• ঢাকা
  • রবিবার, ২৪ নভেম্বর, ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

স্বাধীনতার জন্য ভয়কে জয় করেছিলাম: রমা


সালেক খোকন
প্রকাশিত: মার্চ ২৬, ২০২৩, ০২:২৪ পিএম
স্বাধীনতার জন্য ভয়কে জয় করেছিলাম: রমা

একাত্তরের বীর নারী মুক্তিযোদ্ধা রমা রানী দাস। এক বিকেলে তাঁর বাড়িতে বসেই আলাপ চলে শৈশব, কৈশোর আর মুক্তিযুদ্ধের নানা বিষয় নিয়ে।

রমা রানীর বাবা নগেন্দ্রনাথ দাস আর মায়ের নাম অঞ্জলী রানী দাস। বাড়ি বরিশালের গৌরনদী উপজেলার গৈইলা গ্রামে। দুই ভাই ও দুই বোনের মধ্যে রমা দ্বিতীয়। বাবা ছিলেন পোস্টমাস্টার। বদলির চাকরি হওয়ায় বাবার সঙ্গেই রমাদের জীবন কেটেছে একেক জায়গায়। তার লেখাপড়ায় হাতেখড়ি বরিশাল মিউনিসিপাল স্কুলে, ঝাউতলায়। এরপর তিনি ক্লাস থ্রিতে ভর্তি হন ঝালকাঠিতে, গণেশ দাস উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় (বর্তমানে-হরচন্দ্র সরকারি বালিকা বিদ্যালয়)। ম্যাট্রিক পাস করেন ১৯৬১ সালে এবং ইন্টারমিডিয়েট ১৯৬৩ সালে। তিনি গ্র্যাজুয়েশন করেন চাখারে, ফজলুল হক কলেজ থেকে। এরপর মাস্টার্সে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, বাংলা বিভাগে। তখন শিক্ষক ছিলেন নীলিমা ইব্রাহিম, আব্দুল হাই, মুনীর চৌধুরী, আনিসুজ্জামান প্রমুখ। মুক্তিযুদ্ধের আগেই তাদের মাস্টাসের্র্র ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হয়ে যায়। বাকি ছিল শুধু মৌখিক পরীক্ষা।

মুক্তিযোদ্ধা রমা রানী দাসের সাক্ষাৎকার নেন মুক্তিযুদ্ধ গবেষক সালেক খোকন

 

প্রশ্ন: ২৫ মার্চ রাতে আপনি কোথায় ছিলেন? আপনার সেই দিনের স্মৃতি দিয়ে আমরা আলাপ শুরু করি।

রমা রানী দাস: ২৫ মার্চ থেকে সারা দেশে পাকিস্তানি আর্মি নামে। মানুষ তখন পালাতে থাকে। ঝালকাঠিতেও আসে বহু লোক। তাদের মুখে মুখে নির্যাতন আর হত্যার খবর। গ্রামে গ্রামে তখন গঠন করা হয় শান্তি কমিটি। বাবা বললেন, এখন আর এ জায়গাটা নিরাপদ নয়। তাই আমাদের পাঠিয়ে দেন মামাবাড়িতে, স্বরূপকাঠি থানার কামারকাঠি গ্রামে।

মামাবাড়ির দোতলায় বসে দেখতাম ঝালকাঠি শহরের আগুনের লেলিহান। বুকের ভেতরটা তখন হু হু করে উঠত। কিছুদিন পরে ওখানেও শান্তি কমিটির লোকদের উৎপাত শুরু করে। শিক্ষিত ছেলেমেয়েরা কে, কী করছে—ওরা খবর নিত। আমরা যে শিক্ষিত এটা বুঝতে দিতাম না। গ্রামের নারীদের মতোই শাড়ি পরে থাকতাম। কাদার দাগও লেগে থাকত শরীরে। কিন্তু তবু শেষ রক্ষা হয় না। গ্রামের ধর্মভীরুদের নজরে পড়ে যাই। আমাদের নিয়ে নানা প্রশ্ন  তোলে তারা। একবার মায়ের এক আত্মীয়কে গুলি করে মারা হয় ওখানে। তখনই আমরা সরে যাই ভীমরুলিতে, পেয়ারাবাগানের দিকে।

