টোকা দিচ্ছে দরজায়। কয়েক ঘণ্টা পেরোলোই নির্বাচন। কী হতে যাচ্ছে ৫ নভেম্বর—এ প্রশ্নের উত্তর হয়তো এখনই মিলবে না। তবে শঙ্কা আছে, আছে উত্তেজনাও। যুক্তরাষ্ট্রের ৪৫তম প্রেসিডেন্ট ছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। আর কমলা হ্যারিস বর্তমান ভাইস প্রেসিডেন্ট। সব জরিপই বলছে, কেউ কাউকে উতরে যাওয়াটা খুব সহজ হবে না। এবারের নির্বাচন ২০১৬ সালের নির্বাচনকে মনে করিয়ে দেয়, যেখানে রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে ডেমোক্র্যাটিক দলের পক্ষে লড়াই করেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো একজন নারী, হিলারি ক্লিনটন। আট বছর পর রিপাবলিকান দলের প্রার্থী সেই ডোনাল্ড ট্রাম্পই আছেন, সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বী রয়েছেন এবারও একজন নারী, তবে তিনি কমলা হ্যারিস, যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে প্রথম নারী ভাইস প্রেসিডেন্ট।
তবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়ে সাম্প্রতিক ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ‘নস্ত্রাদামুস’ খ্যাত অ্যালান লিচম্যান। তিনি ১৯৮৪ সাল থেকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করে আসছেন। একবার ছাড়া প্রতিবারই তার ভবিষ্যদ্বাণী সফল হয়েছে। মার্কিন সংবাদমাধ্যম ইউএসএ টুডেকে অ্যালান লিচম্যান বলেছেন, মঙ্গলবার রাতে কমলা হ্যারিস ডোনাল্ড ট্রাম্পকে হারিয়ে দেবেন।
২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে লিচম্যান বলেছিলেন, ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হবেন। অথচ সে সময় বিভিন্ন জরিপে ট্রাম্পের প্রতিদ্বন্দ্বী হিলারি ক্লিনটনকে স্পষ্ট ব্যবধানে এগিয়ে থাকতে দেখা গেছে। এরপর, ২০২০ সালেও লিচম্যান জানিয়েছিলেন, ট্রাম্পকে হারিয়ে বাইডেন প্রেসিডেন্ট হবেন।
তবে, সর্বশেষ সুইং স্টেটগুলোয় কমলার চেয়ে ট্রাম্পই এগিয়েই আছেন। নির্বাচন বিশ্লেষকদের মতে, ইলেক্টোরাল কলেজের ভোটে এগিয়ে ট্রাম্পই। নেভাডা, অ্যারিজানা, মিনেসোটা, পেনসিলভেনিয়া, জর্জিয়া, নর্থ ক্যারোলাইনা, উইসকনসিন—এই ‘অনিশ্চিত’ রাজ্যগুলোই ঠিক করবে হোয়াইট হাউসে ট্রাম্প ফিরতে পারবেন কি না। তবে এটা সত্যি যে গত নির্বাচনে ফল বদলানোর চেষ্টা, এমনকি একাধিক ফৌজদারি অভিযোগ থাকার পরও মার্কিনিরা ট্রাম্পকে দূরে সরিয়ে দেননি। বরং দূরে ঠেলে দিয়েছেন বাইডেনকে। সংবাদমাধ্যম নিউইয়র্ক টাইমস–এর এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, ট্রাম্প নির্বাচনে জিতলেও সে কৃতিত্ব তার নিজের হবে না। বাইডেন প্রশাসনের প্রতি মানুষের অসন্তোষই তার জয়ের পেছনে কাজ করবে।
নিউইয়র্ক টাইমস–এর জনমত জরিপে দেখা গেছে, দেশজুড়ে ৪৯ শতাংশ মানুষ কমলা ও ৪৮ শতাংশ ট্রাম্পের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন। এ ছাড়া দোদুল্যমান অঙ্গরাজ্যগুলোর মধ্যে পেনসিলভানিয়ায় ট্রাম্প ১ শতাংশ, অ্যারিজোনায় ৪ শতাংশ, নেভাদায় ১ শতাংশ, নর্থ ক্যারোলাইনা ও জর্জিয়ায় ১ শতাংশ ব্যবধানে এগিয়ে রয়েছেন। কমলা উইসকনসিনে ১ শতাংশ ও মিশিগানে ১ শতাংশ ব্যবধানে এগিয়ে রয়েছেন।
