টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ দেখতে পর্যটকদের সমুদ্রের তলদেশে নিয়ে যাওয়ার কাজে ব্যবহৃত সাবমেরিন ‘টাইটান’ আটলান্টিক মহাসাগরে গত রোববার থেকে নিখোঁজ। এখনো এটির খোঁজ পাওয়া যায়নি। মহাসাগরে নামার ১ ঘণ্টা ৪৫ মিনিটের মধ্যে গবেষণা জাহাজ ‘পোলার প্রিন্স’-এর সঙ্গে সাবমেরিনটির ক্রুদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। মূলত এরপরই শুরু হয় উদ্ধার অভিযান।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি একাধিক প্রতিবেদনে এ বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য জানিয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, ওশানগেট কোম্পানির এ সাবমেরিনটিতে সাধারণত চার দিনের জরুরি অক্সিজেন থাকে। মার্কিন কোস্টগার্ডরা ধারণা করেছিলেন যে সাবমেরিনটিতে ৭০ থেকে ৯৬ ঘণ্টা চলার মতো জরুরি অক্সিজেন ছিল। ফলে সময় যত গড়াচ্ছে নিখোঁজদের জীবিত উদ্ধারের সম্ভাবনা ততই ক্ষীণ হয়ে আসছে।
‘টাইটান’ নামের ওই সাবমেরিনটির মালিক মার্কিন প্রতিষ্ঠান ওশানগেট। পানির তলদেশে গবেষণা, অনুসন্ধান, এমনকি ভ্রমণ করতে ইচ্ছুক এমন লোকজনকে সাবমেরিনের মাধ্যমে পানির নিচে সাগরের ১২ হাজার ৫০০ ফুট নিচে পড়ে থাকা টাইটানিক জাহাজের কাছে ঘুরিয়ে আনে প্রতিষ্ঠানটি। ক্রু ছাড়া যেসব সাধারণ যাত্রী সাবমেরিনটিতে ছিলেন তাদের প্রত্যেকে ২ লাখ ৫০ হাজার ডলার খরচ করেছিলেন, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় আড়াই কোটি টাকার বেশি।
কানাডার নিউফাউন্ডল্যান্ড প্রদেশের সেন্ট জন শহর থেকে টাইটানের যাত্রা শুরু হয়। আটলান্টিকের তলদেশে যেখানে টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ রয়েছে, সেখান থেকে এর দূরত্ব ৬০০ কিলোমিটার। সেন্ট জন থেকে টাইটানকে পোলার প্রিন্স নামের একটি জাহাজে করে ধ্বংসাবশেষ স্থলে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে সাগরের তলদেশে যাত্রীদের নিয়ে যায় সাবমেরিনটি। টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ ঘুরিয়ে আনতে এটির সময় লাগে প্রায় আট ঘণ্টা।
উদ্ধার অনুসন্ধানের নেতৃত্বদানকারী বোস্টন কোস্টগার্ড টুইটারে বলেছে, পাঁচজন আরোহী রোববার সকালে পানির নিচে যাওয়া শুরু করে এবং এর প্রায় ১ ঘণ্টা ৪৫ মিনিটের মধ্যে পোলার প্রিন্সের ক্রুরা তাদের সঙ্গে যোগাযোগ হারিয়ে ফেলে। টাইটানে তখন কেপ কড উপকূল থেকে প্রায় ১ হাজার ৪৫০ কিলোমিটার দূরে ছিল বলে মনে করা হয়েছিল।
মার্কিন কোস্টগার্ডের রিয়ার অ্যাডমিরাল জন মাগার সোমবার বলেছেন, এটি এমন একটি দুর্গম এলাকায় অনুসন্ধান চালানো চ্যালেঞ্জিং।
