ভারতীয় চলচ্চিত্র পরিচালক অনিক দত্ত এপার ও ওপার বাংলায় সমান জনপ্রিয়। তাঁর নির্মিত ‘অপরাজিত’ চলচ্চিত্রটি এ বছর ২১তম ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যের পুরস্কার পেয়েছে। সত্যজিৎ রায়ের জন্মশতবর্ষে শ্রদ্ধা নিবেদন করে বানানো ‘অপরাজিত’ প্রশংসিত হয়েছে দুই বাংলাতেই। এর আগে অনিক দত্ত ‘ভূতের ভবিষ্যৎ’, ‘ভবিষ্যতের ভূত’, ‘বরুণবাবুর বন্ধু’ প্রভৃতি ছবি বানিয়ে দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছেন। গেলো ২৯ এপ্রিল কলকাতায় অনিক দত্তের বাড়িতে তাঁর দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নেন বাংলাদেশের লেখক ও চলচ্চিত্র সমালোচক বিধান রিবেরু। সেই সাক্ষাৎকারের কিছু অংশ এখানে ছাপা হলো। সাক্ষাৎকারটি শ্রুতিলিখন করে দিয়েছেন তাহসিনুর রহমান।
বিধান রিবেরু: আপনি বাংলাদেশে বেশ জনপ্রিয়। ২০১২ সালে “ভূতের ভবিষ্যৎ” মুক্তি পেল, তখন দারুণ সাড়া জাগায় ছবিটি। বাংলাদেশে, বিশেষ করে ঢাকায়। রাজনৈতিক নানাস্তর ছিল বলে দর্শককে তা আকৃষ্ট করে। আপনার কাজের প্রতিও তখন মানুষ আগ্রহ দেখাতে শুরু করে। এরপর আপনি ‘আশ্চর্য প্রদীপ’, ‘মেঘনাধবধ রহস্য’, ‘বরুণবাবুর বন্ধু’ এবং সর্বশেষ ‘অপরাজিত’ ছবিটা করেছেন। ২১তম ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচিত্র উৎসবে ছবিটি সেরা চিত্রনাট্যের পুরস্কারও পেলো। আপনার প্রায় সবকাজেই রাজনৈতিক ঝোঁক লক্ষ্য করার মতো। আর সেটা আপনি ফুটিয়ে তোলেন সহজ-সরল বয়ানের মধ্য দিয়ে। ব্যবহার করেন ব্যঙ্গ। এটা করার জন্য আপনার প্রস্তুতিটা কেমন থাকে?
অনিক দত্ত: হ্যাঁ, প্রথমে বলি ঢাকায় আমি দুবার গেছি, কিন্তু ‘ভূতের ভবিষ্যৎ’ হওয়ার পরে একবারো যাইনি, হয়ে ওঠেনি। আর এছাড়া, আমার বাবার বাড়ি কুমিল্লা, কুমিল্লা ব্যাংকিং করপোরেশনে ছিলো আমার ঠাকুরদাদা, আর আমার মায়ের দিকটা ঢাকার। বিমল রায় আরেকজন খুবই বিখ্যাত ফিল্মমেকার, ভারতীয় চলচ্চিত্রের, আমার মা’র কাকা হতো। আমার মা পার্টিশনের পরও, আমার দাদু ঋত্বিক ঘটকের মতো ভুলতে পারতেন না ঢাকাকে। সেজন্য একবার-দুবার ফেরত গেছেন, মা গোয়ালন্দ স্টিমার ঘাঁটি থেকে স্টিমার ধরে গেছিলেন। সে গল্প অনেক শুনেছি। আর বাবাদের, পিসীদের কাছ থেকে কুমিল্লার গল্প শুনেছি– এই আছিলো, ঐ আছিলো। তার কতটা সত্যি, কতটা বাড়ানো আমি জানিনা। কিন্তু আমি নিজে খালি ঢাকাতেই গেছিলাম, কাজের সময়। তখন বিজ্ঞাপনের কাজ করতাম। যাইহোক, আমি সরাসরি আপনার শেষ প্রশ্নটায় চলে আসি। আমি কিন্তু, I was not particularly political creature from the beginning. আমি স্টুডেন্ট পলিটিকসে, মানে পার্টি পলিটিকসে সেভাবে কোনদিন ছিলাম না।