মাইলকে মাইল পেয়েরার গাছ। দুই পাশে বাগান, মাঝখানে ছোট্ট খাল। মাঝেমধ্যেই গোলাগুলির শব্দ পেতাম। ওখানে আর্মিরাও আসত স্পিডবোটে। সঙ্গে থাকত দালাল আর শান্তি কমিটির লোকেরা। খালের পানিতে শরীর ডুবিয়ে কচুরিপানায় মাথা লুকিয়ে রাখতাম আমরা। সারা দিন এভাবেই কাটত। সন্ধ্যায় ওরা চলে গেলে বেরিয়ে আসতাম।

বাগানিদের ছোট্ট টিনের ঘরে আশ্রয় ছিল আমাদের। জায়গা না হলে মাথার নিচে ইট রেখে মাটিতেই শুয়ে রাত কাটাতাম। খাবার ছিল ঢেঁঢ়স আর চিচিঙ্গা সিদ্ধ। কোনো দিন তা-ও জুটত না। এভাবেই কেটেছে দিনের পর দিন।

পেয়ারাবাগানের পাশেই ছিল মাদ্রা স্কুল। শুনলাম সেখানে ক্যাপ্টেন মাহফুজ আলম বেগ নামে একজন এসেছেন, দলবলসহ। উনি স্থানীয় ছেলেমেয়েদের ট্রেনিং করান। তার কাছেই যুদ্ধের প্রাথমিক ট্রেনিং নিই। আর্মিদের থেকে নিজেকে সেভ করা, গ্রেনেড থ্রো আর রাইফেল চালানো রপ্ত করি। বীথিকা বিশ্বাসসহ আরও মেয়েরা ছিল ওখানে। এরপরই বেগ সাহেব চলে যান অন্যত্র।

দেশের অবস্থা ক্রমেই খারাপ হতে থাকে। রাজাকারদের উৎপাতও তখন শুরু হয়ে যায়। বড় ভাই সপ্তব্রত দাস নতুন চাকরি নিয়েছেন, পোস্টাল ডিপার্টমেন্টে। ছোট ভাই ম্যাট্রিক দিয়েছে। পরিচিত এক দালালের কাছে আমাদের তিনজনকেই বাবা তুলে দেন ইন্ডিয়ায় নিয়ে যেতে।

যেসব জায়গা দিয়ে সচরাচর মানুষ চলত না, সে পথেই চলতে হয়েছে। কোথাও পানি, কোথাওবা হাঁটু অবধি কাদার পথ। বড় লাঠিতে ভর দিয়ে পথ পেরোই আমরা।

যশোরের সীমান্তবর্তী গ্রামে ছিল শান্তি কমিটির এক চেয়ারম্যানের বাড়ি। নামটা এখন মনে নেই। লোকজনসহ তার বাড়িতে গিয়ে উঠি আমরা। কিন্তু তার পরিচয় জানা ছিল না। উনি চালের ব্যবস্থা করে দিলেন। রান্নাবান্না ও খাওয়াদাওয়াও করালেন। রাতে শুনি উনি শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান। ভাবলাম, এবার আর রক্ষা নাই। সবাইকে ধরিয়ে দেবে আর্মি ডেকে। কিন্তু কি আশ্চর্য! উনি তা করলেন না। বরং খুব ভোরে গরুর গাড়ি ডেকে তার লোকদের দিয়ে বর্ডার পার করিয়ে দিলেন। সিএমবির রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় পাকিস্তানি সেনারা জানতে চাইল—গাড়ি কোথা থেকে এসেছে। ওই চেয়ারম্যানের নাম শুনতেই ছেড়ে দিল।

ওই লোকের সহযোগিতা না পেলে হয়তো বেঁচে আসতে পারতাম না। একাত্তরে সব মানুষ কিন্তু খারাপ ছিল না। মানুষ ঠেকলে অনেক কিছুই করে। শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান হয়েও সে বর্ডার পার করে দিয়েছিল। তবে সব চেয়ারম্যান এমন ছিল না।