এদিকে সাবমেরিনটির খোঁজে কাজ করছে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডার নৌবাহিনী এবং গভীর সাগরে কাজ করে এমন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো। অনুসন্ধানের দুটি দিক রয়েছে, একটি হলো সমুদ্রপৃষ্ঠে অনুসন্ধান যদি টাইটান সমুদ্রের পৃষ্ঠে ফিরে আসে এবং সেখান থেকেই কোনোভাবে যোগাযোগ হারিয়ে ফেলে। এ ছাড়া পানির নিচে শব্দতরঙ্গের সাহায্যে সোনার অনুসন্ধানও আরেকটি উপায় রয়েছে।
সমুদ্রপৃষ্ঠে সাবমার্সিবল খোঁজার জন্য কোস্টগার্ড দুটি সি-১৩০ হারকিউলিস আকাশযান পাঠিয়েছে, এবং একটি কানাডিয়ান সি-১৩০ এবং একটি পি৮ আকাশযানও অনুসন্ধানে কাজ করছে, যাদের পানির নিচে সোনার অনুসন্ধানের ক্ষমতা রয়েছে।
পোলার প্রিন্সের সহ-মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান হরাইজন মেরিটাইম, বিবিসিকে নিশ্চিত করেছে যে জাহাজটি অনুসন্ধানে কাজ করছে এবং একটি দ্বিতীয় জাহাজ, হরাইজন আর্কটিক, ঘটনাস্থলে পাঠানো হয়েছে।
টাইটানের ভেতরে মোট পাঁচজন যাত্রী ছিলেন সাবমেরিনটিতে। তারা হলেন পাকিস্তানি ব্যবসায়ী ও ধনকুবের শাহজাদা দাউদ (৪৮) ও তার ছেলে সুলেমান দাউদ (১৯), ওশানগেটের মালিক স্টকটন রাশও আছেন। আরেকজন পর্যটক ছিলেন ব্রিটেনের ধনকুবের হ্যামিশ হার্ডিং। যুদ্ধবিমান নির্মাণকারী সংস্থা ‘অ্যাকশন এভিয়েশনে’র চেয়ারম্যান তিনি। গভীর সমুদ্রে যাওয়ার নেশা ছিল তাঁর। এ ছাড়া ৭৭ বছর বয়সী ফরাসি পরিব্রাজক নৌবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত ডাইভার পল-হেনরি নারগোলেট।
চালকের আসনে ওশানগেটের মালিক
সাবমেরিনটিতে চালকের আসনে ছিলেন ওশানগেটের মালিক স্টকটন রাশ। প্রকৃতিপ্রেমী ও দুঃসাহসিক হিসেবে স্টকটন রাশের পরিচিতি রয়েছে। গভীর সমুদ্র নিয়ে গবেষণা করার অদম্য উৎসাহ তার। দীর্ঘদিন ধরেই মহাকাশ ভ্রমণের স্বপ্ন লালন করছিলেন রাশ। পর্যটক হিসেবে একটি বাণিজ্যিক ফ্লাইটে মহাকাশে যাওয়ার কথা ভাবতেন তিনি।
নতুন কিছু করার পরিকল্পনা নিয়ে ২০০৯ সালে ওশানগেট প্রতিষ্ঠা করেন রাশ। উদ্দেশ্য ছিল, উদ্ভাবনের মাধ্যমে গভীর সমুদ্রে বিচরণ বাড়ানো।
৬১ বছর বয়সী রাশ বলেছিলেন, তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন যে আকাশের চেয়ে সমুদ্র মানুষকে বেঁচে থাকার সেরা সুযোগ দেয়। তিনি আরও বলেন, মানবজাতির ভবিষ্যৎ পানির নিচে, মঙ্গল গ্রহে নয়।
