আমেরিকার পেটের ভেতরে অর্থাৎ ভূপৃষ্ঠের গভীরে এক ভয়ঙ্কর ‘দৈত্য’ ঘুমিয়ে আছে। সে জেগে উঠলে কয়েক মুহূর্তেই ছারখার হয়ে যাবে গগনবিদারী চোখ ঝলসানো ভবনে ভরা অত্যাধুনিক যুক্তরাষ্ট্র। মুহূর্তেই জনশূন্য হয়ে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হতে পারে গোটা আমেরিকা মহাদেশ। যে ধ্বংসলীলা ছড়িয়ে পড়বে গোটা পৃথিবীতেই।
না, এটা গালগল্প কিংবা রূপকথা, জনশ্রুতি নয়, এমন ভয়াবহ বার্তা দিচ্ছেন খোদ বিজ্ঞানীরাই। তারা বলছেন, যুগ বা শতাব্দি নয়, কয়েক কোটি বছর আগে সেই ‘দৈত্য’ জেগে উঠেছিল। তারপর যে প্রলয়কাণ্ড ঘটেছিল, তার ইতিহাস সঠিকভাবে জানা যায়নি। কোনো লেখাও পাওয়া যায়নি। শুধু সেই সময়ের ভয়াবহতা অনুমান করছেন বিজ্ঞানীরা।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, দেশ বলি আর গোটা মহাদেশই বলা হোক না কেন, আমেরিকা যে দাঁড়িয়ে আছে কোটি কোটি পারমাণবিক বোমার মহাপর্বতমালার চূড়ার ওপরে। যা যেকোনো মুহূর্তে বিস্ফোরিত হয়ে গোটা মহাদেশই শুধু নয়, গোটা পৃথিবীবেই ধ্বংস করে দিতে পারে। নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারে মানবজাতি, প্রাণী ও উদ্ভিদকূল। গোটা পৃথিবী ঢেকে যেতে পারে ভূগর্ভস্থ উত্তপ্ত গলিত বস্তুতে।
প্রশ্ন হচ্ছে, এত আশঙ্কা থাকার পরেও কেন বছরের পর বছর ঘুমন্ত সেই ‘দৈত্যের’ ঘুম ভাঙছে না? কী কারণে সে ঘুমিয়ে আর কখন-ই বা জেগে উঠতে পারে? এসব প্রশ্নের উত্তর জানতে গিয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভূগর্ভে যেখানে ‘দৈত্য’টি ঘুমিয়ে রয়েছে তা একাধিক প্লেটের সংযোগস্থল নয়। ফলে ভূমিকম্প না হওয়ায় জেগে ওঠতে পারে না ‘দৈত্য’টি।
শুধু তা-ই নয়, ইয়েলোস্টোন জাতীয় উদ্যান এলাকায় ভূমিকম্প এতটাই মৃদু যে মালুম পাওয়া যায় না। বিজ্ঞানীরা দাবি করছেন, উদ্যানের নিচে যে লাভার প্রকোষ্ঠ, তাপজনিত কারণে বার বারই কেঁপে ওঠে সেখানকার মাটি। তবে সেটা ‘দৈত্য’কে জাগিয়ে দেওয়ার জন্য কতটা সহায়তা তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।
ভূবিজ্ঞানীরা বলছেন, গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো হলুদ পাথরের ইয়েলোস্টোন উদ্যানটি মূলত অতিমাত্রায় ভূমিকম্পপ্রবণ। হিসাব কষে দেখা যায়, উদ্যান এলাকায় দিনে গড়ে অন্তত পাঁচ বার ভূকম্পন অনুভূত হয়। বিপদের জায়গাটা হলো, ঘুমন্ত ‘দৈত্যকে’ জাগিয়ে তুলতে অনেক সময় অনুঘটকের কাজ করে থাকে এমন ভূমিকম্প।