ফল যাই হোক, এ নির্বাচন মার্কিন নাগরিকসহ ইউরোপ, চীন, রাশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য এবং গ্লোবাল সাউথ, এমনকি বাংলাদেশের ওপরও প্রভাব পড়বে।
দুই।
এবারের নির্বাচনে স্পষ্টতই ডেমোক্রেটরা প্রতিকূলতার মুখে পড়েছেন। নিউইয়র্ক টাইমস/সিয়েনা কলেজের সর্বশেষ জরিপে দেখা গেছে, প্রেসিডেন্ট হিসেবে বাইডেনের কর্মকাণ্ডের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন মাত্র ৪০ শতাংশ মানুষ। আরও কম, মাত্র ২৮ শতাংশ মানুষ মনে করেন দেশ সঠিক পথে আছে।
রিপাবলিকান পার্টির রাজনৈতিক শাখায় পরিণত হওয়া ‘মেক আমেরিকা গ্রেট অ্যাগেইন’ (মাগা) আন্দোলনটির নেতা ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি যদি আবার ক্ষমতায় আসেন, তাহলে তা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বিপর্যয় ডেকে আনবে, এমনটা মনে করছেন সেদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। এই বাস্তবতা প্রায় সবাই জানেন। তারপরও জরিপগুলো ট্রাম্পের প্রায় ৫০ শতাংশ জনসমর্থন দেখাচ্ছে। উগ্র, আপত্তিকর, উদ্ভট এবং স্পষ্টতই বিপজ্জনক বক্তব্যের জন্য ট্রাম্প বিশ্বব্যাপী পরিচিত হয়ে ওঠার পরও এই ফলাফল দেখা গেলে তা স্বাভাবিকভাবেই উদ্বেগজনক হয়ে ওঠে।
‘মাগা’ আন্দোলনের মানুষকে মোহগ্রস্ত করে নিজের দিকে টানার ক্ষমতা আছে। এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ হলো, আমেরিকার অর্ধেক ভোটার মনে করেন, ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রকে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য কমলা হ্যারিসের চেয়ে বেশি উপযুক্ত।
ডোনাল্ড ট্রাম্প দৃশ্যতই আত্মসর্বস্ব এবং অন্তঃসারশূন্য একজন মানুষ। তিনি গণতন্ত্রের তোয়াক্কা করেন না, কথাবার্তা অসংলগ্ন এবং নানা বিদ্বেষে ভরপুর। তবে ট্রাম্প একা নন। ভ্লাদিমির পুতিন, জাইর বোলসোনারো, রেসেপ এরদোয়ান, ভিক্টর ওরবান—এমন নির্বাচিত নেতাদের আবির্ভাব চারিদিকেই ঘটছে। বিশেষত উন্নত দেশগুলোতে এক ধরনের উগ্র জাতীয়তাবাদী, দক্ষিণপন্থী রাজনীতির উত্থান লক্ষণীয়। আমেরিকার গত এক দশকের নির্বাচনী তথ্য বিশ্লেষণ করলে আরও আশ্চর্য হতে হয়। সচরাচর বামঘেঁষা ডেমোক্র্যাটরা শ্রমজীবী, দরিদ্র, অশ্বেতাঙ্গ ইত্যাদি সম্প্রদায়ের ব্যাপক সমর্থন পেয়ে থাকেন। কিন্তু সেখানে পরিষ্কার ভাঙন ধরেছে। কলেজে পড়া, উদারপন্থী সচ্ছল শ্বেতাঙ্গ সম্প্রদায়, কর্পোরেট জগতের একাংশ, দক্ষিণ-ঘেঁষা রিপাবলিকান পার্টির মোহ কাটিয়ে ডেমোক্র্যাটদের দিকে ঝুঁকছেন। গত চার দশকের ক্রমবর্ধমান আর্থিক বৈষম্য ট্রাম্পের উত্থানের পেছনে একটা শক্তি। কিন্তু পিছিয়ে পড়া বর্গের সমর্থন কী করে পথ ভুলে বাম থেকে দক্ষিণে পৌঁছে গেল, সে রহস্য উদঘাটন এখনই সহজ নয়।
তিন।
ট্রাম্প ও কমলা উভয়ই বিভিন্ন ধরনের অঙ্গীকারের মাধ্যমে মার্কিন নাগরিকদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করে আসছেন। এর মধ্যে অন্যতম হলো অর্থনৈতিক অঙ্গীকার। অস্ট্রিয়ান অর্থনীতিবিদ জোসেফ শুম্পিটার বলেছিলেন, অর্থনৈতিক বৃদ্ধির ইঞ্জিন হলো ‘ধ্বংসাত্মক সৃজন’।
