কেটে গেল একবিংশ শতাব্দীর আরও একটি বছর। শনিবারে শুরু হওয়া বছরটির শেষটাও শনিবারেই। ২০২২ সালকে আন্তর্জাতিক মৎস্য ও কৃষিশিল্প হিসেবে ঘোষণা করেছিল জাতিসংঘ। ঘটনাবহুল এ বছর পৃথিবীর ইতিহাসে অনন্য হয়ে থাকবে। কিছু কিছু ঘটনা মানবসভ্যতার মোড় পাল্টে দিয়েছে, প্রভাব ফেলেছে মানুষের জীবনযাত্রায়। চলুন ক্রমান্বয়ে জেনে নিই বিশ্বকে প্রভাবিত করা ২০২২ সালের ২২টি ঘটনা।
১. যা-ই ঘটুক, পারমাণবিক যুদ্ধ করবে না পাঁচ বিশ্বশক্তি
যা কিছুই ঘটুক বা যে পরিস্থিতিই আসুক, কোনোভাবেই পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার না করার শপথ নেয় যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও চীন। কারণ, পরমাণু যুদ্ধে ক্ষতি ছাড়া কারও লাভ হবে না। কোনো দেশের পক্ষেই জয়লাভ করা সম্ভব নয়। বরং ধ্বংস হয়ে যাবে আমাদের পৃথিবী। গত ৩ জানুয়ারি ২০২২ দেশগুলো এ বিষয়ে একটি যৌথ বিবৃতি প্রকাশ করে।
২. রাশিয়া-ইউক্রেন উত্তেজনা, যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র-সহায়তা
ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ২০১৪ সালের পর ২০২১ সালে রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে নতুন করে উত্তেজনা শুরু হয়। ২০২২-এ তা ওঠে চরমে। ২০২১ সালের জুলাই মাসে ইউক্রেনকে রাশিয়ার জাতিভুক্ত বলে পুতিনের ঘোষণা এবং ইউক্রেনের ন্যাটোতে যোগদানের ইচ্ছা এই নতুন উত্তেজনার কারণ। সঙ্গে আছে কিছু ঐতিহাসিক বিষয়। আর এই দ্বন্দ্বে রসদ জোগায় ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্র। যা রাশিয়ার জন্য নতুন হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। বিশ্ব আশঙ্কা করে পুতিন ইউক্রেনে হামলা চালাতে পারেন। ২১ জানুয়ারি ২০২২ সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় কূটনৈতিক পর্যায়ের বৈঠকে ইউক্রেন ইস্যুতে চলমান উত্তেজনা হ্রাসে সম্মত হয় যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া। আর সেদিনই ইউক্রেনে ৯০ টন সামরিক সরঞ্জাম পাঠায় যুক্তরাষ্ট্র। ফেব্রুয়ারি মাসের ২১ তারিখ রাশিয়ার পার্শ্ববর্তী ইউক্রেনের বিচ্ছিন্নতাকামী দুই অঞ্চল লুহানস্ক ও দোনেৎস্ককে স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দেয় রাশিয়া।
৩. করোনা আক্রান্তের নিম্নগতি
চীনের উহান থেকে শুরু হওয়া কোভিড-১৯-এর সংক্রমণে এখন পর্যন্ত পুরো বিশ্বে আক্রান্ত হয়েছেন প্রায় সাড়ে ৬৫ কোটি মানুষ। মারা গেছেন সাড়ে ৬৬ লাখ রোগী। পুরোদমে টিকা কার্যক্রম চলতে থাকায় ২০২২ সালের শুরু থেকে করোনা সংক্রমণের হার দ্রুত কমতে শুরু করে। শূন্যের কোঠায় না পৌঁছালেও, বৈশ্বিক অর্থনীতির চাকা পুনরায় ঘুরতে পারার জন্য তা যথেষ্ট ছিল। ফলাফলও ছিল সামনে। অর্থনৈতিক কার্যক্রম আবারও করোনাপূর্ব সময়ের মতোই চলতে থাকে পূর্ণ শক্তি দিয়ে। তবে ঘটনাচক্রে এই ধারা আর অব্যাহত থাকেনি।
৪. রাশিয়ায় ইউক্রেনের আগ্রাসন