বাগদা বর্ডার দিয়ে ঢুকে আমরা চলে যাই ভারতের টালিগঞ্জে, মাসির বাড়িতে। পরে বাবা এলে ওখানেই একটা ছোট্ট বাসা ভাড়া নিই। ভারতীয় লোকেরা আমাদের দেখলেই বলত, ‘এই যে জয় বাংলা আসছে। আইসা সবকিছুর দাম বাড়াইয়া দিসে।’ খুব ‘কিটিসাইজ’ মনে হইত। দু-এক সময় প্রতিবাদও করতাম। মনে হতো এভাবে শিয়াল কুকুরের মতো বেঁচে থেকে কি হবে। অন্তত দেশের জন্য কিছু করা উচিত। তখনই সিদ্ধান্ত নিই যুদ্ধে যাওয়ার।’

 

প্রশ্ন: তখন মেয়েদের অবস্থা বা নারী হিসেবে আপনার অবস্থা কেমন ছিল?

দাস: মেয়েদের লেখাপড়ায় রেসটিকশন ছিল। কিন্তু আমার মা-বাবা দুজনই ছিলেন উন্নতমনা। মা বাড়িতে গানের শিক্ষক রেখেছিলেন। বরিশালের ফণী স্যারের কাছে শিখতাম নাচ। আর স্কুলশিক্ষক বীরন্দ্রনাথ দে’র কাছে শিখেছি আবৃত্তি।

ঝালকাঠিতে ক্লোজ ফ্রেন্ড ছিল অর্চনা ও আলো ব্যানার্জি। সংস্কৃতিমনা ছিলাম। নাচ, গান, নাটক ও আবৃত্তি করতাম। একবার স্কুলের এক অনুষ্ঠানে আসেন ডিএম সাহেব। আমাদের অনুষ্ঠান দেখে খুশি হন। অতঃপর ডেকে পাঠালেন। বললেন, ‘তোমরা কী চাও, কী পুরস্কার দেব? উত্তরে সাহস করে বলি, ‘স্যার, ব্যক্তিগতভাবে কিছুই চাই না। স্কুলে পানীয় জলের খুব অভাব। এখানে একটা টিউবওয়েল হলে সবাই বিশুদ্ধ পানি পান করতে পারত।’ সঙ্গে সঙ্গেই উনি টিউবওয়েল বসানোর নির্দেশ দিলেন। ওই দিন শিক্ষকরা খুব খুশি হয়েছিল। টিউবওয়েল বসানোর পর আমার কী যে আনন্দ লেগেছে!

ম্যাট্রিকের মাত্র এক মাস আগে মা মারা যান। বাবাই তখন সব। তিনি বলতেন, ‘একটা ছেলেকে লেখাপড়া না করালেও চলে। সে রিকশা চালিয়ে বা কুলিগিরি করেও খেতে পারবে। কিন্তু একটা মেয়ের পক্ষে তা সম্ভব নয়। মেয়ের জীবনে অনেক বিপর্যয় আসতে পারে। তাই একটা নারী যদি স্বনির্ভর হয়, তবে তার পরিবারটাও টিকে যায়।’ নারী শিক্ষার পক্ষে ছিলেন বাবা। জোর দিয়ে বলতেন, ‘তোমাকে এমএ পাস করতেই হবে।’ বাবার উৎসাহই ছিল আমার শক্তি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকতাম সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার হোস্টেলে, পিলখানায়। সেটাই এখন কুয়েত মৈত্রী হল। পূর্ণিমা ও হাসির কথা খুব মনে পড়ে। দুজনই ছিল টিভি আর্টিস্ট। তখন মতিয়া চৌধুরী ছিলেন সিনিয়র আপা। সমস্ত আন্দোলনে তিনি ডাকতেন। আর জিএস আয়শা খানম। ছাত্র আন্দোলন তুঙ্গে। ক্লাসও খুব কম হতো। আমরা মিটিংয়ে যেতাম। সরাসরি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলাম না। কিন্তু দেশের বৈষম্যের কথা জেনে চুপ থাকতে পারিনি। দেশের টানেই পথে নেমেছি, মিছিল করেছি। তখন ওটাই ছিল সবচেয়ে বড় রাজনীতি।

৭ মার্চ ১৯৭১। রমা রানী দাস রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণটি শোনেন। সকাল থেকেই সেখানে জমা হতে থাকে হাজার হাজার লোক। বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শক্রুর মোকাবিলা করতে হবে....আমি যদি হুকুম দেবার না পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে....।’ এই নির্দেশনাই রমা রানীর মনে ঝড় তোলে। ক্রমেই মানুষ স্বাধীনতার পক্ষে ঐক্যবদ্ধ হতে থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস হয় বন্ধ। ফলে রমা রানী চলে যান বাবার কাছে, ঝালকাঠিতে।

 

প্রশ্ন: ট্রেনিং নিলেন কোথায়?