বিভিন্ন জনমত জরিপে কমলা হ্যারিস ও ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের পূর্বাভাস দেখা যাচ্ছে। যদিও শেষ পর্যায়ে ট্রাম্পের বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ছে। পার্টির সমর্থকদের পাশাপাশি উদ্বেগ–উৎকণ্ঠা ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বব্যাপী বিনিয়োগকারী ও ব্যবসায়ী মহলে। ভয়ের কারণ হলো, ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষিত অর্থনৈতিক নীতি ‘রক্ষণশীল’।
প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে যুক্তরাষ্ট্রকে আবার ‘মহান’ করার অঙ্গীকার করেছেন তিনি। সে জন্য অর্থনীতি ও বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ‘আমেরিকাই প্রথম’, এমন নীতি নেওয়ার আগাম ঘোষণা দিয়েছেন ট্রাম্প। এর অংশ হিসেবে কয়েক মাসে নির্বাচনী প্রচারণায় যুক্তরাষ্ট্রের বৈরী দেশগুলোর বিরুদ্ধে ‘বাণিজ্যযুদ্ধ’ শুরুর হুমকি দিয়েছেন তিনি। বিশেষ করে অর্থনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী চীন ট্রাম্পের হুমকির মূল লক্ষ্য হলেও তার প্রভাব সুদূরপ্রসারী। ট্রাম্পের জমানায় যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে বাণিজ্যযুদ্ধ শুরু হলে এর প্রতিক্রিয়া বিশ্বের অন্যান্য দেশেও অনুভূত হবে বলে সতর্ক করে দিচ্ছেন অর্থনৈতিক বিশ্লেষকসহ বিশ্ববাণিজ্যের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মহল। আর আগেও ট্রাম্প তা করেছেন।
এ ছাড়া ট্রাম্প খোলামেলা বলেছেন, সুদের হার নির্ধারণের মতো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে প্রেসিডেন্টের হস্তক্ষেপের সুযোগ থাকা উচিত। এ পরিস্থিতিতে নির্বাচিত হলে স্বভাবতই তিনি ফেডারেল রিজার্ভের সিদ্ধান্তে নাক গলাবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। আগের জমানায়ও ফেড চেয়ারম্যানের সঙ্গে বাহাস হয়েছে ট্রাম্পের। এবার নির্বাচিত হয়ে ট্রাম্প যদি ফেডারেল রিজার্ভের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করেন, বিশেষ করে সুদের হার নির্ধারণের ব্যাপারে, এর প্রভাব সারা বিশ্বের অর্থনীতি ও আর্থিক ব্যবস্থায় পড়বে। ফেডের সুদহারের ওপর উন্নয়নশীল দেশের বিনিয়োগ অনেকাংশে নির্ভরশীল।
এখন বিষয় হচ্ছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি এখন স্থিতিশীল। প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থানের গতি ভালো। ফলে গত তিনবার ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী ক্ষমতায় আসার সময় যে পরিস্থিতি ছিল, এখনকার পরিস্থিতি তেমন নয়। তার কৃতিত্ব ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের। সেটাই কি ডেমোক্র্যাটদের জন্য কাল হবে, নাকি মার্কিন মানুষেরা আগের সরকারের ধারাবাহিকতা রক্ষা করবেন, সেটাই দেখার অপেক্ষা।
চার।