ইউক্রেনের ন্যাটেতে যোগদানের হুমকি, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে যোগদানের তোড়জোড় এবং দেশটিতে রুশ ভাষাভাষীদের নিরাপত্তাহীনতাকে পুঁজি করে ২৪ ফেব্রুয়ারি ‘বিশেষ সামরিক অভিযান’ নামে আক্রমণ শুরু করে রাশিয়া। রাশিয়ার দাবি, ইউক্রেন পশ্চিমাদের বলয়ে চলে গেলে, রাশিয়ার সীমান্তে তাদের প্রভাব আরও বেড়ে যাবে এবং এই অঞ্চলে রুশ প্রভাব ক্ষুণ্ন হবে। করোনার অভিঘাত সয়ে যখন পৃথিবীর অর্থনীতি উঠে দাঁড়াতে শুরু করে, তখন রাশিয়ার এমন পদক্ষেপে হতবাক হয় বিশ্ব। নানা রাজনৈতিক সমীকরণে এলোমেলো রূপ ধারণ করে বিশ্বায়ন। যুদ্ধের প্রভাব পড়ে আমদানি-রপ্তানিতে। অপরিশোধিত তেল, গ্যাস, গম ও নিত্যপ্রয়োজনীয় সব দ্রব্যের দাম বেড়ে গিয়ে জনজীবনে সৃষ্টি করে বিপর্যয়। সমাধানে না গিয়ে রাশিয়াকে একঘরে করার চেষ্টা করে পশ্চিমা বিশ্ব। ইউক্রেনকে আর্থিক ও সামরিক সহায়তা দিয়ে শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ার সুযোগ দেয় তারা। দুই পক্ষের তুমুল যুদ্ধে ভুগছে পুরো বিশ্বের মানুষ। বাড়ছে ডলারের চাহিদা, মুখ থুবড়ে পড়েছে অনুন্নত ও উন্নয়নশীল বিশ্ব। শেষ হওয়ার কোনো লক্ষণ না দেখিয়ে ১১তম মাসে পা দিয়েছে এই যুদ্ধ।
৫. প্রথমবারের মতো সক্রিয় হয় ন্যাটোর রেসপন্স টিম
১৯৪৯ সালে জোট গঠনের পর প্রথমবারের মতো ন্যাটোর রেসপন্স ফোর্সকে সক্রিয় করা হয় ২৫ ফেব্রুয়ারি। ইউক্রেনে রুশ হামলার ঘটনায় এই বাহিনীকে সক্রিয় করা হয়। তবে আক্রমণের জন্য নয়, প্রতিরক্ষামূলক পদক্ষেপ হিসেবে এই সিদ্ধান্ত নেয় পশ্চিমাদের এই সামরিক জোট। ন্যাটোর সুপ্রিম অ্যালিট কমান্ডার জেনারেল টড ওল্টার্স বহু দেশীয় এ বাহিনীকে সক্রিয় করেন। বাহিনীতে আছেন স্থল, বিমান, নৌ ও স্পেশাল অপারেশন্স ফোর্সের সদস্যরা।
৬. পাকিস্তানে ইমরানের পতন, মসনদে শাহবাজ
১৪ আগস্ট ১৯৪৭ থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত পাকিস্তানের কোনো প্রধানমন্ত্রীই টানা পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকতে পারেনি। এ বছর অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা ও ভুল পররাষ্ট্রনীতির অভিযোগে পাকিস্তানের বিরোধী দলগুলো দেশটির প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনে। ৭ মার্চ ২০২২ জাতীয় পরিষদে অনাস্থা প্রস্তাব জমা দেয় তারা। এরপর নানা নাটকীয়তা শেষে ১০ এপ্রিল রাত ২টার দিকে পাকিস্তানের পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষে জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে অনাস্থা প্রস্তাবে ভোটাভুটি অনুষ্ঠিত হয়। ভোটে হেরে যান ইমরান খান। নতুন প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন শাহবাজ শরিফ। ১৯ এপ্রিল গঠন করা হয় পাকিস্তানের নতুন মন্ত্রিসভা।
৭. অর্থনৈতিক সংকটে বিপর্যস্ত শ্রীলঙ্কা
দক্ষিণ এশিয়ার দ্বীপদেশ শ্রীলঙ্কা। করোনার পর ইতিহাসের ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকটে পড়ে পর্যটননির্ভর দেশটি। তবে এই সংকটের উৎস আরও গভীরে। দীর্ঘদিন ধরে শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্রের ছোবল, সীমাহীন দুর্নীতি, ঋণ করে ঘি খেয়ে চীনের ঋণ ফাঁদে পা দেওয়া ও অর্গানিক কৃষি চালু করার মতো বেশ কয়েকটি ভুল সিদ্ধান্তের কারণে সংকট ঘনীভূত হয় দেশটিতে। খাদ্য, ওষুধ ও জ্বালানির অভাবে জীবনযাপন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে জনগণের জন্য। