মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী ছিলেন মননশীল প্রবন্ধকার, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের গবেষক, শিক্ষাবিদ এবং শহিদ বুদ্ধিজীবী। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের শেষলগ্নে পাকিস্তান সেনাবাহিনী, রাজাকার ও আল-বদর বাহিনীর বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের অংশ হিসেবে তিনি অপহৃত ও পরে শহীদ হন। ১৯৭১ সালের ১৪ই ডিসেম্বর আল-বদর বাহিনী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীকে তাঁর কনিষ্ঠ ভাই লুৎফুল হায়দার চৌধুরীর বাসা থেকে অপহরণ করে। এরপর তাঁর আর কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। ধারণা করা হয়, ওই দিনই তাঁকে হত্যা করা হয়। সংবাদ প্রকাশের কাছে শহিদ পিতার স্মৃতিচারণ করেন তানভীর হায়দার চৌধুরী। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন খাদিজা নিপা।
সংবাদ প্রকাশ : আপনার বাবাকে যেদিন ধরে নিয়ে যায়, দিনটি কেমন ছিল?
তানভীর হায়দার চৌধুরী : ৮ ডিসেম্বর আমার বাবা ক্যাম্পাস ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। কারণ এরই মধ্যে কানাঘুষা শুরু হয়ে গিয়েছিল যে এ রকম ঘটনা ঘটতে পারে। তো ৮ ডিসেম্বর তিনি প্রথমে যান তাঁর মামাশ্বশুরের বাড়িতে। তারপর তো ভারত সরাসরি যুদ্ধ করেছে। তখন বাড়িতে অনেকে ছিল। আমার বাবা নিভৃতচারী মানুষ ছিলেন। তাই তিনি মিনুর (লুৎফর হায়দার) বাড়িতে টিকাটুলীতে চলে যান। সেখানে কতগুলো ছেলে এলো, তাদের মুখ রুমাল দিয়ে বাঁধা ছিল। তারা বাবাকে ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করছিল। চৌধুরী মঈনুদ্দীন এসেছিল এবং আমার মা, চাচি, ছোট চাচা আর বাবা ওখানে ছিলেন। চৌধুরী মঈনুদ্দীন ছিল দৈনিক পূর্বদেশের সাংবাদিক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ছাত্র। তো সে আমার বাবার ছাত্র আর মেজ কাকার সহকর্মী ছিল। কাকার অধীনে কাজ করত। মেজ কাকা তখন দৈনিক পূর্বদেশের নিউজ এডিটর ছিলেন। এই চেহারা তাদের তিন ভাইয়ের সবার চেনা। মানে আমার ছোট কাকা লুৎফর হায়দার চৌধুরীরও চেনা ছিল। তখন কথা বলতে গিয়ে একসময় তার মুখের রুমাল সরে গিয়েছিল, যেটা আমার মায়েরও মনে ছিল, আমার চাচারও মনে ছিল—বাবারটা তো শুনিনি, আমার চাচিরও মনে ছিল।
সংবাদ প্রকাশ : এই ঘটনার কথা আপনি কার কাছ থেকে শুনেছেন?
তানভীর হায়দার চৌধুরী : এই কথা আমার মা বহুবার আমাকে বলেছেন। আমার চাচা-চাচি, মা, কেউ এখন আর বেঁচে নেই। চাচি, আমার মা-ও দেখেছেন, যেটা আমাকে বলেছেন, চাচির ‘টেস্টোমোনি ওয়াক অ্যান্ড ফাইল’ নামে যে ডকুমেন্টরি হয়েছিল, ব্রিটিশ চ্যানেল ফোর সেখানে দেখিয়েছিল এবং আমার ভাইও সাক্ষ্য দিয়েছেন। তিনি ২০১১-এর ডিসেম্বরে মারা গেলেন। সে বছরই আগস্টে ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস স্ট্র্যাটেজি শুরু হয়। সেখানে আমার ভাই লিখিত জবানবন্দি দিয়ে গেছেন যে, তিনি নিজের কানে শুনেছেন। তো এটা আমার মনে আছে, ওরা বন্দুকটন্দুক নিয়ে এসেছে। তখন সবাই ভয় পেয়ে যান। এটা দেখে ভাবি যে, টেলিভিশনে বন্দুক দেখি, তো এটা আর কি। এটা নিয়ে ভয় পাওয়ার কী আছে! আমাদের তো আসলে ভয় পাওয়ার বোধটাও হয়নি তখন। এই নিয়ে আমি আর আমার পিঠাপিঠি চাচাতো ভাই ইমন কথা বলছি। তারপর আমার বাবাকে বলা হলো স্যারকে নিয়ে যাব আবার কিছুক্ষণের মধ্যে ফিরিয়ে দিয়ে যাব। আমার বাবা বলেছিলেন, আমি তো কোনো অন্যায় করিনি, আমার কিছু হবে না। তোমরা ভয় পেও না, আমি চলে আসব। খেতে বসার আগে তিনি গোসল করতে যাবেন, এমন সময় তাঁকে নিয়ে যাওয়া হলো মাইক্রোবাসে করে।
সংবাদ প্রকাশ : শৈশবে পিতাকে হারিয়ে আপনার প্রতিক্রিয়া কী ছিল?
তানভীর হায়দার চৌধুরী : আমার বয়স ছিল চার বছর। আমার ভাই তখন আমার চেয়ে বেশি ট্রমাটাইজড ছিল। কারণ, তখন সে সাড়ে সাত। ও বুঝেছে যে কী হচ্ছে। আমি তখন বুঝিনি। তবে আমি বুঝেছি আমার জীবন পাল্টে গেল। এটা এত দুঃখের কেন এবং ওই বয়সে আসলে বাচ্চারা যা চায়, আনন্দ নিয়েই তো বাঁচতে চায়। যেকোনোভাবে আনন্দ খুঁজে নেয়। আমি একটু অন্তর্মুখী ছিলাম। বুঝে গিয়েছিলাম, আমাদের জীবন অন্য সবার মতো নয়।
সংবাদ প্রকাশ : বুদ্ধিজীবীর সন্তান হিসেবে কোনো সমস্যার সম্মুখিন হয়েছেন?
তানভীর হায়দার চৌধুরী : আরেকটা ব্যাপার ছিল। আমরা কোয়ার্টারে থাকতাম। কোয়ার্টারে আরও অনেক শহীদ বুদ্ধিজীবী পরিবার ছিল। তাদের সাহচর্যে থেকে এবং তাদের দেখে কিছুটা বুঝতে পারতাম, আমরা একদম একা না। এই যে ট্রমার মধ্য দিয়ে গিয়ে যেসব পরিবার গেছে— এই যেমন, মেঘনা গুহঠাকুরতা তিনি তো বড় ছিলেন, তার বাবার লাশ তার চোখের সামনে পড়েছিল। তারপর আনোয়ার পাশার বড় ছেলের কথাই বলা যাক। তিনি তো অপ্রকৃতিস্থ হয়ে গেছেন। মুনীর চৌধুরীর বড় ছেলে আহমেদ মুনীর, মুক্তিযুদ্ধ করতে গিয়ে তার যে অভিজ্ঞতা হয়েছে, এখনো সেটা নিয়ে কথা বলেন না। এমনই এক ট্রমার মধ্য দিয়ে গিয়েছিলেন যে, এখন পর্যন্ত এগুলো নিয়ে কথা বলেন না।