আমি যে কলেজটিতে পড়তাম, সেটা ছিলো বেসরকারি কলেজ, জেভিয়ার্স কলেজ, ক্যালকাটা, সেখানে কোনরকম পার্টি পলিটিকসের হাতেখড়িটাও হয়নি, এবং আমি খুব যে ন্যাচারালি পলিটিক্সের ব্যাপারে আগ্রহী ছিলাম সেরকম নয়। আমি খবরের কাগজের একদম লাফ দিয়ে শেষ পাতাটায় যেতাম, যেটাতে খেলাধূলো থাকে, প্রথমে স্টেটসম্যান ছিলো, তারপর টেলিগ্রাফ ছিলো, এবং মূলতঃ ক্রিকেট। সেটাই আমার মাইন্ড স্পেস অনেকটা অকুপাই করে রাখত, কিন্তু সিনেমাটা আমাকে আগ্রহী করে তুলেছিলো বেশ কিছুদিন আগে। কলেজে ভর্তি হবার আগে, কলেজের সময় সেটা বাড়ে। তারপর আরো বাড়ে, এবং তারপর মাথায় ভূত চাপে।
প্রথমে বিজ্ঞাপনের কাজ, চাকরি, তারপর অনেকদিন বাদে বিজ্ঞাপনের ছবি তৈরি আরম্ভ করে। তারপর ছবির কাজ ২০০৯-তে আরম্ভ করি, ১০-এ শেষ হয়, ১২-তে মুক্তি পায়। এটা একবছর পড়েছিল তৈরি হয়ে—ভূতের ভবিষ্যৎ। প্রযোজকরা বলেছিল হয়তো এটা আর দেখান যাবে না, খুব একটা মনে হয়না এ কদর পাবে, তো যাই হোক তারপর কোনরকমে আমার স্ত্রী কিছুটা উদ্যোগ নিয়ে এটাকে রিলিজ করেছিল এবং তারপর সেখানেও আমায় বলা হয়েছিল, ডিস্ট্রিবিউটরদের কাছ থেকে, ৩ দিনের মতো চলবে এবং তারপর না চললে তুলে দেবো, কারণ বড় বড় হিন্দি ছবি, বাংলা ছবি আছে। তারপর যা হওয়ার হয়েছে। অলমোস্ট কোনরকমই প্রচার ছিলো না। সম্পূর্ণ Word of mouth। সেই সময় নাগাদ এখানে একটা স্টেট পলিটিকস্ একটা বড় আপলিফ্ট হয়, ল্যান্ড একুইজেশন নিয়ে, এবং বেশির ভাগই তখন ল্যান্ড একুইজেশনের বিরুদ্ধে সো কলড্ ইন্টেলেকচুয়ালস ও অন্যরা। কিন্তু তখন আমি একটা খেলা দেখতে পাচ্ছিলাম, বুঝতে পারছিলাম যে এটা একটা সাংঘাতিক বিপদ ডেকে আনছে এবং আমাদের সর্বনাশ হয়ে যাবে, যেটা হয়েছে।
আজ ১২ বছর বাদে, সবাই, একজনও যারা ছিলেন, ঐ ইন্টেলেকচুয়ালস্দের মধ্যে, ফিল্মমেকার হোক, পেইন্টার হোক, তারা সব গর্তে ঢুকে পড়েছেন। তারা একজনও বলতে পারছেন না—আমরা যেটা বলেছিলাম, ঠিক বলেছি। আবার স্বীকারও করছেন না যে–যেটা বলেছিলাম, ভুল বলেছিলাম, অন্যায় করেছি। তার জন্যে এই রাজ্য, রাজ্যের লোক, আমার প্রিয় শহর, ভালোবাসা কথাটা একটু ন্যাকা, কিন্তু এটা আমার শহর, আমি কোথাও ছেড়ে যাইনি। আমার যথেষ্ট সুযোগ ছিলো বম্বেতে যাওয়ার, বা অন্য জায়গায় যাওয়ার, যেখানে অনেক বেশি টাকা কামাতাম, সাধারণ কারণে। কলকাতা একসময়ে বিজ্ঞাপন ইত্যাদির পীঠস্থান ছিলো, কিন্তু সেটা চলে যায়, আস্তে আস্তে মুভ করে যায়, এখানে অনেক কিছু মুভ করে, ইন্ডাস্ট্রিও মুভ করে, হেড অফিসও মুভ করে। সেটা একটা খুব কম্প্লিকেটেড আর্থসামাজিক এবং সোশিও-পলিটিক্যাল অবস্থা, তার ইম্লিকেশন্স রয়েছে। কিন্তু যেটা হয়েছিল, খুব অন্যায় হয়েছিল। তাই বলে আমি বামেদের সাপোর্টার নই, মানে আমি কিন্তু সেই অর্থে, কেতাবি অর্থে বামপন্থী নই।