এদিকে প্রশ্ন উঠছে, যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের ফলাফল কি কোনো প্রভাব ফেলবে বাংলাদেশের ওপরে? হঠাৎ করে ডোনাল্ড ট্রাম্পের একটি এক্স বার্তায় দাবি করেছেন, বাংলাদেশে এখন অরাজকতা চলছে। যে দাবিটি গত দুই মাস করে আসছে আওয়ামী লীগ। ট্রাম্প আরও দাবি করেছেন, বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতন চলছে। যেটি মূলত ভারতের দাবি। ভারত এবং দেশটির মিডিয়া বেশ চড়া সুরে দাবিটি করলেও সেটি শেষ পর্যন্ত বৈশ্বিক দৃষ্টি আকর্ষণ করেনি। কিন্তু ট্রাম্পের মন্তব্যের পর নতুন করে আলোচনা শুরুর সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। ট্রাম্প তার এক্স বার্তায় ভারতকেও টেনে এনেছেন। বলেছেন, ভারত ও দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তার ভালো বন্ধু। এটাও বাংলাদেশের জন্য বড় ধরনের উদ্বেগের কারণ।
এর আগে বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে ফোনালাপে মোদি বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের বিষয়টি জানিয়েছিলেন। মোদি নিজের এক্স বার্তায় সেটি প্রকাশও করেছেন। তবে এ ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ইতিবাচক কোনো উত্তর পাননি মোদি। কিন্তু সেখানে ট্রাম্প নিজে থেকেই মোদির কথাকে সত্যায়িত করছেন। এটা বাংলাদেশ ইস্যুতে ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্র-ভারতের সম্পর্কে নতুন কোনো রাজনৈতিক মেরুকরণ কি না, সেটা নিয়েও কথা উঠছে।
এটা ঠিক যে ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের ঠিক ছয় দিন আগে যে কথাগুলো বলেছেন, সেটা দেশটির হিন্দু ভোটারদের আকৃষ্ট করতেই বলা। স্পষ্টত জরিপগুলো বলছে, এ নির্বাচন হবে হাড্ডাহাড্ডি। মেক্সিকানদের পরেই যুক্তরাষ্ট্রে দ্বিতীয় অভিবাসী ভোটার ব্লক মনে করা হয় হিন্দু ভোটারদের। যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত ৫২ লাখ হিন্দু জনগোষ্ঠীর মধ্যে ভোটার প্রায় ২৬ লাখ। সাধারণত তারা ডেমোক্র্যাটদের ভোট দিলেও এবারের জরিপ বলছে, নিজে প্রথম ভারতীয় বংশোদ্ভূত প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হলেও হিন্দু ভোটারদের মধ্যে জনপ্রিয়তা কমছে কমলা হ্যারিসের। কার্নেগি এনডোম্যান্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল ফাউন্ডেশন পরিচালিত জরিপ বলছে, ২০২০ সালের নির্বাচনে বাইডেন যখন ৬১ শতভাগ হিন্দু ভোট পেয়েছেন, এবার কমলা তার ৪ শতভাগ কম ভোট পাবেন।
এর আগে ২০১৬ সালে হাওয়াইয়ের এ কংগ্রেসওম্যান হাউস রেজল্যুশন থ্রি নাইনটি সিক্স এবং ২০১৮ সালে ইন্ডিয়ানার রিপাবলিকান হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভ জিম ব্যাংকস হাউস রেজল্যুশন ওয়ান সিক্সটি কংগ্রেসে উত্থাপন করেছিলেন। দুটি রেজল্যুশনে বাংলাদেশে হিন্দু নির্যাতনের বিষয়ে অভিযোগ এনেছিলেন। রেজল্যুশন দুটি এতটাই দুর্বল ছিল যে সেটি কমিটি পর্যায়ে বাতিল হয়ে যায়।
তবে আশঙ্কার কথা, ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচিত হলে তুলসি গ্যাবার্ডকে সেক্রেটারি অব স্টেট (পররাষ্ট্রমন্ত্রী) হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হতে পারে। সেটি বাংলাদেশ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নীতি প্রণয়নে বড় ধরনের ধাক্কা হতে পারে।