দাস: এক মাসিকে সঙ্গে নিয়ে যাই নয় নম্বর সেক্টরের হেডকোয়ার্টার, হাসনাবাদে। বাস থেকে নামতেই দেখা হয় ক্যাপ্টেন বেগের সঙ্গে। পেয়ারাবাগানে যিনি অস্ত্র চালানো শিখিয়েছিলেন। উনি সেক্টর কমান্ডার মেজর এম এ জলিল সাহেবের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার আগ্রহ দেখে মেজর জলিল খুশি হয়ে বলেন, ‘আরও বিশ-পঁচিশটা মেয়ে আছে। মেয়েদের এই গ্রুপটির দায়িত্ব আপনি নেন।’ রাজি হয়ে গেলাম। ক্যাম্পের ভেতর এক বাড়ির দোতলাতে থাকতাম। নিচে সেন্ট্রি থাকত। কেউ ভেতরে ঢুকতে পারত না। শুধু সেক্টর কমান্ডার পনের দিন পর পর এসে খোঁজ নিয়ে যেতেন।

মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে ওখানে বিভিন্ন জায়গা থেকে এসেছিল মেয়েরা। বীথিকা বিশ্বাস, হাসি, মিনতি, কনক প্রভা মণ্ডল, সমিরন, হরিমন বিশ্বাস, রুনু দাস প্রমুখ ছিলেন। আমাদের ট্রেনিং চলে টাকিতে, ইছামতি নদীর পাড়ে। যশোর ক্যান্টনমেন্টের সুবেদার মেজর মাজেদুল হক সাহেব ছিলেন ট্রেনার। রাইফেল, গ্রেনেড, অ্যাক্সপ্লোশিভ, স্পাইং—এগুলো ছিল ট্রেনিংয়ের মূল বিষয়। ওই সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে কথিকাও পাঠ করতাম। ওরা ক্যাম্পে এসে রেকর্ড করে নিয়ে যেত। জহির রায়হানও এসেছিলেন একবার। আমাদের অনেক ছবি তুলে নেন তিনি।’

 

প্রশ্ন: নারী মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আপনাদের কাজ কী ছিল?

দাস: স্পাইং করা ছিল মূল কাজ। নানা খবর নিয়ে বিভিন্ন ক্যাম্পে যেতাম। সাতক্ষীরা, ভোমরা, আসাশুনিতে যারা আওয়ামী লীগার ছিলেন তাদের ওখানে যেতাম ছদ্মবেশে। পথে পাঞ্জাবিদের গতিবিধি, কোন রাস্তায় তারা থাকে, কীভাবে থাকে, কয়জন গাড়ি থামিয়ে সার্চ করে, কি অস্ত্র, কয়টা অস্ত্র আছে—এমন খবর নিয়ে হেডকোয়ার্টারে দিতাম। রিপোর্ট করতাম মেজর জলিলের কাছে। ক্যাম্পে মাঝেমধ্যেই শেলের শব্দে আতঙ্কিত হয়ে যেতাম। জীবনের ঝুঁকি ছিল খুব। ধরা পড়লেই মারা পড়তে হবে। এমনটা জেনেও স্বাধীনতার জন্য ভয়কে জয় করেছিলাম আমরা। দেশ যেদিন স্বাধীন হয় ক্যাম্পের ভেতর আমরা নাচতে শুরু করি। ওই দিনের অনুভূতি ঠিক ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। চোখের জলে চোখ ভিজিয়ে আনন্দটা অনুভব করি আমরা।’

