• ঢাকা
  • রবিবার, ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ১৪ আশ্বিন ১৪৩১, ২৫ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

কে এই হাসান নাসরুল্লাহ, কী তার ভূমিকা


সংবাদ প্রকাশ ডেস্ক
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২৮, ২০২৪, ০৪:১৩ পিএম
কে এই হাসান নাসরুল্লাহ, কী তার ভূমিকা
হাসান নাসরুল্লাহ। ছবি : সংগৃহীত

লেবাননের শিয়া মুসলিম সংগঠন হিজবুল্লাহর প্রধান শেখ হাসান নাসরুল্লাহ মধ্যপ্রাচ্যে অন্যতম পরিচিত এক মুখ ও সবচেয়ে প্রভাবশালী নেতাদের একজন। সম্প্রতি লেবাননে সশস্ত্র সংগঠনটির স্থাপনা লক্ষ্য করে হামলা শুরু করেছে ইসরায়েল। এরই ধারাবাহিকতায়  শুক্রবার (২৭ সেপ্টেম্বর) রাজধানী বৈরুতে হিজবুল্লাহর কমান্ড সেন্টার নিশানা করে হামলা চালায় দেশটি। এ হামলায় নাসরুল্লাহকে হত্যার দাবি করেছে ইসরাইলের সামরিক বাহিনী। 

শনিবার (২৮ সেপ্টেম্বর) এক এক্স বার্তায় ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীর পক্ষ থেকে এ দাবি করা হয়। এতে বলা হয়, “হাসান নাসরুল্লাহ আর বিশ্বে সন্ত্রাসবাদ পরিচালনা করতে পারবেন না।”

ইসরায়েলের হত্যার শিকার হওয়ার আশঙ্কায় কয়েক বছর ধরেই জনসম্মুখে আসছেন না শেখ হাসান নাসরুল্লাহ।

ইসরায়েলের কাছে ‘ছায়ামূর্তি’তুল্য নেতা হাসান নাসরুল্লাহর রয়েছে দেশটির প্রধান শত্রু ইরানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিগত সম্পর্ক। হিজবুল্লাহকে একটি রাজনৈতিক শক্তি ও বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী অরাষ্ট্রীয় সশস্ত্র সংগঠন হিসেবে প্রতিষ্ঠার পেছনে তার রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। বছরের পর বছর লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকলেও নাসরুল্লাহর প্রতি তাঁর সমর্থকদের শ্রদ্ধা–ভালোবাসা এতটুকু কমেনি।

নাসরুল্লাহর নেতৃত্বে হিজবুল্লাহ ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসের যোদ্ধাদের পাশাপাশি ইরাক ও ইয়েমেনের মিলিশিয়াদের প্রশিক্ষণগত সহায়তা দিয়েছে। ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ব্যবহারের লক্ষ্যে ইরানের কাছ থেকে সংগ্রহ করা ক্ষেপণাস্ত্র ও রকেটের এক সমৃদ্ধ ভান্ডার রয়েছে হিজবুল্লাহর।

দখলকৃত লেবাননি ভূখণ্ড থেকে ইসরায়েলি সেনাদের তাড়াতে প্রথমে একটি মিলিশিয়া দল হিসেবে গড়ে উঠেছিল হিজবুল্লাহ। পরে এ দলকেই লেবাননের সেনাবাহিনীর চেয়ে শক্তিশালী এক বাহিনীতে রূপ দেন নাসরুল্লাহ। সংগঠনটি এখন দেশের রাজনীতিতেও উল্লেখযোগ্য প্রভাব বিস্তারকারী একটি শক্তি।

জন্ম, মিলিশিয়া দলে যোগদান ও হিজবুল্লাহর দায়িত্ব গ্রহণ

হাসান নাসরুল্লাহর (৬৪) জন্ম ১৯৬০ সালে। বেড়ে উঠেছেন বৈরুতের পূর্বাঞ্চলীয় উপকণ্ঠের বুর্জ হামুদ এলাকায়। বাবা আবদুল করিম ছিলেন একজন সাধারণ সবজি বিক্রেতা। তার ৯ সন্তানের মধ্যে নাসরুল্লাহ ছিলেন সবার বড়।

১৯৭৫ সালে লেবানন গৃহযুদ্ধের মুখে পড়লে হাসান নাসরুল্লাহ শিয়া মুভমেন্ট ‘আমাল’–এ যোগ দেন। পরে কিছুকাল ইরাকের নাজাফে শিয়া মুসলিম সম্প্রদায়ের একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কাটান। সেখান থেকে লেবাননে ফিরে আবার আমালে যোগ দেন। ১৯৮২ সালে আরও কয়েকজনের সঙ্গে দলটি থেকে বেরিয়ে যান তিনি। এ ঘটনার কিছুদিন আগে লেবাননে আগ্রাসন চালায় ইসরায়েল।

আমাল থেকে দলছুট হয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘ইসলামিক আমাল’। দলটি প্রতিবেশী দেশ ইরানের বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর কাছ থেকে উল্লেখ করার মতো সামরিক ও সাংগঠনিক সহায়তা পায়। লেবাননের বেকা ভ্যালিভিত্তিক দল ‘ইসলামিক আমাল’ পরবর্তী সময়ে শিয়া মিলিশিয়াদের সবচেয়ে পরিচিত ও কার্যকর দল হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করে। একপর্যায়ে এটিই সশস্ত্র হিজবুল্লাহ সংগঠনে রূপ নেয়।