এর মধ্যে আলোচনায় আসতে পারে সম্প্রতি সুইডেনভিত্তিক সংবাদমাধ্যম নেত্র নিউজের একটি খবর। যেখানে দাবি করা হয়েছে, সাবেক প্রধানমন্ত্রীপুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক একটি প্রতিষ্ঠানকে ট্রাম্পের সঙ্গে সখ্য বাড়াতে লবিস্ট ফার্ম হিসেবে নিয়োগ করেছেন। নেত্র নিউজের এ খবরটা বলছে, আমেরিকায় ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরির জন্য দুই লাখ ডলারের (প্রায় আড়াই কোটি টাকা) বিনিময়ে একটি লবিং প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করেছে সজীব ওয়াজেদ জয়ের প্রতিষ্ঠান ‘ওয়াজেদ কনসালটিং ইনকরপোরেশন’।
যে দুই ব্যক্তি লবিস্ট প্রতিষ্ঠানটি চালান, তারা ২০১৬ সালে ট্রাম্পের নির্বাচনী টিমে অ্যাডভাইজার হিসেবে কাজ করেছেন। প্রতিষ্ঠানটির দুই কর্মকর্তা ট্রাম্পের আগের প্রশাসনের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত। তাদের মাধ্যমে ট্রাম্পের সঙ্গে সম্পর্ক গভীর করতে চায় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। এর পর থেকে বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ সমর্থকদের অনেকে ট্রাম্পকে নিজেদের জন্য আশীর্বাদ ভাবতে শুরু করেছেন।
এটা কিছুটা বিভক্ত করতে পারে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশিদের। ভোটের হিসাবে বাংলাদেশিরা ডেমোক্র্যাটকে বড় মিত্র ভাবলেও অনেকে হয়তো এবার রিপাবলিকানদের ভোট দেওয়ার কথা ভাবছেন।
একটু মনে করিয়ে দিই, বিশ্বের প্রতিষ্ঠিত গণতান্ত্রিক দেশগুলোর নীতি। ভারতের কংগ্রেসের সঙ্গে আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠতা ঐতিহাসিক। কংগ্রেস বিদায় নিয়ে মোদি ক্ষমতায় আসার পর বাংলাদেশের বিরোধী রাজনীতিবিদদের মধ্যে উল্লাস দেখা গিয়েছিল। তারা ভেবেছিলেন শেখ হাসিনার সঙ্গে মোদির বোধ হয় খুব একটা জমবে না। কিন্তু আওয়ামী লীগের ব্যাপারে ভারতের পররাষ্ট্রনীতি একচুলও নড়েনি। বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে কংগ্রেসের চেয়ে মোদির বিজেপি শেখ হাসিনার জন্য আরও বেশি ভূমিকা রেখেছেন এবং রাজনীতিতে ঐকমত্যের ভিত্তিতেই ভারত শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দিয়ে রেখেছে।
তবে ব্যক্তিগত ভূমিকা যে একেবারে কাজ করে না, তা নয়। সে ক্ষেত্রে আনপ্রেডিক্টেবল ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে বাংলাদেশের জন্য কী অপেক্ষা করছে, তা হয়তো ভবিষ্যৎই বলে দেবে।
পাঁচ।
কমলা কি এবার নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করতে পারবেন? দ্য কনভারসেশনে ইউনিভার্সিটি অব অ্যাডিলেডের রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ইমেরিটাস অধ্যাপক ক্যারল জনসনের লেখা নিবন্ধের শিরোনাম ছিল, ‘মার্কিন নির্বাচনে লিঙ্গ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে; এটা কেবল কমলা হ্যারিস সম্পর্কেই নয়।’ নিবন্ধের শুরুতেই তিনি লেখেন, যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে একজন নারী প্রেসিডেন্ট প্রার্থীর ক্ষেত্রে লিঙ্গের বিষয়টি অনিবার্যভাবে আসবে।