রিবেরু: প্রগতিশীলদের পক্ষে আছেন।
দত্ত: প্রগতিশীল গালভরা ব্যাপার, কে আবার কোন শীল, অনেকে বলে তারা প্রতিক্রিয়াশীল, তারা প্রগতিশীল। এর তফাৎ জানে না। নিজেদের নামের শেষটাও শীল। তখন আগের গর্ভমেন্টকে তেল মারতো, এখন এদের মারে। আর তো এদের দেখলাম, এদের একটা খুব বাজে, ঘৃণ্য মুখোশ, শুধু মুখোশ পরা, মানে এদের একটা আসল চেহারা বেরিয়ে পড়ল, এখন সবাই সেটা জেনে গেছে, বুঝে গেছে। কিন্তু ঐ সময় আমার খুব রাগ হতো। এবং আমার প্রথম ছবিতেই সেটা এসেছিল, লোকে ঠিক বুঝতে পারেনি যে, বুঝতে পারছে যে এর রেফারেন্স রয়েছে। যদি মন দিয়ে কেউ টাইটেল মিউজিকটা শোনে, তাহলে বুঝবে রেফারেন্সটা।
সেখানে রয়েছে: “মৌন সব বুদ্ধিজীবী, মৌন মিছিল করছে না, এরা-ওরা সুশীল সমাজ, কারো সাথে কেউ লড়ছে না।” সেইসময় কিন্তু তারা মোটেও মৌন ছিলো না। কিন্তু আমি জানতাম যে, এই ক্ষেত্রে তারা করবে না, কারণ এখান থেকে তাদের কোনো স্বার্থ নেই। ভূতেদের আবার কি স্বার্থ? ভূতেরা আবার কনসিউমারও না, তারা পণ্য কেনে না, এবং ভূতেরা ভোটও দেয় না। সুতরাং এদের ইনফ্লুয়েন্স করে কি হবে? So they are left to themselves, এদের নিজেদের হয়ে লড়তে হবে। তো সেই জায়গা থেকে রাজনীতিটা আসে। তারপর আমি উত্তরোত্তর দেখতে পারতাম যে এই অন্যায়-ভণ্ডামি, এবং outright, সরাসরি, এখন তো একটা বীভৎস্য জায়গায় চলে গেছে। আমি জানি না কি করে এরা এখনো, মানে এখানে রয়েছে। এইসব কুকীর্তি করার পর। ঠিক আছে যারা রাজনীতির লোক তারা করেছে, তারা এটাই জানেন, এটাই তাদের লাভ, কিন্তু যারা এই মুখোশধারী সো-কলড্ বুদ্ধিজীবী, বুদ্ধিজীবী কথাটা তো এখানে একটা গালাগালির পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে।
রিবেরু: মানে আপনি বলতে চাইছেন যে, রাজনীতিবিদদের কাছে আমাদের কোনো প্রত্যাশা নেই। তারা এ ধরনের ভোল পাল্টাবেই?
দত্ত: রাজনীতিবিদ বলে আমি সবাইকে সুইপিং করবো না। ঐ যে বলে না—সবাই এক—মোটেও সবাই এক না। কিন্তু আমার মনে হয়, যে দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনৈতিকদের লোকে বেশি পছন্দ করে। কোনো একটা কারণে করে।
রিবেরু: দুর্নীতিগ্রস্তরা বেশি চালাক-চতুর, তাই?