আর বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, ইয়েলোস্টোনের নিচে আশ্চর্য রকম এক প্রাকৃতিক খেলা চলছে। মৃদু ভূমিকম্প না থাকলে গরম লাভার তাপজনিত চাপ বাড়তে বাড়তে এক সময় এমন অবস্থায় পৌঁছাবে যে, দৈত্যকে জাগিয়ে তুলবে। কিংবা হঠাৎ প্রবলমাত্রার ভূমিকম্প হলেও জেগে যাবে দৈত্যটি। আর তাতে আমেরিকাসহ গোটা পৃথিবীতে প্রলয় ডেকে আনবে।
গবেষকদের দাবি, বর্তমান সময়ে হঠাৎ যদি ইয়েলোস্টোনের নিচের ‘দৈত্য’ জেগে যায় তাহলে সেই ধ্বংসলীলা হবে অকল্পনীয়। কারণ, এর লাভা উদ্গীরণের পরিমাণ হাজার গুণ বেশি হবে। যা গোটা আমেরিকা মহাদেশকে অনায়াসে ধূলোর চাদরে ঢেকে দিতে পারে। যার প্রভাব পড়বে গোটা পৃথিবীতে।
বিজ্ঞানীদের অনুমান, ইয়েলোস্টোনের ‘ঘুমন্ত দৈত্য’ জেগে উঠলে এর লাভা এবং আগুনের গোলা প্রায় দুই হাজার মাইল পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়তে পারে। হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকাও আসবে সেই ধ্বংসলীলার আওতায়। তাছাড়া সেখান থেকে বেরিয়ে আসা ধোঁয়ার মেঘের আড়ালে ঢাকা পড়তে পারে সূর্য। সেক্ষেত্রে ভূপৃষ্ঠে সূর্যালোক পৌঁছাতে পারবে না। ফলে তাপমাত্রা হু-হু করে নামতে শুরু করবে।
আর তাপমাত্রা হু হু নেমে যাওয়ার কারণে পৃথিবীতে ফিরতে পারে তুষার যুগ। আলোর অভাবে উদ্ভিদ জগতের অপমৃত্যুর আশঙ্কা রয়েছে। বিশ্বজুড়ে দেখা দেবে প্রবল খাদ্যসঙ্কট। পরিস্থিতি দাঁড়াবে কোটি কোটি বছর আগের সেই অতিকায় ডাইনোসর বিলুপ্তির যুগের মতো। এমনটাই আশঙ্কা করছেন জীববিজ্ঞানীদের একাংশ।
ভূবিজ্ঞানীর বলছেন, ইয়েলোস্টোনের নিচের ‘ঘুমন্ত দৈত্য’ যে জেগে ওঠেনি, তা কিন্তু নয়। বেশ কয়েক বারই ‘দৈত্যটি’র ঘুম ভেঙেছে। সেখানে থেকে বেরিয়ে আসা লাভা, ছাই ও গ্যাসের মাত্রা একটাই বেশি ছিল যে, তা ১০টা এভারেস্টকে ছাপিয়ে যাওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। তবে ‘দৈত্যটি’ সর্বশেষ কয়েক কোটি বছর আগে জেগে উঠে পৃথিবীর চেহারা বদলে দিয়েছিল বলে মনে করেন বিশ্বের তাবড় সব ভূবিজ্ঞানী।
১৯৭৮ সালে আমেরিকার ইয়েলোস্টোন জাতীয় উদ্যানকে ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে ইউনেস্কো। ৮ হাজার ৯৮৩ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের উদ্যানে রয়েছে একাধিক উষ্ণ প্রস্রবণ। যার জল লাভা প্রকোষ্ঠের ওপর দিয়ে বেরিয়ে ভূপৃষ্ঠে দিব্যি বয়ে চলেছে। প্রস্রবণগুলির তাপমাত্রা ৯৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। কোনো কোনো জায়গায় আরও বেশি। সবচেয়ে আতঙ্কের বিষয় হচ্ছে, প্রস্রবণের জলে মিশে আছে অ্যাসিড। যা এতটাই তীব্র যে, কোনো ক্ষেত্রে লোহাকেও গলিয়ে দিতে পারে।