ওশানগেটের নিরাপত্তা সম্পর্কে কর্মচারীদের সতর্কতা উপেক্ষা ও অবহেলা করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে রাশের বিরুদ্ধে। প্রতিষ্ঠানটির সাবেক ডিরেক্টর অব মেরিন অপারেশন ডেভিড লোচরিজ এ নিয়ে আদালতে একটি মামলা করেছিলেন। মামলার অভিযোগে তিনি বলেছেন, টাইটানের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করায় ২০১৮ সালে তাকে অন্যায়ভাবে চাকরিচ্যুত করা হয়েছিল।
টাইটান সম্পর্কে কিছু তথ্য
টাইটান হলো একটি পাঁচ-আরোহীর ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন সাবমার্সিবল, যা চার হাজার মিটার গভীরে নামতে সক্ষম এবং এটি তিন নটে অর্থাৎ ঘণ্টায় প্রায় সাড়ে তিন মাইল গতিতে চলতে পারে।
টাইটান পানির নিচে যাওয়ার পর যোগাযোগের জন্য সেটির ওপরে থাকা পোলার প্রিন্স থেকে ছোট ছোট বার্তা পাঠানো হয়। তবে এবার ওই বার্তার কোনো জবাব আসছে না।
টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষে আরোহীদের নিয়ে যাওয়া ছাড়াও, এটি সাইট জরিপ, পরিদর্শন, গবেষণা এবং তথ্য সংগ্রহ, ফিল্ম এবং মিডিয়া প্রোডাকশন এবং হার্ডওয়্যার এবং সফটওয়্যার গভীর সমুদ্র পরীক্ষার জন্য ব্যবহৃত হয়।
কোম্পানির মতে, টাইটানে অত্যাধুনিক আলো এবং সোনার ন্যাভিগেশন সিস্টেম রয়েছে। সেই সঙ্গে এর ভেতরে এবং বাইরে ফোরকে ভিডিও ও ছবি ধারণের মতো ক্যামেরা বসানো রয়েছে। ওশানগেট-এর ওয়েবসাইট অনুসারে, পাঁচ-আরোহীর এই সাবমার্সিবল বাস্তব সময়ে জাহাজের পাটাতনের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করারও ব্যবস্থা রয়েছে।
সাবমার্সিবলের কাঠামোয় কোনো সমস্যা হয়েছে কি না, তা মূল্যায়ন করার জন্য এটি ডুব দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সাবের ওপর যে চাপ পড়ে, তার প্রভাব বিশ্লেষণের জন্য সেন্সর রয়েছে।
কোম্পানির মতে, “এই অনবোর্ড হেলথ অ্যানালাইসিস মনিটরিং সিস্টেমটি” যেকোনো দুর্যোগ পরিস্থিতিতে আগে থেকেই সতর্কতা দেয় যেন এর আরোহীদের নিরাপদে সমুদ্রপৃষ্ঠে ফিরিয়ে আনার পর্যাপ্ত সময় পাওয়া যায়।
বিবিসির সাংবাদিকের অভিজ্ঞতা
বিবিসির মার্কিন অংশীদার সিবিএস গত বছর টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ দেখতে তাদের একজন সাংবাদিককে একই সংস্থার সঙ্গে সমুদ্রযাত্রায় পাঠিয়েছিল।
ডেভিড পোগ ওই অভিযানে যাওয়ার পর সেখানে একটি লিখিত বিবৃতি পড়েছিলেন। যেখানে বলা হয়েছে, এটি মূলত একটি “পরীক্ষামূলক” জাহাজ “যা কোনো নিয়ন্ত্রক সংস্থা দ্বারা অনুমোদিত বা প্রত্যয়িত হয়নি, এবং এর ফলে শারীরিক আঘাত, অক্ষমতা, মানসিক আঘাত বা মৃত্যু হতে পারে।”
ওশানগেটের সিইও স্টকটন রাশ তারপর তাকে সাবমার্সিবলে একটি ট্যুর দেন, সেই অভিজ্ঞতা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি জানান যে, জাহাজটিতে শুধু একটি বোতাম রয়েছে এবং এটি একটি ভিডিও গেম কন্ট্রোলার ব্যবহার করে চালানো হয়। এর ভেতরে থাকা আরোহীদের বাইরের কারও সাহায্য ছাড়া বেরিয়ে আসা অসম্ভব।