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ তলানিতে থাকায় সরকারের হাতে দেশকে টেনে তোলার মতো কিছু অবশিষ্ট থাকে না। সংকট থেকে দেশ ও জনগণকে উদ্ধারে সরকারের ব্যর্থতার প্রতিবাদে ৩১ মার্চ রাজধানী কলম্বোয় প্রেসিডেন্ট ভবনের সামনে বিক্ষোভ শুরু হয়। বিক্ষোভ ঠেকাতে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে সেনাবাহিনী নামালেও পরিস্থিতি শান্ত হয় না। ফলাফল রাজপাকসে পরিবারের পতন। নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর আইএমএফের ঋণসহায়তা দিয়ে সংকট মোকাবিলা করার চেষ্টা চালায় শ্রীলঙ্কা। দেশটির এমন পরিস্থিতি সতর্কবার্তা হয়ে ওঠে উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য।
৮. প্রেসিডেন্ট হিসেবে জো বাইডেনের প্রথম এশিয়া সফর
এশিয়ায় মার্কিন প্রভাব বাড়াতে ব্যস্ত যুক্তরাষ্ট্র। এ লক্ষ্যে দেশটির প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ২০-২৪ মে দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপান সফর করেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতা গ্রহণের পর এটি তার প্রথম এশিয়া সফর। ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল এবং দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের চুক্তি জোরদার করার উদ্দেশ্যে বাইডেন এ সফর করেন। ২৩ মে জাপানের টোকিওতে আইপিইএফ জোটের আত্মপ্রকাশ ঘটে। ১৩টি সদস্য দেশ নিয়ে যাত্রা শুরু করে এই অর্থনৈতিক জোট। মূলত চীনকে টেক্কা দিতেই এই জোটের আবির্ভাব।
৯. মাঙ্কিপক্স আতঙ্ক
কোভিড আতঙ্ক কিছুটা প্রশমিত হওয়ার পর মে মাসে শুরু হয় মাঙ্কিপক্স আতঙ্ক। আফ্রিকার পশ্চিম ও মধ্য অঞ্চলে উৎপত্তি হওয়া এই ভাইরাসটিতে আক্রান্ত শনাক্ত হয় যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশে। বানরের মধ্যে এই রোগের অস্তিত্ব পাওয়া যায় বলে ভাইরাসটির নাম মাঙ্কিপক্স। এটি প্রথম শনাক্ত হয় ১৯৫৮ সালে। এই ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীরা মারাত্মক পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে পারে। তবে সাধারণত ১৪-২১ দিনে সেরে ওঠেন এই ছোঁয়াছে রোগে আক্রান্ত রোগীরা। তবে মাঙ্কিপক্সের কোনো চিকিৎসা এখনো আবিষ্কৃত হয়নি, যদিও সংক্রমণ প্রতিরোধের মাধ্যমে প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এ ছাড়া আশার ব্যাপার হলো, এই ভাইরাস প্রতিরোধে গুটিবসন্তের টিকা ৮৫ শতাংশ কার্যকর বলে প্রমাণিত হয়েছে।
১০. ঘূর্ণিঝড় অশনির আঘাত
দক্ষিণ বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট একটি লঘুচাপ রূপ নেয় ঘূর্ণিঝড়ে। অশনি নামের এই ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাব পড়ে ভারত, বাংলাদেশ ও মিয়ানমার উপকূলে। তবে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ভারত। ১১ মে মধ্যরাতে ঘূর্ণিঝড়টি আঘাত হানে ভারতের অন্ধ্র প্রদেশের মছিলিপত্তনম ও নারসাপুরমে। অশনির প্রভাবে ভারতে উপকূলীয় অঞ্চলে প্রায় ৫৫ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টা গতিতে বাতাস বয়ে যায় এবং বৃষ্টিপাত হয় ৭ সেন্টিমিটারের ওপরে, তাপমাত্রা নেমে যায় ২৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। অশনি নামটি দেয় শ্রীলঙ্কা। সিংহলী ভাষায় যার অর্থ ক্ষুব্ধ।