চুয়াত্তর বছর বয়সী এই বীর নারীর এনগেইজমেন্ট হয়েছিল যুদ্ধের আগেই, পার্থ সারথী দাসের সঙ্গে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে বদলে যায় সবকিছু। কারও সঙ্গে কোনো যোগাযোগও থাকে না। রমা রানী ভেবেছিলেন বিয়েটা আর হবে না। কিন্তু নয় নম্বর সেক্টরের রণাঙ্গনেই তার সঙ্গে দেখা হয় হবু স্বামীর। তিনিও তখন দেশের টানে মুক্তিযুদ্ধে এসেছেন। অতঃপর স্বাধীনের একদিন পর কলকাতার কালীঘাটে রমা রানী আর মুক্তিযোদ্ধা পার্থ সারথী দাসের বিয়ে হয় শুধু মন্ত্র উচ্চারণের মাধ্যমে। রমা দাসের ভাষায়—‘এখনো বলি, আমার জীবনে বিয়ের সানাই বাজেনি। সে সৌভাগ্য ছিল না তখন। মেজর জলিল সাহেবের যিনি রান্না করতেন ওনাকে দাদু বলে ডাকতাম। ত্রিশ টাকা দিয়ে তিনি একটা লাল শাড়ি কিনে দিয়েছিলেন। ওটাই ছিল বিয়ের শাড়ি। তবে কোনো আফসোস নেই। দেশের জন্য আমরা তো মরতে গিয়েছিলাম। দেশ তো পেয়েছি। ফিরে এসেছি এটাই ভাগ্য।’

মুক্তিযুদ্ধে বীর নারীদের ইতিহাস উপেক্ষিত হয়ে আছে বলে মনে করেন মুক্তিযোদ্ধা রমা রানী দাস। তিনি অকপটে বলেন, ‘স্বাধীনের পর নারী মুক্তিযোদ্ধাদের গ্রুপটিকে নেওয়া হয় খুলনায়। এরপর একটা ডিসচার্জ সনদ দিয়ে সেক্টর কমান্ডার সকলকে বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। কিন্তু কল্পনা নামের একটা মেয়ের আত্মীয়স্বজনের কোনো হদিস পাওয়া যায়নি। তার পারিবারের সবাইকে মেরে ফেলা হয়েছিল। আমাদের বাড়িটাও পাকিস্তান সেনা ও রাজাকারেরা একদম পুড়িয়ে ছাই করে দেয়।

অথচ সমাজ তখন বিশ্বাসই করেনি নারীরা যুদ্ধ করতে পারে। মুক্তিযুদ্ধ করেছে কনক প্রভা মণ্ডল। এ কারণে সমাজ তাকে পরিত্যাগ করেছিল। নারী হওয়ায় পাছে লোকেরা তাকে চরিত্রহীন বলবে। তাই ডিসচার্জ লেটারটাও স্বামী ছিঁড়ে ফেলে। এ কারণে আজ পর্যন্ত কনক মুক্তিযোদ্ধার সনদ পায়নি। একটা মেয়ে আছে তার। সে এখন চাকরির জন্য হন্যে হয়ে ঘুরছে। এই মুক্তিযোদ্ধার জীবন কাটছে অবহেলা আর অনটনে। দেশ তাকে মনে রাখেনি। কাগুজে সনদ নেই। তাই তার কদরও নেই। 

প্রথম দিকে আমি নিজেও সনদ নিইনি। ডিসচার্জ সনদটা ছিল। মেয়েরা তখন মাস্টার্সে পড়ছে। মনে করলাম সার্টিফিকেটটা নিই। ঢাকায় গেলাম, মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলে। আহাদ চৌধুরী তখন দায়িত্বে। ওরা বলল আপনার অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার দেখান। আমি তো অবাক। একাত্তরে কী অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার নিয়ে মানুষ মুক্তিযুদ্ধ করতে গেছে! ডিসচার্জ দেখালাম। বলল—‘নারী মুক্তিযোদ্ধা ছিল বলে আমাদের জানা নাই’। খুব খারাপ লাগল। মনের কষ্টে ওই দিন বিকেলেই হার্ট অ্যাটাক করেছিলাম। বিষয়টি তখন গণমাধ্যমে চলে আসে। সাংবাদিকদের লেখার শক্তিতে মুক্তিযোদ্ধার সনদটা পেয়েছি। মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশ নেওয়া ছাড়াও একাত্তরে নারীরা নানাভাবে কাজ করেছে। তাদের সে ইতিহাসের কথা তুলে আনতে না পারলে মুক্তিযুদ্ধের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাসও হবে না।

 

প্রশ্ন: স্বাধীনের পর ভারতে ভালো চাকরির প্রস্তাবও ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘এই দেশকে আমার দেশ মনে হয় না। আমি আমার নিজের দেশে ফিরে যাব।’ পরে ঝালকাঠি গার্লস স্কুলে তিনি শিক্ষকতা করেন দীর্ঘ ৫৮ বছর। যে দেশের জন্য মুক্তিযুদ্ধ করলেন স্বপ্নের সে দেশ কি পেয়েছেন?