গত সোমবার তিনি বলেন, যাত্রীদের মূল ক্যাপসুলের ভেতরে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে বেশ কয়েকটি বোল্ট দিয়ে সিল করে দেওয়া হয়েছিল এবং বাইরে থেকে সেই স্ক্রু খোলার পর সবাই বেরোতে পেরেছেন। তিনি দ্য কনটেক্সট প্রোগ্রামকে বলেছিলেন যে জাহাজটির পানির ওপরে উঠে আসার সাতটি ভিন্ন ফাংশন ছিল। কিছু চিন্তার বিষয় হলো সেগুলোর মধ্যে কোনোটিই এখন পর্যন্ত কাজ করেনি।
তিনি বলেন, যদি সাবমেরিনটি আটকে পড়ে বা ফুটো হয়ে যায় তাহলে এর উঠে আসা নিয়ে কথা বলা অপ্রাসঙ্গিক হবে। কোনো ব্যাকআপ নেই, কোনো পালানোর পড নেই। এটি হয় সমুদ্রপৃষ্ঠে উঠে আসবে নাহলে সবাই মারা যাবে।
নিখোঁজ এই সাবমেরিনের সর্বশেষ অবস্থা
নিখোঁজ সাবমেরিন থেকে আবারও শব্দ শোনা গেছে বলে জানিয়েছে মার্কিন কোস্টগার্ড। বুধবার এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানানো হয়। ফলে এর তল্লাশি অভিযানের আওতা আরও বাড়ানো হচ্ছে। একটি এইচসি-১৩০ হারকিউলিস ফ্লাইট ৮৭৯ মাইল (১৪০০ কিলোমিটার) এলাকা জুড়ে তল্লাশি চালাচ্ছে।
সংবাদ সম্মেলনে কোস্টগার্ডের ক্যাপ্টেন জেমি ফ্রেডরিক বলেছেন, তল্লাশি অভিযানে শিগগিরই আরও জাহাজ ও রিমোটলি অপারেটেড ভেহিক্যাল (গভীর সাগরে অনুসন্ধান করার যন্ত্র) যুক্ত করা হবে।
ধারণা করা হচ্ছে, ২০ ঘণ্টার কম সময়ের অক্সিজেন সাবমেরিনে মজুত আছে।
এর আগে গত মঙ্গলবার অনুসন্ধানের তৃতীয় দিনে কানাডীয় উড়োজাহাজ সাবমেরিন নিখোঁজ হওয়া এলাকায় পানির তলদেশে একধরনের শব্দ শনাক্ত করে। পরে তা যুক্তরাষ্ট্রের কোস্টগার্ডকে জানানো হয়।
সাবমেরিনটিতে যে পরিমাণ অক্সিজেন মজুত ছিল, তা দিয়ে ৯৬ ঘণ্টা পানির নিচে টিকে থাকা যাবে। সে অনুযায়ী, সাবমেরিনটি যদি এখন পর্যন্ত অক্ষত থাকে, তাহলে এর যাত্রীরা আজ বৃহস্পতিবার সকাল পর্যন্ত অক্সিজেন সরবরাহ পাবেন। ফ্রেডরিক বলেন, যাত্রীদের বেঁচে থাকার ক্ষীণ আশা থাকায় উদ্ধার অভিযান অব্যাহত থাকবে।
টাইটানিক জাহাজটি ১৯১২ সালে সাউদাম্পটন থেকে নিউইয়র্ক আসার পথে একটি বরফ খণ্ডের সাথে ধাক্কা লেগে ডুবে যায়। এটি ছিল সেই সময়ের সবচেয়ে বড় জাহাজ এবং প্রথম যাত্রাও তা শেষ করতে পারেনি। ওই দুর্ঘটনায় জাহাজে থাকা ২২০০ যাত্রী এবং ক্রুদের মধ্যে ১৫০০ জনের বেশি মানুষ মারা গিয়েছিল।
১৯৮৫ সালে জাহাজটির ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হওয়ার পর থেকে এ নিয়ে ব্যাপক অনুসন্ধান শুরু হয়।