয়ে যাবে?

আবুল কাসেম ফজলুল হক : আমাদের জাতীয় শিক্ষাকে নানান ভাগে বিভক্ত করে রাখা হয়েছে। যেমন—বাংলা মাধ্যমে পরিচালিত স্কুল, কলেজ আছে, সেই সঙ্গে ইংরেজি মাধ্যমের প্রতি সব সরকারই নমণীয় এবং ইংরেজি অনেক স্কুল আছে। সেই স্কুল সংখ্যাও ১৯৭২ /৭৩ এর পর থেকে ক্রমাগত বেড়েছে ঢাকায় এবং ঢাকার বাইরে তুলনামূলক যেগুলো ভালো শহর সেগুলোতে। এই যে ক্রমাগত ইংরেজি ভাষাকে গুরত্ব দিচ্ছে তাতে বাংলা ভাষা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, বাংলা ভাষার গুরত্ব কমে যাচ্ছে। আর এই এ লেভেল এবং ও লেভেলের যে শিক্ষা, এটা কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়কে অবলম্বন করে ব্রিটিশ সরকার এর সিলেবাস প্রস্তুত করে। এসব পাঠ্যপুস্তক যে ইউকে থেকে ছেপে এনে তা নয়। ভারতে ছাপা হয়, এদিকে অস্ট্রেলিয়াতেও ছাপা হয়, আর দুই একটা জায়গা ছাপা হয়। সেসব বই বাংলাদেশে আনা হয় এবং যারা এই ধারায় শিক্ষা নেয় তারা এসব বই পড়ে। তো এখান থেকে ইংরেজিকে এতো গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে এবং ইংরেজি শিক্ষাটা ক্লাস টুয়েলভ পর্যন্ত করা হয় ব্রিটিশ কাউন্সিলের মাধ্যমে ব্রিটিশ গভঃমেন্ট দ্বারা। এতে বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ কোনো ভূমিকা নেই। তবে বিভিন্ন ছাত্র আন্দোলন আবার এটা ওটার মাধ্যমে কিছু অভিযোগ করা হয়েছে যে, এ লেভেল ও লেভেলের শিক্ষাক্রম বাংলাদেশের ভবিষ্যতের জন্য নয়। এই শিক্ষাক্রম ব্রিটিশ শাসকদের যে বিশ্বপরিকল্পনা সে অনুযায়ী হচ্ছে। এর ফলে কয়েকবছর আগে বাংলাদেশ স্টাডিজ বলে অল্প নাম্বারের একটা পেপার যুক্ত করেছে। কিন্তু এটুকু বাংলাদেশ স্টাডিজ পড়ে নিজের দেশ সম্পর্কে অল্পই জানা যায়। এটা কোনো সুষ্ঠু ব্যবস্থা না। সরকার গত বেশ কিছু বছর যাবত ইংলিশ ভার্সন নামে ভিন্ন এক নতুন ধারা চালু করেছে। এর সঙ্গে আছে মাদ্রাসা শিক্ষা। তার আবার বিভিন্ন উপধারা আছে। একটা দেশের জনগণকে যদি এভাবে নানাভাগে বিভক্ত করে ফেলে, তাহলে এই লোকেরা পরবর্তীকালে নিজেদের রাষ্ট্র গঠন, নিজেদের জাতি গঠন এবং একটা আত্মশক্তি অবলম্বন করে বাইরের সহায়তা নিয়ে জাতি, রাষ্ট্রকে গড়ে তোলার মানসিকতা হারিয়ে ফেলে। 

এদিকে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে যে ছেলে মেয়েরা পড়াশোনা ভাল করে ভাল ফল করে, তারা বাইরে অন্য রাষ্ট্রে গিয়ে নাগরিকত্ব গ্রহণ করে।

এই যে, তিন ভাষায় তিনটা ধারা এবং ইসলামী ধারার মধ্যে আরো কয়েকটা ধারা আছে, আবার এনজিও সিভিল সোসাইটি অর্গানাইজেশন থেকেও কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে, যেগুলোর চিন্তা ভাবনা অন্যরকম। সেদিক থেকে বাংলা মাধ্যমে যে বই পুস্তক প্রকাশ করে, এসব যে স্কুলগুলোতে পড়ানো হয় সেটাকে বলা যায় বাংলাদেশের শিক্ষার মূল, কিন্তু সেটার প্রতিই সরকার যথেষ্ট যত্ন নেয় না। সরকার নতুন করে যে ইংলিশ ভার্সন করছে, এটাকে সফল করার চেষ্টা করে আর দেশের যে ধনী লোকেরাও ইংরেজি ধারাকে বেশি উপযোগী মনে করে। আমাদের বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে জীবন যাত্রার প্রয়োজনে যেটাকে পেশামূলক শিক্ষা বলে সেটাকে। অধিকাংশ শিক্ষার্থী এই ধারার শিক্ষা বা কর্মমূখী শিক্ষায় যাবে। 

যদি আমরা ধরি যে, গ্রামাঞ্চলে যারা লেখাপড়া করে তারা ছেলে মেয়েকে আর্থিক কারণে বেশিদূর পড়াতে পারে না। তো এটা বন্ধ হয়ে যায় বলে জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাকে এক জায়গায় রাখা যাবে না। অগ্রসর হতে হবে। যারা পিছিয়ে গেছে তাদের কীভাবে অগ্রসর করা যায় সেটা দেখতে হবে। তাদের সাথে পিছিয়ে পড়লে হবে না। পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা সকলকেই লাভ করতে হবে। 

এটা সরকারকে দেখতে হবে। ক্লাস সিক্স থেকে দুইটা স্টিম করতে হবে, যাদের মধ্যে একটা স্টিম উচ্চ শিক্ষার জন্য পড়বে, আরেকটা স্টিম কর্মমূখী শিক্ষার দিকে যাবে। দশম শ্রেণির পরীক্ষার পর সবাই উচ্চশিক্ষায় যাবে না। 

এভাবে গোটা বিষয়টা দেখে উপলব্ধি করে স্থির করতে হবে কোথায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কীরকম করা যাবে, কোথায় কী ধরনের সিলেবাস তৈরি করা যাবে। আর দশম শ্রেণির পরীক্ষার ভিত্তিতেই, নতুন করে কোনো ভর্তি পরীক্ষা না নিয়ে মেরিটের মাধ্যমে বিভিন্ন বিষয়ে উচ্চশিক্ষা নিতে পারবে। আর যেকোনো ক্ষেত্রেই কিছু ব্যতিক্রম রাখতে হয়। সেদিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তির ক্ষেত্রে শতকরা দুইজন ভর্তি করার ক্ষমতা ওই ভর্তি কমিটির থাকবে, যারা রেজাল্ট ভালো না করলেও নানা দিক থেকে ভাল, তাদের ভর্তি করাতে পারবে।

কথাপ্রকাশ বিভাগের আরো খবর

Link copied!