বিজ্ঞানীদের মতে, উদ্যানের নিচের প্রকোষ্ঠে গলিত লাভা থাকায় সেখান থেকে ক্রমাগত সালফার গ্যাস নিঃসরণ হচ্ছে। যা জলের সংস্পর্শে এসে বিক্রিয়া করে সালফিউরিক অ্যাসিড তৈরি করছে। ফলে এখানকার কোনো উষ্ণ প্রস্রবণে কেউ স্নান করতে পারেন না। পাশাপাশি একাধিক উষ্ণ জলের ফোয়ারা রয়েছে। যা মাঝেমধ্যেই মাটি ফেটে বেরিয়ে আসছে। এগুলির তাপমাত্রা উষ্ণ প্রস্রবণের চেয়েও বেশি। কিছু কিছু উষ্ণ জলের ফোয়ারার তাপমাত্রা ১৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
ইয়েলোস্টোন জাতীয় উদ্যানটির মধ্যে থাকা উষ্ণ জলের ফোয়ারাগুলির মধ্যে ‘ওল্ড ফেথফুল’ সবচেয়ে জনপ্রিয়। প্রতি ৬০ থেকে ৬৪ মিনিট পর পর মাটি ফুঁড়ে এর জল ফোয়ারার মতো করে লাফিয়ে উঠে উদ্যানের মাটি ভিজিয়ে দেয়। তবে সম্প্রতি সেই সময়সীমা কিছুটা বেড়ে ৯৪ মিনিট হয়েছে।
ইয়োলোস্টোনের আরেকটি আকর্ষণীয় বিষয় হলো বিচিত্র রঙিন ভূমি। যা নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা সেখানে ২৪০ কোটি বছরের পুরনো থার্মোফিলিক এবং অ্যাসিডোফিলিক প্রাণের সন্ধান পেয়েছেন। যা ওই তাপ এবং অ্যাসিড-সমৃদ্ধ পরিবেশে দিব্যি বেঁচে রয়েছে। পাশাপাশি, সেখানকার রঙিন ভূমি ও অনির্বচনীয় প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের নেপথ্যেও সেগুলির ভূমিকা রয়েছে বলে জানিয়েছেন তারা। প্রতি বছর ৪০ লাখ পর্যটক আসেন আসেন উদ্যানে। যা দেশটির অন্যান্য পর্যটনস্থলের চেয়ে অনেক বেশি।
আমেরিকার গবেষকদের দাবি, ৭ কোটি ৬০ হাজার বছর আগে শেষ বার ইয়োলোস্টোনের উদ্যানের নিচে ঘুমিয়ে থাকা ভয়ঙ্কর আগ্নেয়গিরি জেগে উঠেছিল। বর্তমানে এটা ফেটে লাভা বেরিয়ে এলে গোটা মহাদেশের সব কিছু নিশ্চিহ্ন হতে পারে। ২০১৫ সালে ভূবিজ্ঞানীরা উদ্যানটির নিচে বিশাল আকারের লাভা ভর্তি প্রকোষ্ঠের সন্ধান পান। যা দেখে চোখ কপালে উঠেছিল তাদের। ওই লাভা বেরিয়ে এলে বিশ্ব মানচিত্র থেকে আমেরিকা মুছে যেতে পারে বলে ভবিষ্যদ্বাণী করেন তারা। ফলে এই নিয়ে বাড়তে শুরু করে উদ্বেগ।
পৃথিবীর বিপজ্জনক আগ্নেয়গিরিগুলির তালিকার ২১তম স্থানে জ্বলজ্বল করছে ইয়েলোস্টোনের নাম। উদ্যানটির নিচে বিশাল লাভার প্রকোষ্ঠ আবিষ্কারের পর থেকেই বিষয়টি নিয়ে গবেষণায় মেতে ওঠেন ভূবিজ্ঞানীরা। তাদের একাংশের দাবি, এলাকাটির নিচে থাকা লাভার মাত্র পাঁচ থেকে ১৫ শতাংশই গলিত অবস্থায় রয়েছে। বাকিটা জমে পাথর হয়ে গিয়েছে। ফলত, এর থেকে বিপদের আশঙ্কা খুবই কম।
সাম্প্রতিক গবেষণায় আর পাঁচটি আগ্নেয়গিরির তুলনায় একে সামান্য বড় বলেছেন ভূবিজ্ঞানীরা। তাদের কথায়, “আগ্নেয়গিরিটির সমস্ত লাভা গলিত অবস্থায় থাকলে এবং এর অবস্থান দুটি প্লেটের সংযোগস্থলে হলে এর জেগে ওঠার সম্ভাবনা থাকত ১০০ শতাংশ। তখন প্রলয়ের মুখে পড়তে হতো বিশ্বকে।”