দত্ত: চালাক-চতুর, তারা মনে করে, ভালো মানুষ দেশটাকে চালাতে পারবে না। খারাপ মানুষ চালাতে পারবে। অদ্ভুত একটা যুক্তি খাড়া করেছে, সেই ম্যাকিয়াভেলি বা আমাদের চাণক্যের যে কূট কথাটা। কূটনীতি। ডিপ্লোমেসি। কূট ব্যাপারটা। আমি সেটা মনে করি না। আমি মনে করি একজন সৎ লোকের যথেষ্ট সবল হতে হবে। কিন্তু তার হাতটা সবল করার দায়িত্ব হলো লোকেদের। তো লোকেদের ধারণা, অসৎ ও দুর্নীতিগ্রস্তরা থাকলে, তাদেরকে সহজে ইয়ে করে কিছু ফায়দা তুলে নেওয়া যায়। আমি টুক করে এদের সাথে থাকব, ঘেঁষাঘেষি করবো, ওদের সাথে নাম লেখাবো, ওদের হয়ে ভোটে লুট করবো, আমি তার ফায়দা পাবো। এটা অনেক সহজ। এবং কে কার কাছে থাকবে, সেটা নিয়ে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব, এ ওকে, একই পার্টির, মেরে দিচ্ছে।
কোনরকমে শাসক দলের কাছে থাকা। এ যে আগে একেবারেই ছিলো না, তা না। কিন্তু এরকম প্রকাণ্ড বীভৎস্য আকারে ছিলো না। এটা দেখে আমার রাজনীতিতে আগ্রহ আসে।
আমার ছবিগুলো খুব রাজনৈতিক হবে, এটা আগে থেকে মনোস্থির করা থাকে না–ইনফ্যাক্ট ‘ভূতের ভবিষ্যৎ’ প্রথম যখন ভাবছিলাম, তখন রাজনীতির ব্যাপারটা এত বড় করে আসেনি। কিন্তু আমি দেখলাম এই ছবির পরিসর যা তার ভেতর রাজনীতি নিয়ে খুব সহজে ঢুকে পড়তে পারি। মানে তৎকালীন রাজনীতি ঢুকে পড়তে পারে, এবং তারপর আমি ভীষণ রেগে গিয়ে একটা সময় আরো সরাসরি করেছিলাম। সেই সময় সিনেমা বানানোটা আমার মূখ্য উদ্দেশ্য ছিলো না। সিনেমাটা কতোটা ভালো হচ্ছে বা খারাপ হচ্ছে সেটা দেখার বিষয় ছিলো না।
উৎপল দত্ত বলে গেছেন “Theater to me is a tool of political propaganda.”। তখন আমি জানতাম সিনেমা করলে লোকে দেখবে। আমি ছবি আঁকলে এখনো সেই জায়গায় যায়নি যে সেটা দেখবে, বা লিখলে লোকে পড়বে, আমার কলমে তেমন ধার নেই। তো ছড়া-টরা লিখি, সেটা দেখে লোকে হাসবে, কিন্তু সাংবাদিকতা করে যে কিছু হবে তাও না, বা বোমা-টোমা ছোড়ার তো সেই অভিজ্ঞতাও নেই। কিন্তু ঐ রাগটা কোথা দিয়ে বের করব? ছবি দিয়ে করা হয়েছে, এবং তার ফলন স্বরূপ যা হবার হয়েছে। এটাকে তুলে নিয়েছিল এখানকার গভর্মেন্ট। একারণে এখানকার গভর্মেন্টকে, সিনেমার ইতিহাসে এবং পলিটিকসের ইতিহাসে এই প্রথম বোধহয় একটা স্টেট গভর্মেন্ট একটা প্রডিউসারকে ২১ লাখ টাকা জরিমানা দিলো।
রিবেরু: এটা ‘ভবিষ্যতের ভূতে’র জন্য?