দাস: (প্রশ্নের উত্তরে খানিক নীরবতা) অসাম্প্রদায়িক দেশের স্বপ্ন দেখেছিলাম। আরও সুন্দর বাংলাদেশ চেয়েছিলাম যেখানে হিংসা, মারামারি আর দুর্নীতি থাকবে না, যোগ্যতার ভিত্তিতে যোগ্য লোকের চাকরি হবে, ঘুষ-বাণিজ্য থাকবে না, সাধারণ মানুষ পেটপুরে খেতে পারবে। এখন তো অফিস আদালত সব জায়গাতেই দুর্নীতি দেখি। এ রকম দেশ তো চাইনি।’

কষ্ট নিয়ে রমা রানী আরও বলেন, ‘আমরা তো চিন্তাও করি নাই এত তাড়াতাড়ি দেশ স্বাধীন হবে। হয়তো এ কারণে অনেকেই বুঝে না স্বাধীনতা কী! যাদের ফ্যামিলির লোক মারা গেছে, যারা যুদ্ধাহত বা মুক্তিযোদ্ধা, স্বাধীনতার কষ্টটা শুধু তারাই বুঝছে। আর এ কারণেই দেশে এখনো রাজাকার আর স্বাধীনতাবিরোধীদের অভাব নেই। স্বাধীন দেশে এখনো পাকিস্তানপ্রীতি লোক অনেক। যারা স্বাধীনতা ভোগ করলেও মনেপ্রাণে সর্পোট করে পাকিস্তানকে।

 

স্বামী মুক্তিযোদ্ধা পার্থ সারথী দাসের সঙ্গে রমা রানী দাস। ছবি: সালেক খোকন

 

প্রশ্ন: জিয়াউর রহমানের শাসনামল কেমন ছিল?

দাস: উনি একাত্তরকে ধরে রাখতে পারেননি। রাজাকারদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন। এ দেশে রাজাকারদের প্রতিষ্ঠিত করেন জিয়া। তাদের গাড়িতে লাল-সবুজের পতাকা উড়িয়ে মুক্তিযোদ্ধাদেরই অসম্মান আর অপমানিত করেছিলেন। তখন বঙ্গবন্ধুর নাম মুখেই আনা যেত না। প্রতিবাদ করলেই অ্যারেস্ট করা হতো। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর এ দেশে কেমন শাসন চলেছে, সেটাও প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে হবে।

 

প্রশ্ন: দেশ কেমন চলছে?

দাস: আমি বলব সৎ যারা তারা খুব কষ্টে আছে। চারদিকে কোটিপতির ছড়াছড়ি। দেশের কল্যাণের কথা, সাধারণ মানুষের কথা চিন্তা করা উচিত। সততা না থাকলে তো দেশকে এগিয়ে নেওয়া যাবে না।

 

প্রশ্ন: কী করলে দেশ আরও এগোবে? 

দাস: বঙ্গবন্ধুর কন্যার মতো সৎ আর শক্ত নেতৃত্বের ভীষণ প্রয়োজন। উনি নিজের দলের লোকদেরও ক্ষমা করেননি। তার ওপর সাধারণ মানুষের আস্থাও বেড়েছে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি অব্যাহত থাকলে দেশের চেহারা পাল্টে যাবে। মনে রাখতে হবে, জুয়াড়িদের কোনো রাজনীতি থাকে না। নিজের স্বার্থে তারা শুধু রাজনীতিটাকে ব্যবহার করে।

 

প্রশ্ন: পরবর্তী প্রজন্মের জন্য কিছু বলবেন?

দাস: তোমরা মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাসটা পড়ে দেখো। ভুল ইতিহাসে বিভ্রান্ত হইও না। সৎ জীবনযাপন করো। টাকার মোহে নিজের বিবেককে বিক্রি করে দিয়ো না।

কথাপ্রকাশ বিভাগের আরো খবর

Link copied!