মার্কিন জনগণ উদার হলেও রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ক্ষেত্রে তারা রক্ষণশীলতার পরিচয় দিতে পারেন। রাষ্ট্রপতি হিসেবে ট্রাম্পের বিপরীতে নারী প্রার্থী কমলাকে বেছে নাও নিতে পারেন। কেননা ২০১৬ সালে হিলারি ট্রাম্পের বিপক্ষে ৩০ লাখ ভোট বেশি পেয়েও ইলেকটোরাল ভোটে হেরে গেছেন। তবে ডোনাল্ড ট্রাম্প যেভাবে শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদী রাজনীতির মাধ্যমে দেশকে বিভক্ত করছেন, সময়ই বলবে এর ফলাফল কী? আমেরিকায় ডেমোক্র্যাটদের প্রতি মানুষের সমর্থন কমে রিপাবলিকানদের প্রতি সমর্থন বৃদ্ধি এটাই প্রমাণ করে যে, এবারের নির্বাচনে রিপাবলিকানদের জয়ের একটা বড় সুযোগ তৈরি হয়েছে। সেক্ষেত্রে তারা যদি নির্বাচনে জিতেও যায় তাহলে তা ট্রাম্পের জনপ্রিয়তার জন্য নয়। মার্কিনে নানা অব্যবস্থাপনা, অর্থনৈতিক সংকট ও অস্থিতিশীল পরিস্থিতি ডেমোক্র্যাটদের প্রতি মানুষের মোহভঙ্গ হয়েছে।
সবক্ষেত্রেই দেখা গেছে, জরিপে ট্রাম্প কিছু এগিয়ে আছেন। পিউ রিসার্চ, এনবিসি, ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল, টাইমস, সিয়েনা কলেজের মতো বড় বড় জরিপে দেখা গেছে এই প্রথম দলগতভাবে ডেমোক্র্যাটদের চেয়ে এগিয়ে আছে রিপাবলিকানরা।
একদিনে সবচেয়ে বেশি অনুদান সংগ্রহ করা, তার বয়স, নারী ও কৃষ্ণাঙ্গ এশীয় ভাইস প্রেসিডেন্ট হওয়া, গর্ভপাত বিষয়ে তার অবস্থান, অভিবাসনসংক্রান্ত ইস্যুতে বক্তব্য এরই মধ্যে কমলা হ্যারিসকে করে তুলেছে আলোচিত ও বিতর্কিত। গত সাড়ে তিন বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। ক্যালিফোর্নিয়ায় জন্মগ্রহণকারী কমালা হ্যারিসের বয়স ৫৯। তার আলোচনায় আসার একটা কারণ হতে পারে, জো বাইডেনের প্রার্থীপদ প্রত্যাহারের ঘোষণার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস নতুন অনুদান হিসেবে ৮ কোটি ডলারের বেশি অর্থ সংগ্রহ করেছেন, যা এবারের নির্বাচনে কোনো প্রার্থীর একদিনে সংগ্রহ করা অনুদানের মধ্যে সবচেয়ে বেশি।
তাছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে হ্যারিসই প্রথম নারী ও কৃষ্ণাঙ্গ এশীয় ভাইস প্রেসিডেন্ট। এই বিষয়টি তো আলোচনায় আছেই। আর এ কারণেই তিনি কৃষ্ণাঙ্গ এবং নারী ভোটারদের কাছে বেশ আলোচিত।
নির্বাচনী প্রচারের সময় ট্রাম্প কমলাকে নানা অশোভন ভাষায় আক্রমণ করেছেন। এমনকি কমলা হ্যারিসকে নির্বোধ ও দুর্বল বলে গালও দিয়েছেন। আর এটাই ভোটারদের কাছে কমলাকে পৌঁছে দিয়েছে। নারীদের তরফ থেকে বলা হচ্ছে, ট্রাম্প মেয়েদের রক্ষা করবেন কী, তার হাত থেকে মেয়েদের রক্ষা পাওয়াটাই অধিক জরুরি।
অন্যদিকে কমলা ট্রাম্পের এই বক্তব্যের বিপরীতে বলেছেন, ট্রাম্পের কথা থেকেই স্পষ্ট, নিজের শরীরের ওপর নারীর অধিকারের ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্বাধীনতায় তিনি বিশ্বাস করেন না। এসব বিষয় কমলাকে ভোটারদের আলোচনায় রেখেছে।
এবারের নির্বাচনে একটা প্রধান বিষয় গর্ভপাত প্রশ্নে নারীর সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্বাধীনতা। এরই মধ্যে ভাইস প্রেসিডেন্ট হ্যারিস কিন্তু গর্ভপাতের সমর্থনে কথা বলেছেন যা সাম্প্রতিক নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটের পক্ষে ইতিবাচক বলে প্রমাণিত হয়েছে। অন্যদিকে গর্ভপাত প্রশ্নে যে আইনি নিশ্চয়তা আমেরিকার নারীরা অর্ধশতক ধরে ভোগ করেছেন, ২০২২ সালে সুপ্রিম কোর্ট এক সিদ্ধান্তে তা বাতিল করেন।