দত্ত: হ্যাঁ, ২০১৯ সালে। জরিমানা দিতে হলো। বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়দের বেঞ্চ স্পষ্ট জানিয়ে দেয়, তোমরা রাজ্যের মুখ্যসচিব, স্বরাষ্ট্র সচিব ও ডিজি, তোমাদের দায়িত্ব হলো, যে যে হলে ছবিটি দেখানো হচ্ছিল, সেই সেই হলে ছবিটি ফেরত আনা। আমরা তো জানি না কারা দেখাচ্ছে না, এটা বললে হবে না। হয় তোমাদের ধরবো, নয় তো এটাকে আদালতের অবমাননা ধরে নেবো, দিল্লিতে ডাকব।
যাক, তারপর থেকে আমার ছবিতে রাজনীতি খুব খোলাখুলিভাবে নেই। যেমন, ‘বরুণবাবুর বন্ধু’ ছবিতে দেখা যায়। সেরকম করে রাজনীতি নেই। একটা সময় আমার ভেতর পলিটিক্যাল ফিলোসফি গ্রো করেছিল, আমি যাদের দেখে কিছু উৎসাহ পেতাম। আমি নিজে বামপন্থী হবার যোগ্য নই। সেটা হতে যা যা জিনিস দরকার, সেই অধ্যাবসায় বা সেই পঠন-পাঠন, বা সেই স্যাক্রিফাইস, কোনটাই আমার নেই এবং আমি মার্কস পড়ে পাঠোদ্ধার করে ডায়াল্যাকটিক্যাল মেটেরিয়ালিজম কী সেটা বুঝে উঠতে পারিনি। কিন্তু আমি অনেক বামপন্থীদের দেখেছি দেখেছি, যাদের প্রতি আমি শ্রদ্ধাশীল। সেই রকম একজন, যারা পার্টি পলিটিকসে নট-নেসেসারিলি থাকেন, তারা অনেক সরে গেছেন হয়তো পার্টি পলিটিকস থেকে, সৌমিত্রদার (সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়) চরিত্রটা কিছুটা ঐ আদলে তৈরি, এবং সেটা পরিষ্কার বোঝা যায়, কিন্তু it is not topic about an overt political situation।
রিবেরু: মৃনাল সেন যেভাবে বলতেন, আই অ্যাম আ প্রাইভেট মার্ক্সিস্ট। আপনিও কি তেমনটা ভাবেন নিজেকে?
দত্ত: না, আমি মার্ক্সিস্ট নিজেকে বলবো না। কারণ আমার মার্কস যথেষ্ট পড়া না এবং যেটুকু পড়ার চেষ্টা করেছি অনেকটা না পড়ার মতোই। প্রথমে ইকনোমিক্সের সাথে আমাদের পলিটিক্যাল সাইন্স ছিলো, আমাদের জেসুইট ফাদার পড়িয়েছিল মার্ক্স এবং এঙ্গেলস। তো তার ইন্টারপ্রিটেশন এবং নিজে পড়তে গিয়ে যতটুকু পড়ে বুঝেছি। এটা শুনে আবার ভীষণ ক্ষেপে গিয়েছিল এখানকার লোকজন। মানে যারা মনে করতো আমি বামপন্থী। মানে এর বিরুদ্ধে বলছে, তার মানে এ বিরোধী।
রিবেরু: মানে পোলারাইজেশন করে ফেলছে?
দত্ত: হ্যাঁ, পোলারাইজেশন। আমি বারবার বলছি, বাবা, সকাল বেলা উঠে কেউ কি বামপন্থী হয়ে যেতে পারে? একটা induction দরকার হয়, একটা grooming দরকার হয়। আমি সর্বহারাদের মুখপাত্র নই। আমি নিজে সেটা খুব ভালোই জানি। মানে আমি এই পুরো বামগিরি বা সেটার মধ্যে আমি নেই। সেটুকু সততা তো আমার আছে। তবে আমি যা, সেটাকে পুরোপুরি, ওপেনলি খুলে ধরবো। কিন্তু এটা আমাকে রাগায়, আমি মনে করি না যে, এই সম্পূর্ণ সংস্কার আমি করতে পারবো বা এই মূহুর্তে অন্য কেউ করতে পারবে। কিন্তু যা চোখে পীড়াদায়ক এবং সামাজিক ভাবে নিজেকে, কি বলবো, খুব লজ্জিত বোধ করি, এরকম কিছু জিনিস এখনো চলেছে, যেই জিনিসগুলোকে রিভার্স করা যায়। মানে একটা খুব সহজ, সেটা প্রকৃতির নিয়মে, মানে বিরাট একটা ডায়ালেকটিস বুঝতে হবে না।
একটা নদীতে যদি বাধ দিয়ে একটা জায়গায় বাধের জল উঠে প্রায় কানায় কানায় হয়ে যায়, উল্টো দিকটা শুকনো। তাহলে সেটাই ঐ বাধটাকে, দেয়ালটাকে ভেঙ্গে বেরিয়ে আসবে। It is never healthy। বড়ধরনের সম্পত্তির বৈষম্য। আবার এটাও না যে আমি মনে করি যে একটা মেধার আলাদা কদর থাকবে না। সেটা থাকবে।
রিবেরু: একজন সংবেদনশীল শিল্পী হিসেবে আপনি যতটুকু বলার তা বলবেন, এটাই তো?
