সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে ঢুকে পড়েছেন বলে জানিয়েছেন দেশটির বিদ্রোহী যোদ্ধারা। শহরটির বিভিন্ন জায়গায় গোলাগুলির শব্দ পাওয়া গেছে। এরই মধ্যে তারা বেশ কিছু উপশহরের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে বলে জানা যাচ্ছে।
এদিকে বিমানে করে দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে দেশটির প্রেসিডেন্ট বাশার-আল আসাদ শহরটি ছেড়ে যান। তবে তার গন্তব্য জানা যায়নি।
এ বিষয়ে লন্ডনভিত্তিক পর্যবেক্ষক সংস্থা সিরিয়ান অবজারভেটরি ফর হিউম্যান রাইটস বলছে, দামেস্ক আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে একটি ব্যক্তিগত উড়োজাহাজ ছেড়ে গেছে। সেটায় বাশার আল-আসাদ থাকতে পারেন। ওই উড়োজাহাজটি উড্ডয়নের পর বিমানবন্দর থেকে সরকারি সেনাদের সরিয়ে নেওয়া হয়।
রোববার (৮ ডিসেম্বর) পৃথক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে সংবাদমাধ্যম বিবিসি, বার্তাসংস্থা এএফপি ও রয়টার্স।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিদ্রোহীরা সিরিয়ার মধ্য দিয়ে দ্রুতগতিতে অগ্রসর হচ্ছে এবং বলেছে, তারা শনিবার রাজধানী দামেস্কের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। যদিও বাশার আল-আসাদের সরকার শহরের চারপাশের এলাকা থেকে সেনাবাহিনী প্রত্যাহারের কথা অস্বীকার করেছে। অন্যদিকে বিদ্রোহীরা দাবি করেছে, তারা রাজধানী শহরটি ঘিরে ফেলেছে।
বিদ্রোহী কমান্ডার হাসান আবদেল গনির উদ্ধৃতি দিয়ে বার্তাসংস্থা এএফপি জানিয়েছে, “আমাদের বাহিনী রাজধানী ঘেরাও করার চূড়ান্ত পর্যায় শুরু করেছে।”
ইসলামপন্থি গোষ্ঠী হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস) চলমান এই হামলার নেতৃত্ব দিচ্ছে। এইচটিএস এর নেতা তার যোদ্ধাদেরকে আসাদ সরকারের জায়গা গ্রহণের জন্য তাদেরকে প্রস্তুত হতে বলেছেন। গোষ্ঠীটির নেতা আহমেদ আল-শারা টেলিগ্রামে দেওয়া এক বিবৃতিতে বলেছেন, “দামেস্ক আপনাদের জন্য অপেক্ষা করছে।”
যোদ্ধাদের প্রতি ওই বার্তায় সাধারণ মানুষের প্রতি ভালো আচরণ করার আহ্বান জানিয়েছেন এইচটিএস প্রধান। তিনি বলেছেন, ‘আমার ভাইয়েরা, আপনাদের প্রতি আমি আবারও আহ্বান জানাচ্ছি, আপনারা যেসব শহর ও গ্রামে প্রবেশ করবেন, সেখানকার মানুষের সঙ্গে দয়ালু ও নম্র আচরণ করবেন।’ তিনি অস্ত্র সমর্পণ করার পর সরকারি বাহিনীকে সাধারণ ক্ষমা করার প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছেন।
এদিকে ইরাকের সীমান্তবর্তী সিরিয়ার আল-কায়িম শহরের মেয়র বলেছেন, প্রায় দুই হাজার সিরিয়ান সেনা সীমান্ত পার হয়ে ইরাকে আশ্রয় নিয়েছেন।
তবে সিরিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বলেছে, সরকারি সেনাবাহিনী “দামেস্কের গ্রামাঞ্চলের সব এলাকায় উপস্থিত” রয়েছে। তারা বলেছে, “দামেস্কের কাছাকাছি অবস্থান থেকে আমাদের সশস্ত্র বাহিনী... প্রত্যাহার করা হয়েছে” এমন খবরের কোনও সত্যতা নেই।”
অন্যদিকে সিরিয়ার প্রেসিডেন্টের অফিস থেকেও আসাদ দামেস্ক ছেড়ে চলে গেছে এমন খবর অস্বীকার করা হয়েছে। প্রেসিডেন্সি বলেছে, তিনি “রাজধানীতে অবস্থান করেই তার কাজ এবং জাতীয় ও সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করছেন”।