‘ওপেন লেটার’ নামে একটি প্রকাশনা বের করার মধ্য দিয়ে ১৯৮৫ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে নিজেদের প্রতিষ্ঠার কথা জানায় হিজবুল্লাহ। যুক্তরাষ্ট্র ও তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নকে তারা চিহ্নিত করে ‘ইসলামের প্রধান দুই শত্রু’ হিসেবে। সেই সঙ্গে ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েলকে ধ্বংস করার ডাক দেয় তারা। দেশটিকে আখ্যায়িত করে মুসলিমদের ভূমি দখলকারী হিসেবে।

সাংগঠনিক তৎপরতা বৃদ্ধি করার সঙ্গে সঙ্গে হিজবুল্লাহতে নাসরুল্লাহর অবস্থান মজবুত হতে থাকে, বাড়তে থাকে দায়িত্ব। নাসরুল্লাহ বলেন, হিজবুল্লাহর একজন যোদ্ধা থেকে তিনি বালবেক এলাকার পরিচালক হন, পরে পুরো বেকা ভ্যালির দায়িত্ব পান, এরপর সংগঠনের বৈরুত শাখার দায়িত্ব নেন।

১৯৯২ সালে মাত্র ৩২ বছর বয়সে হিজবুল্লাহর প্রধান হন নাসরুল্লাহ। এর আগে ইসরায়েলের এক হেলিকপ্টার হামলায় নিহত হন তার পূর্বসূরি আব্বাস আল–মুসাবি।

হিজবুল্লাহপ্রধানের দায়িত্ব নেওয়ার পর মুসাবি হত্যার প্রতিশোধ নেওয়া ছিল হাসান নাসরুল্লাহর প্রথম কাজ। সে অনুযায়ী ইসরায়েলের উত্তরাঞ্চলে রকেট হামলার নির্দেশ দেন তিনি। হামলায় একজন নিহত হন। পাশাপাশি তুরস্কে ইসরায়েলের দূতাবাসে গাড়িবোমা হামলায় এক ইসরায়েলি নিরাপত্তা কর্মকর্তা ও আর্জেন্টিনার বুয়েনস এইরেসে ইসরায়েলি দূতাবাসে আত্মঘাতী হামলায় ২৯ জন নিহত হন।

নাসরুল্লাহ লেবাননের দক্ষিণে ইসরায়েলি বাহিনীর সঙ্গেও তাঁর যোদ্ধাদের লড়াইয়ে নেতৃত্ব দেন। একপর্যায়ে ২০০০ সালে সেখান থেকে পিছু হটে দেশে ফিরে যান ইসরায়েলি সেনারা। তবে নাসরুল্লাহর ব্যক্তিগত ক্ষতিও কম হয়নি। ইসরায়েলি সেনাদের সঙ্গে লড়াইয়ে প্রাণ দিতে হয় তাঁর বড় ছেলে হাদিকে।

ইসরায়েলি বাহিনী দক্ষিণ লেবানন ছাড়লে নাসরুল্লাহ ইসরায়েলের বিরুদ্ধে আরবদের প্রথমবারের মতো বিজয়ের দাবি করেন। সেই সঙ্গে নাসরুল্লাহ অঙ্গীকার করেন, ইসরায়েলকে দমন না করা পর্যন্ত তারা অস্ত্র ত্যাগ করবেন না। বলেন, সেবা ফার্মস এলাকাসহ দখল করা লেবাননি সব ভূখণ্ড ছাড়তে হবে ইসরায়েলকে।

এরপর ২০০৬ সাল পর্যন্ত ইসরায়েল–হিজবুল্লাহর মধ্যকার উত্তেজনাকর পরিস্থিতি মোটামুটি শান্ত ছিল। তবে ওই বছর হিজবুল্লাহর যোদ্ধারা ইসরায়েল সীমান্তে হামলা চালালে আট সেনা নিহত ও দুজন অপহৃত হন। পরে লেবাননের দক্ষিণাঞ্চল ও বৈরুতের দক্ষিণ উপকণ্ঠে যুদ্ধবিমান থেকে ব্যাপক গোলাবর্ষণ শুরু করে ইসরায়েল। হিজবুল্লাহও ইসরায়েলের অভ্যন্তরে প্রায় চার হাজার রকেট ছুড়ে জবাব দেয়।

৩৪ দিন ধরে চলা ওই লড়াইয়ে অন্তত ১ হাজার ১২৫ লেবাননি নিহত হন, যাদের বেশির ভাগ ছিলেন বেসামরিক লোক। নিহত হন ১১৯ ইসরায়েলি সেনা ও ইসরায়েলের ৪৫ বেসামরিক নাগরিকও। লড়াই চলাকালে ইসরায়েল নাসরুল্লাহর বাড়ি ও অফিসে যুদ্ধবিমান থেকে গোলাবর্ষণ করে। তবে তিনি অক্ষত থাকেন।

Link copied!