বেদির ওপর সাত সারি কবর। এর মধ্যে প্রথম চার সারিতে রয়েছে ১১টি, পঞ্চম সারিতে ৫টি এবং ষষ্ঠ ও সপ্তম সারিতে ৭টি। কবরের মোট সংখ্যা ৬৩টি। দূরত্ব, আকার আর নকশার মিল দেখে মনে হয় এগুলো একই সময়ে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের জন্য তৈরি করা হয়েছিল।
এ ছাড়া সমতল উপরিভাগ দেখেই বোঝা যায় এই সব কবর নারীদের। অনেকগুলো কবর থাকা সত্ত্বেও ‘ষাট কবর’ নামে পরিচিত এই ‘ডার্ক ট্যুরিস্ট স্পট’ (গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু দুঃখজনক ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক ঘটনার স্থান) ভারতের কর্ণাটকের বিজাপুরে অবস্থিত। শহরটি ১৬৬৮ সাল পর্যন্ত আদিল শাহী শাসকদের অধীনে ছিল।
এই সাম্রাজ্যের সেনাপতি আফজাল খান বিজাপুরকে দক্ষিণ দিকে সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।
‘বিজাপুর: দ্য ওল্ড ক্যাপিটাল অব দ্য আদিল শাহ কিংস’ বইয়ে কাজিন্স লিখেছেন, আফজাল খান এই ভবিষ্যদ্বাণীতে এতটাই বিশ্বাস করেছিলেন যে সেই অনুযায়ী তিনি পরবর্তী সব সিদ্ধান্ত নেন।
মারাঠা যোদ্ধারা শিবাজীকে মোকাবিলায় ব্যর্থ হলে ১৬৫৯ সালে বিজাপুরের তৎকালীন সুলতান দ্বিতীয় আলি আদিল শাহ তাদের শায়েস্তা করার জন্য তার সেনাপতি আফজাল খানকে পাঠান।
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে ভারতের প্রত্মতাত্ত্বিক সংস্থা আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়াতে কাজ করা স্কটিশ প্রত্নতাত্ত্বিক হেনরি কাজিন্সের মতে, জ্যোতিষীরা আফজাল খানকে বলেছিলেন যে তিনি অভিযান থেকে জীবিত ফিরবেন না।
কাজিন্স তার লেখা বই ‘বিজাপুর: দ্য ওল্ড ক্যাপিটাল অব দ্য আদিল শাহ কিংস’-এ বলেছেন, আফজাল খান এই ভবিষ্যদ্বাণীতে এতটাই বিশ্বাস করেছিলেন যে তিনি সেই অনুযায়ী পরবর্তী সব সিদ্ধান্ত নেন।
১৯০৫ সালে মুদ্রিত এই বইটিতে লেখা আছে যে, “ঐতিহ্য অনুসারে, তিনি (আফজাল খান) তার জীবদ্দশায় নিজ সমাধি (নিজ প্রাসাদের কাছে) এবং এর সঙ্গে সংযুক্ত মসজিদ তৈরি করেন।”
জানা যায়, ১৬৫৩ সালে এই দোতলা মসজিদটির কাজ শেষ হয়। (ধারণা করা হয় ওপরের তলাটি নারীর জন্য সংরক্ষিত ছিল)। এর শিলালিপিতে আফজাল খানের নামের সঙ্গে নির্মাণের তারিখটিও লিপিবদ্ধ আছে।
যদিও যখন তাকে শিবাজীর বিরুদ্ধে অভিযানের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল তখনো সমাধির কাজ শেষ হয়নি।
স্ত্রীদের ডুবিয়ে হত্যার সিদ্ধান্ত
এই ভবিষ্যদ্বাণীতে আফজাল খান এতটাই প্রভাবিত হয়েছিল যে তিনি সমাধির পাথরে তার প্রস্থানের তারিখটিকেই নিজের মৃত্যুর তারিখ হিসেবে লিখে যান। তার কারণেই বিজাপুর ত্যাগ করার সময় তিনি এবং তার বন্ধুরা ধরে নিয়েছিলেন যে তিনি আর কখনো সেখানে ফিরবেন না। এ কারণেই তিনি স্ত্রীদের ডুবিয়ে হত্যার সিদ্ধান্ত নেন।
ইতিহাসবিদ লাক্সমি শারাথ `দ্য হিন্দু` নামের একটি ভারতীয় পত্রিকায় লিখেছেন যে আফজাল খান তার সব স্ত্রীকে একে একে কূপে ফেলে দেন, যাতে তারা যুদ্ধে মারা যাওয়ার পরে শত্রুদের হাতে না পড়ে।
“তার স্ত্রীদের মধ্যে একজন পালানোর চেষ্টা করেও ধরা পড়ে এবং নিহত হন।”
স্ত্রীদের পাশে সমাহিত হতে চেয়েছিলেন আফজাল খান
মুহম্মদ শাইক ইকবাল চিশতীর বরাত দিয়ে আনিসুর রহমান খান লিখেছেন, জনশ্রুতি আছে যে সেখানে ৬০টি কবর রয়েছে। তবে আসলে কবর আছে ৬৪টি।
এগুলোর মধ্যে একটি কবর মাটির সঙ্গে মিশে গেলেও এর স্পষ্ট চিহ্ন রয়েছে। ‘গঠন দেখে বোঝা যায় এখানকার সব কবরই নারীদের।’
তিনি লিখেছেন, “এই সমাধিস্থলটি হয়তো রাজপরিবারের নারীদের জন্য সংরক্ষিত ছিল। আদিল শাহী শাসনকালটি জ্ঞানচর্চার দিক থেকে স্বর্ণযুগ ছিল আর রাজাদের আমলে সাম্রাজ্যের জন্য যুদ্ধ করাও একটি সাধারণ বিষয় ছিল। এমন প্রেক্ষাপটে সেই আমলের একজন যোদ্ধা কী করে অজ্ঞতায় ভরা এমন কাপুরুষোচিত পদক্ষেপ নিতে পারে?”
তবে লাক্সমি শারাথের মতো পর্যটকরা এই সমাধিগুলো নিয়ে প্রচলিত গল্প বিশ্বাস করেন।
তিনি লিখেছেন, কালো পাথরে তৈরি এই কবরগুলো সারিবদ্ধ। কোনো কোনোটির পাথর ভাঙা। মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়া নারীদের শেষ চিৎকারের প্রতিধ্বনি নিয়ে এখানকার নীরবতাও ভয়ংকর। আমি শিহরণ বোধ করছি।
তিনি আরও লিখেছেন, “আপাতদৃষ্টিতে আফজাল খান তার স্ত্রীদের পাশে সমাহিত হতে চেয়েছিলেন কিন্তু তিনি কখনোই যুদ্ধের ময়দান থেকে ফিরতে পারেননি।”
কাজিন্সের মতে, আফজাল খানের প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষের উত্তরে অবস্থিত। তার সমাধিটি খালিই রয়ে গেছে।
তিনি লিখেছেন, “আফজাল খানকে যেখানে হত্যা করা হয়েছিল তার কাছেই প্রতাবগড়ের ঢালে তাকে সমাহিত করা হয়। দাফনের জন্য তার লাশ আর সমাধিতে স্থানান্তর করা হয়নি।” সূত্র : বিবিসি বাংলা