১১. শিনজো আবে হত্যাকাণ্ড
জাপানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবেকে হত্যা করা হয় ৮ জুলাই। নির্বাচনী প্রচারাভিযানে বক্তৃতা দেওয়ার সময় তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর কোণঠাসা হয়ে পড়া জাপানকে সামরিক ও অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী করে তুলতে কাজ করেন চারবারের নির্বাচিত এই প্রধানমন্ত্রী। তিনিই জাপানের সবচেয়ে বেশি সময় ধরে শাসন করা প্রধানমন্ত্রী। ২০১৪ সালে তিনি এবেনোমিকস তত্ত্ব চালু করেন। যার মাধ্যমে আরও চাঙা হয়ে ওঠে জাপানের অর্থনীতি। স্বাস্থ্যগত কারণে ২০২০ সালে ক্ষমতা ছাড়েন তিনি। তার এমন আকস্মিক মৃত্যুতে বিমর্ষ হয়ে ওঠে পুরো বিশ্ব। তার দীর্ঘদিনের শাসনামলে বিশ্বের বহুদেশের সঙ্গে জাপানের সুসম্পর্ক গড়ে তোলেন।
১২. খাদ্যশস্য রপ্তানিতে ঐতিহাসিক চুক্তি
ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের কারণে থমকে যায় খাদ্যশস্য রপ্তানি। ঝুঁকিতে পড়ে আফ্রিকাসহ বিশ্বের অনেকগুলো দেশের কোটি কোটি মানুষ। ইউক্রেনের খাদ্যসশ্যের ওপর নির্ভরশীল দেশগুলোর পাশে দাঁড়াতে তুরস্ক ও জাতিসংঘের উদ্যোগে একটি রপ্তানি চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে রাজি হয় রাশিয়া ও ইউক্রেন। ২২ জুলাই এ চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে বিশ্ববাজারে শস্য রপ্তানির জন্য কৃষ্ণসাগরে ইউক্রেনের বন্দরগুলো মুক্ত করে রাশিয়া। পাশাপাশি শস্যবাহী জাহাজ চলাচলে বাধা না দিতে সম্মত হয়। তবে চুক্তি স্বাক্ষরের সময় রাশিয়া ও ইউক্রেনের মন্ত্রীরা এক টেবিলে বসেননি। এমনকি তারা হাতও মেলাননি। তবে এই চুক্তির ফলে স্বস্তি আসে খাদ্যশস্যের বাজারে।
১৩. যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী পদ নিয়ে টানাপোড়েন
পার্টিগেট কেলেঙ্কারি মাথায় নিয়ে পদত্যাগ করেন প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন। কোভিড বিধিনিষেধ উপেক্ষা করে সরকারি বাসভবনে মদের আসর বসানোয় ক্ষেপেন তার দলের সদস্যরা। ৭ জুলাই ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ান তিনি। এরপর শুরু হয় দলের প্রধান ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনের পালা। মাঠে নামেন দুজন, লিজ ট্রাস ও ঋষি সুনাক। দলের সদস্যরা বিপুল ভোটে জয়ী করেন লিজ ট্রাসকে। ৭ সেপ্টেম্বর ক্ষমতা গ্রহণ করেন তিনি। তবে বিতর্কের মুখে ক্ষমতা গ্রহণের মাত্র ছয় সপ্তাহের মধ্যেই ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন তিন। যুক্তরাজ্যের অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে সংক্ষিপ্ত বাজেট ঘোষণার পর তা হিতে বিপরীত রূপ নেয়। পড়তে শুরু করে পাউন্ডের মান। আবারও অস্থিরতার মুখে পড়ে দেশটির অর্থনীতি। নিজ দলের সদস্যদের অনাস্থার মুখে ক্ষমতা ছাড়তে হয় লিজ ট্রাসকে। এর মাধ্যমে তিনি হন যুক্তরাজ্যের সবচেয়ে কম সময় ক্ষমতায় থাকা ৪৫ দিনের প্রধানমন্ত্রী। এরপর আবারও আসে নতুন নেতৃত্ব নির্বাচনের পালা। কপাল খুলে যায় আগেরবার হেরে যাওয়া ভারতীয় বংশোদ্ভূত ঋষি সুনাকের। ২৪ অক্টোবর নিজ দলের সাংসদদের সমর্থন নিয়ে চলেই আসেন ক্ষমতায়। তবে উদযাপন না করে দেশের কাজে মনোযোগ দেন তিনি।