এ ছাড়া, শ্রমিকশ্রেণির মানুষের কাজের স্বাধীনতা বাড়ানো, মাতৃত্ব-পিতৃত্বকালীন ছুটি ও শিশু যত্ন বাড়ানো, নারীদের প্রজনন ও গর্ভপাত স্বাধীনতা বাড়ানো কমলার গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি।
কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরা জানিয়েছে, গাজা উপত্যকায় যুদ্ধের মধ্যে ইসরায়েলের প্রতি বাইডেন প্রশাসনের সমর্থন নিয়ে একাধিক বিক্ষোভের মুখে পড়েছেন কমলা। মূলত নির্বাচনী প্রচারে গিয়েই তিনি বিভিন্ন স্থানে তোপের মুখে পড়েন। বাইডেন প্রশাসনের নীতিমালা প্রণয়নের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস। এখনো বাইডেনের সঙ্গেই কাজ করছেন তিনি। ঐতিহাসিকভাবে এতদিন ডেমোক্র্যাটরাই বেশিরভাগ মুসলিম ভোট পেয়ে এলেও এবারের চিত্র ভিন্ন। অবশ্য কমলার কিছু সমর্থক বলছেন, তিনি বাইডেনের কাজ চালিয়ে যাবেন না। তিনি ইসরায়েল নীতির বিষয়ে নিজেকে ইতিমধ্যেই কিছুটা দূরে রেখেছেন। তিনি ইসরায়েলে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্রের অবাধে প্রবাহ বন্ধের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
বিশ্লেষকদের মতে, গাজা যুদ্ধে ইসরায়েলকে বাইডেন প্রশাসনের অন্ধ সমর্থন এবার মুসলিম ভোটারদের সিদ্ধান্তে পরিবর্তন আনতে পারে। ইতোমধ্যে কয়েকজন মুসলিম নেতা ট্রাম্পকে সমর্থন দেওয়ার কথাও জানিয়েছেন।
ট্রাম্প মধ্যপ্রাচ্যে ‘শান্তি’ ফিরিয়ে আনার কথা বলেছেন। তবে কীভাবে সেটা করবেন, সে বিষয়ে তিনি বিস্তারিত কিছু বলেননি। ট্রাম্প তার প্রথম মেয়াদে ইসরায়েলের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়েছিলেন।
মার্কিন নাগরিক সামরা লোকমান বলেন, ট্রাম্পকে সমর্থনের অর্থ এই নয় যে তার আগের মেয়াদে মধ্যপ্রাচ্যসংক্রান্ত উদ্যোগ ভালো ছিল। বরং এর মাধ্যমে ইসরায়েলের প্রতি বাইডেন–কমলা প্রশাসনের অভূতপূর্ব সামরিক সমর্থনের বিষয়ে বর্তমান ভাইস প্রেসিডেন্টকে কিছুটা হলেও জবাবদিহির আওতায় আনা আসল লক্ষ্য।
ইয়েমেনি বংশোদ্ভূত এই নারী বলেন, ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হলেও ফিলিস্তিনে গণহত্যা চালু থাকার আশঙ্কা ৯৯ ভাগ। যুদ্ধ বন্ধের সম্ভাবনা ১ ভাগ। কিন্তু কমলার অধীনে গণহত্যা অব্যাহত থাকার সম্ভাবনা শতভাগ।
তবে অভিবাসনসংক্রান্ত ইসুতে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছিল কমলা হ্যারিসের। তিনি একবার অভিবাসন প্রত্যাশীদের উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘আসবেন না’। তার এ বক্তব্যে তিনি সমালোচিত হয়েছিল ব্যাপক। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচিত ঘটনা আনুষ্ঠানিকভাবে ডেমোক্র্যাট দলের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে মনোনীত হওয়া। এটি নতুন ইতিহাস রচিত হলো, আর নির্বাচনে বিজয়ী হলে হবে আরেক ইতিহাস।
প্রশ্ন হলো, শেষ পর্যন্ত কে হাসবেন হাসি; কে জিতবেন রক্ষণশীলতা, নাকি প্রগতি? মার্কিনরা আমেরিকান রাজনীতিতে পরিবর্তন চান, এখন দেখার বিষয় সেই পরিবর্তন কে এনে দিতে পারবেন।