দত্ত: নিজেকে নিজে সংবেদনশীল বলাটা ঠিক না। সেটা অন্যরা ঠিক করবেন (হাসি)
রিবেরু: সংবেদনশীল না হলে কেউ তো ‘ভূতের ভবিষ্যৎ’ এবং এরপর ‘ভবিষ্যতের ভূত’ তো বানাতে পারেন না?
দত্ত: সেটাই তো বলছি, ‘বরুণবাবুর বন্ধুতে’ও ছিলো কিন্তু। সেটা আবার পুরনো নকশাল আমলটা উঠে এসেছিল, স্বাধীনতা সংগ্রাম, সেটার নাম হলো ‘মেঘনাদবধ রহস্য’। এটা ইন্টারেস্টিং, যে সময়গুলো ধরা। মানে আমরা তো কোন একটা suspended universe, একটা black space-এ exist করি না। আমাদের পরিপার্শ্ব আমাদের উপর ছাপ ফেলবেই। যখন ‘অপরাজিতে’র ভেতরে ফিল্ম সোসাইটি করে প্রথম ছবি দেখাচ্ছে, তখন ওরা যে Battleship Potemkin দেখাচ্ছিল, সেটা জেনে ওদের বাড়িতে পুলিশ চলে এসেছিল। তো সেই যে ওই সময়ে প্রথম এদের কানগুলো খাড়া হয়েছে, অনেকটা ম্যাকার্থি (McCarthy) যুগের সাথে মিল রয়েছে, যে এরা কমিউনিস্ট। সেই করতে গিয়ে, মানে কি রকম বোকামি, চার্লি চ্যাপলিনকে কমিউনিস্ট বলে তাকে অস্কার দিলোনা এবং ফাইনালি যখন সত্যজিৎ রায়ের মতো করে লাইফটাইম এচিভমেন্ট দিচ্ছে, বলেছিলো উনি যেন দু মিনিটের বেশি কথা না বলেন। তো উনি এসে খালি লাভ ইউ, লাভ ইউ বলেছেন, আর কিচ্ছু বলেননি।
রিবেরু: চ্যাপলিনকে তো কেজিবির চরও বলা হয়েছিল। জবাবে চার্লি বলেছিলেন, আই অ্যাম আ প্রো-কমিউনিস্ট।
দত্ত: হ্যাঁ। ও বলেছিলো যে যদি সবাইকে ভালোবাসা এবং লোকেদের ভালো হওয়াটা, চাওয়াটা যদি কমিউনিজম হয়, তাহলে আমি কমিউনিস্ট। এখন তার ঈশ্বর বিশ্বাস কি, কেন, সেগুলো ইত্যাদি ইত্যাদি অন্য ব্যাপার, আরেকটু বেশি থিয়োরেটিক্যাল। কিন্তু ওকে কিচ্ছু করতে হয়নি ১২ মিনিট ধরে সবাই হাততালিই দিয়েছিল। সেই হাততালির মধ্যে যারা দাঁড়িয়েছিল চরম ক্যাপিটালিস্টও ছিলো তার মধ্যে। এটাই মজাটা। পিকাসোর খেয়ে দেয়ে আর কোন কাজ ছিলো না যে বসে বসে গোয়ের্নিকা আঁকবে। সেই সময় ওর চরম নাম, কিন্তু ঐ চান্সটা নিয়েছিল।
রিবেরু: রাজনৈতিকভাবে বহিঃপ্রকাশের সুযোগ।
দত্ত: যেটা বলছিলেন সেন্সিটিভিটি যদি থাকে, তা সেই ফোস্কার মতো বের হবে, র্যাশের মতো বেরোবে। ধরে রাখতে পারবে না, আর যারা রাখতে পারবে তাদের ব্যাপারে আর কী বলবো। তাদের মধ্যে এই যে কাপুরষতা, এই যে একটা ভীতু ভীতু ব্যাপার, এটা তাদের কাজেও প্রকাশ পেয়ে যায়। যে কাজটা করতে যাচ্ছো, সেই কাজের জোরটাও চলে যাবে।