১৪. বাইডেনের সৌদি সফর এবং খাসোগি হত্যা মামলায় সালমানের মুক্তি
২০১৯ সালের নির্বাচনী প্রচারে বাইডেন প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন খাসোগি হত্যায় যুবরাজ সালমানের শাস্তি নিশ্চিত করা হবে। প্রয়োজনে সৌদি আরবকে একঘরে করা হবে বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন তিনি। নির্বাচনে জেতার পর তিনি যুবরাজের সঙ্গে কথা বলতেও নারাজ ছিলেন। তবে এ বছরের জুলাই মাসে সৌদি যুবরাজের সঙ্গে সম্পর্ক নতুন করে সাজানোর সিদ্ধান্ত নেন তিনি এবং সেই মাসেই যুবরাজের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে সৌদি সফরে যান। এরপর গত সেপ্টেম্বরে সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান দেশটির প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত হন এবং নভেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ঘোষণা আসে যে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কারণে আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে খাসোগি হত্যা মামলায় সালমানের বিচার সম্ভব নয় এবং ডিসেম্বরে খারিজ হয়ে যায় মামলাটি। এই সিদ্ধান্তকে ‘খাসোগির দ্বিতীয় মৃত্যু’ বলে উল্লেখ করেছিলেন খাসোগির বাগদত্তা হাটিস সেনজিজ।
১৫. মার্কিন ড্রোন হামলায় আল-কায়েদা শীর্ষ নেতা আয়মান আল-জাওয়াহিরি নিহত
আল-কায়েদার শীর্ষ নেতা ওসামা বিন লাদেনকে হত্যা করা হয় বারাক ওবামার শাসনামলে, ২০১১ সালের মে মাসে। লাদেনের মৃত্যুর পর সশস্ত্র এই সংগঠনটির দায়িত্ব গ্রহণ করেন তার ডান হাত খ্যাত আয়মান আল-জাওয়াহিরি। এই দুজনই যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন বলে জানানো হয়। ৭১ বছর বয়সী জাওয়াহিরিকে হত্যার নির্দেশ দেন যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। সেফ হাউসের বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকার সময় ৩১ জুলাই, রোববার জাওয়াহিরির ওপর ড্রোন হামলা করা হয়। এই হামলায় হতাহত হয়নি সেই ভবনে থাকা তার পরিবারের কেউ।
১৬. রানির শাসনের ৭০ বছর ও মহাপ্রয়াণ, নতুন রাজার আগমন
২০২২ সালে ব্রিটিশ রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের সিংহাসনে বসার ৭০ বছর পূর্তি উদযাপন করে যুক্তরাজ্য। ১৯৫২ সালে মাত্র ২৫ বছর বয়সে ক্ষমতা গ্রহণ করেন তিনি। জমকালো আয়োজনে ফেব্রুয়ারি মাসে চার দিনের উৎসবে পুরো দেশজুড়ে রানির সিংহাসনে আরোহণের প্লাটিনাম জুবিলি পালন করা হয়। তবে এ বছরই ৯৬ বছর বয়সে প্রয়াণ হয় রানির। ৮ সেপ্টেম্বর স্থানীয় সময় বিকেলে যুক্তরাজ্যের স্কটল্যান্ডে অ্যাবারডিনশায়ারে নিজস্ব বাসভবন বালমোর্যাল ক্যাসলে তিনি মারা যান তিন। ১০ দিনের শোক পালন করে যুক্তরাজ্য। এরপর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার অনুষ্ঠান শেষে উইন্ডসোর প্রাসাদে কবরস্থানে স্বামী প্রিন্স ফিলিপের পাশে শায়িত হন রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ। সমাপ্তি হয় সুবর্ণ এক ইতিহাসের। রানির স্বামী ডিউক অব এডিনবার্গ প্রিন্স ফিলিপের মৃত্যু হয় ২০২১ সালের ৯ এপ্রিল। রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের মৃত্যুর পর যুক্তরাজ্যের নতুন রাজা হয়েছেন তাদের বড় ছেলে তৃতীয় চার্লস এবং তার স্ত্রী ক্যামিলা ‘দ্য কুইন কনসোর্ট’ বলে ঘোষিত হন।