একজন মার্কিন কর্মকর্তা যুক্তরাষ্ট্রের সিবিএস নিউজকে জানিয়েছেন, সিরিয়ার রাজধানী “ক্রমশ বিদ্রোহীদের হাতে পড়ছে”। বিদ্রোহীরা কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ হোমস শহরে প্রবেশ করেছে বলেও জানা গেছে। এ শহরটি দামেস্ককে উত্তর ও উপকূলের সাথে সংযুক্ত করেছে এবং প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের আলাওয়ী সম্প্রদায়ের মূল কেন্দ্র।
এরপরই প্রেসিডেন্ট আসাদ রাজধানী থেকে পালিয়ে গেছেন বলে প্রচারিত খবর অস্বীকার করে দেশটির সরকার। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোহামেদ আল-রহমুন রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে বলেছেন, দামেস্কের চারপাশে একটি “অত্যন্ত শক্তিশালী সামরিক বেষ্টনী তৈরি করা হয়েছে এবং এই প্রতিরক্ষা রেখা কেউ ভেদ করতে পারবে না”।
অন্যদিকে, বিরোধীপক্ষকে সমর্থনকারী সিরিয়ান ইমার্জেন্সি টাস্ক ফোর্স (এসইটিএফ) দাবি করেছে, দামেস্কের “শিগগিরই পতন হবে” এবং শহরটি কার্যত বেষ্টিত। তারা আরও দাবি করেছে, ইরানি বাহিনী এবং রাশিয়ান নৌযান সিরিয়া থেকে প্রত্যাহার করে নেওয়া হচ্ছে। এই সম্ভাব্য প্রত্যাহার দীর্ঘস্থায়ী সংঘাতে একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড় নিয়ে আসতে পারে।
তবে এসটিএফের দাবি স্বাধীনভাবে যাচাই করা সম্ভব হয়নি। রাশিয়া এবং ইরান বাশার আল আসাদ সরকারকে সামরিক সহায়তা দিয়ে আসছিল। মানবিক পরিস্থিতির দ্রুত অবনতির কারণে জাতিসংঘ সিরিয়া থেকে “অপরিহার্য নয়” এমন কর্মীদের প্রত্যাহার করছে।
এরই মধ্যে দেশটিতে ৩ লাখ ৭০ হাজারের বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন, অনেকে সীমান্ত এলাকায় আটকা পড়েছেন অথবা উত্তর-পূর্বে আশ্রয় নেওয়ার চেষ্টা করছেন। এই পরিস্থিতিতে আরও রক্তপাত এড়াতে এবং বেসামরিক নাগরিকদের রক্ষা করার জন্য নিয়মতান্ত্রিকভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর এবং উত্তেজনা প্রশমনের আহ্বান জানিয়েছেন জাতিসংঘের সিরিয়া বিষয়ক বিশেষ দূত গায়ের পেডারসেন।
প্রসঙ্গত, বাশার আল-আসাদ ২০০০ সাল থেকে সিরিয়ার ক্ষমতায় রয়েছেন। এর আগে তার বাবা হাফেজ আল-আসাদ ২৯ বছর দেশটি শাসন করেছিলেন।
তবে ২০১১ সালে প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের বিরুদ্ধে ব্যাপক বিক্ষোভ শুরু হয়। ওই সময় বিক্ষোভকারীদের দমনে কঠোর পন্থা অবলম্বন করেন তিনি। এরপর বিক্ষোভকারীরা সশস্ত্র বিদ্রোহ শুরু করেন। এতে করে দেশটিতে শুরু হয় গৃহযুদ্ধ।
যদিও ২০১৫ সালে বাশার আল আসাদকে বাঁচাতে এগিয়ে আসে রাশিয়া। সে বছর সিরিয়ার বিভিন্ন অঞ্চল লক্ষ্য করে ব্যাপক বিমান হামলা চালায় তারা। এরপর বিদ্রোহীরা পিছু হটতে বাধ্য হয়।
কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে লেবাননের শিয়া সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহ দুর্বল হয়ে যাওয়ায় এবং ইউক্রেন নিয়ে রাশিয়ার ব্যস্ত থাকার সুযোগে বিদ্রোহীরা আবারও তৎপর হয়ে উঠে। সম্প্রতি তারা ২০১৬ সালের পর প্রথমবারের মতো আলেপ্পোতে প্রবেশ করেন।
এরপর সিরিয়ার বিদ্রোহীরা দ্রুতগতিতে দামেস্কের দিকে অগ্রসর হচ্ছে এবং ইসলামপন্থি দল হায়াত তাহরির আল-শামের (এইচটিএস) নেতৃত্বে বিদ্রোহীরা এক সপ্তাহের মধ্যে চতুর্থ শহর হিসেবে শনিবার দারা’র নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়।
এর আগে আলেপ্পো, হামা ও হোমস শহরও দখল করে তারা।