১৭. ইরানে বিক্ষোভ
সঠিকভাবে হিজাব না পরার কারণে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে মাসা আমিনি নামের এক তরুণীকে আটক করে ইরানের সদ্য বিলুপ্ত নৈতিকতা পুলিশ। আটকের তিন দিনের মাথায় ১৬ সেপ্টেম্বর পুলিশি হেফাজতে তার মৃ্ত্যুর পর দ্রুত বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে ইরানে। দেশটির ৩১টি প্রদেশের সব কটিতে আন্দোলনে নামে বিক্ষোভকারীরা। প্রতিবাদ জানান বিদেশি রাষ্ট্রের নাগরিকরাও। ১৯৭৯ সালে ইসলামিক বিপ্লবের পর অন্যতম সংকট তৈরি করে এই আন্দোলন। নারী স্বাধীনতার পক্ষের এই আন্দোলনকে দাঙ্গা হিসেবে উল্লেখ করে কঠোর হস্তে তা দমন করতে শুরু করে দেশটির সরকার। এখন পর্যন্ত সেখানে ৪৮৮ জনের মৃত্যু হয়েছে এবং আটক হয়েছে ১৮ হাজার ২৪০ জন। নিহতদের মধ্যে ৬২ জন নিরাপত্তাকর্মীও আছেন। মৃত্যুদণ্ড পেয়েছেন ১১ বিক্ষোভকারী।
১৮. যুক্তরাজ্যের নেতৃত্বে ভারতীয় বংশোদ্ভূত
২৫ অক্টোবর ২০২২ আনুষ্ঠানিকভাবে যুক্তরাজ্যের ৫৭তম প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত হিন্দুধর্মাবলম্বী ঋষি সুনাক। যুক্তরাজ্যের ইতিহাসে এমন ঘটনা এবারই প্রথম। আর এর মাধ্যমে ভারতীয় বংশোদ্ভূত এ রাজনীতিক গড়লেন নতুন ইতিহাস। দেশটিতে প্রথমবারের মতো একজন ব্রিটিশ-এশিয়ান রাজনীতিক প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। ঋষি সুনাকের ব্রিটিশ রাজনীতির চূড়ায় আরোহণ, পুরো ভারতজুড়ে উদ্যাপিত হয়েছে। এছাড়া এ ঘটনার মাধ্যমে পশ্চিমা দেশগুলোর রাজনীতিতে ভারতীয় প্রবাসীদের প্রাধান্য বিস্তারের ধারাও সামনে এসেছে।
১৯. নোবেল পুরস্কার ২০২২
প্রতিবছরের ধারাবাহিকতা রক্ষা করে এবারও অক্টোবর মাসে ঘোষিত হলো বিশ্বের সবচেয়ে সম্মানজনক ‘নোবেল পুরস্কার’ বিজয়ীদের নাম। ছয়টি শাখায় পুরস্কার জিতেছেন ১২ জন ও ২টি সংস্থা। চিকিৎসাবিজ্ঞানে এককভাবে নোবেল পেয়েছেন সুইডেনের বাসিন্দা সান্তে প্যাবো। পদার্থবিজ্ঞানে যুগ্মভাবে বিজয়ী হয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের বাসিন্দা জন ক্লোজার, ফ্রান্সের বাসিন্দা অ্যালেন অ্যাসপেক্ট এবং অস্ট্রেলিয়ার বাসিন্দা অ্যাটন জেলিঙ্গার। রসায়নশাস্ত্রে যুগ্মভাবে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী হলেন যুক্তরাষ্ট্রের বাসিন্দা ক্যারোলিন আর. বার্তোজী, কার্ল ব্যারি সার্পলেশ এবং ডেনমার্কের বাসিন্দা মর্টেন মেন্ডল। সাহিত্যে এককভাবে নোবেলজয়ী হলেন ফরাসি বাসিন্দা তথা লেখিকা অ্যানি এখন্যু। শান্তিতে যুগ্মভাবে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন বেলারুশের মানবাধিকার আইনজীবী আলেস বিলিয়াতস্কি, রুশ মানবাধিকার সংস্থা মেমোরিয়াল এবং ইউক্রেনের মানবাধিকার সংস্থা সেন্ট্রাল ফর সিভিল লিব্যার্টিজ। অর্থনীতিতে নোবেল পেয়েছেন তিন অর্থনীতিবিদ বেন এস বারন্যাঙ্ক, ডগ্লাস ডব্লিউ ডায়মন্ড এবং ফিলিপ এইচ ডিবভিগ। তিনজনই যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক।
২০. ইমরান খানকে হত্যাচেষ্টা
৩ নভেম্বর সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের (পিটিআই) চেয়ারম্যান ইমরান খানকে হত্যার উদ্দেশ্যে গুলি চালায় এক আততায়ী। ইমরানের পায়ে গুলি লাগার ফলে তিনি প্রাণে বেঁচে যান। দেশটির পাঞ্জাব প্রদেশের ওয়াজিরাবাদ জেলার গুজরানওয়ালায় সমাবেশকালে পাকিস্তানের সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর ওপর হামলা চালানো হয়। রাজধানী ইসলামাবাদ অভিমুখে ইমরানের পিটিআই দলের রাজনৈতিক কর্মসূচি ‘লংমার্চ’ এর অংশ হিসেবে এই সমাবেশ চলছিল। আগাম নির্বাচনের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করার লক্ষ্যে এ ‘লংমার্চের’ ডাক দিয়েছিলেন ইমরান।
২১. দীর্ঘ লড়াইয়ের পর মসনদে আনোয়ার
২৪ নভেম্বর ২০২২ মালয়েশিয়ার দশম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ আনোয়ার ইব্রাহিম। প্রধানমন্ত্রী পদে তার দৌড় শুরু হয় ১৯৯০ সালে। এরপর হঠাৎই তাকে জেলে পাঠানো হয়। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হওয়া সাধারণ নির্বাচনে আনোয়ারের জোট পাকাতান হারাপান সবচেয়ে বেশিসংখ্যক আসনে জয়লাভ করে। তবে সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় ১১২টি আসন পায়নি তার জোট। তারা পান ৮২টি আসন। অন্যদিকে তার প্রতিদ্বন্দ্বী জোট মুহিউদ্দিন ইয়াসিনের নেতৃত্বাধীন পেরিকটান ন্যাশনাল কোয়ালিশন পায় ৭৩টি আসন। ফলে ঝুলন্ত সরকার গঠনের দিকেই হাঁটছিল মালয়েশিয়া। তবে এমন পরিস্থিতিতে এগিয়ে আসেন দেশটির রাজা এবং তিনিই আনোয়ার ইব্রাহিমকে পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্ধারণ করেন। দেশটির রাজার ডিক্রি ও নতুন ফেডারেল সরকার গঠনের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়। তবে ক্ষমতা গ্রহণের এক মাস না পেরোতেই সংসদে আস্থা ভোটের মোকাবিলা করেন তিনি। উপপ্রধানমন্ত্রীর উত্থাপিত এই আস্থা ভোটেও জয়লাভ করেন তিনি।
২২. যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যবর্তী নির্বাচন
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে জো বাইডেনের ক্ষমতা গ্রহণের দুই বছর পূর্ণ হওয়ার পর অনুষ্ঠিত হয় দেশটির মধ্যবর্তী নির্বাচন। ৮ নভেম্বর স্থানীয় সময় সকাল ১০টায় ভোট গ্রহণ সম্পন্ন হলেও, ৬ ডিসেম্বর পুনরায় অনুষ্ঠিত হয় জর্জিয়া অঙ্গরাজ্যের ভোট। বাইডেনের অবশিষ্ট মেয়াদের জন্য সিনেটে তার দল ডেমোক্র্যাটের সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিশ্চিত হয় এই নির্বাচনে। এই জয়ের মাধ্যমে কংগ্রেসে আধিপত্য ধরে রাখতে পারবেন বাইডেন। কংগ্রেসের উচ্চ ও নিম্ন উভয় কক্ষেই ডেমোক্র্যাটদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকায় যেকোনো আইন পাসে তাকে ঝামেলা পোহাতে হবে না। তাই বোঝা যাচ্ছে আগামী দুই বছর তুলনামূলক বাধাহীন কাটাবেন বাইডেন। মধ্যবর্তী নির্বাচনে এবার ভোট হয়েছে কংগ্রেসের প্রতিনিধি পরিষদের ৪৩৫টি আসনের সব কটির জন্য এবং ১০০ সিনেট আসনের মধ্যে ৩৫টির জন্য। তবে নির্বাচনের আগে করা জরিপগুলোতে মার্কিন কংগ্রেসে ট্রাম্পের রিপাবলিকান দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভের প্রবল সম্ভাবনা দেখা গিয়েছিল।