চীনের বেইজিংয়ে অনুষ্ঠিত বেল্ট অ্যান্ড রোড ফোরামের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে শি জিনপিং এর ফ্ল্যাগশিপ পররাষ্ট্র নীতির উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন পুতিন। ‘একটি ন্যায্য, বহু-মেরুর বিশ্ব গঠনের লক্ষ্য’ই জিনপিং এর ফ্ল্যাগশিপ পররাষ্ট্রনীতির মূল উদ্দেশ্য। এসময় চীনের সঙ্গে তার দেশের গভীর সম্পর্কের কথাও বলেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন।
চীনের বেইজিং-এ অনুষ্ঠিত বিশ্ব নেতাদের নিয়ে অনুষ্ঠিত ওই সমাবেশে পুতিন সম্মানিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানে চীনের নেতা শি জিনপিং একটি নতুন বিশ্ব ব্যবস্থা পুনর্নির্মাণ করতে তার দৃষ্টিভঙ্গি ও পরিকল্পনা তুলে ধরেন।
অনুষ্ঠানে রাশিয়া এবং চীন সমতার ভিত্তিতে তাদের পারস্পরিক সহযোগিতার আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করে। যাতে দুটি দেশই পারস্পরিকভাবে উপকারভোগী হতে পারে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে- বৈচিত্রপূর্ণ সভ্যতা সংরক্ষণ ও সম্মান করা, তাদের নিজস্ব উন্নয়ন মডেলে প্রতিটি রাষ্ট্রকে অধিকার দেওয়া, এবং মানব উন্নয়নের জন্য কর্তৃত্ববাদী নেতাদের আহ্বানের বিরুদ্ধে তাদের রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও নিজেদের অধিকারের জন্য সোচ্চার হওয়া।
বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের দশ তম বার্ষিকী উপলক্ষে এই অনুষ্ঠানে দুই ডজন বিশ্বনেতা এবং শতাধিক প্রতিনিধি সমবেত হন। চীনের অবকাঠামোগত এই প্রকল্পগুলির উদ্দেশ্য হলো বিশ্বজুড়ে সংযোগ এবং বাণিজ্য বৃদ্ধি। তবে উচ্চাভিলাষী এসব প্রকল্প নিয়ে বিতর্কও রয়েছে।
বেইজিং-এর গ্রেট হল অফ দ্য পিপলের একটি বর্ণিল কক্ষে বিদেশী অতিথিদের অভ্যর্থনা জানান শি জিনপিং। অনুষ্ঠানে অন্যান্য নেতৃবৃন্দরা বিশ্বের জন্য একটি বিকল্প উন্নয়ন মডেল প্রদানের জন্য শি জিনপিংয়ের প্রশংসা করেন। বলা হয় ‘এটি আন্তর্জাতিক সহযোগিতার জন্য একটি নতুন কাঠামো প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
সমাবেশে বলা হয় মধ্যপ্রাচ্যে একটি ছায়াযুদ্ধ চলছিল, এবং এটি বড় আকারের আঞ্চলিক সংঘাতে রূপ নেওয়ার হুমকিও রয়েছে। এই ছায়াযুদ্ধ বিশ্বশক্তির মধ্যে গভীর বিভোজন তৈরির জন্য স্পষ্টভাবে কাজ করছে।
বিশ্বের দক্ষিণাঞ্চলের দেশগুলির নেতারা চীনের রাজধানীতে সমবেত হওয়ার কারণে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন তার অন্যতম ঘনিষ্ঠ মিত্র ইসরায়েলকে দৃঢ় সমর্থন দিতে বুধবার ইসরায়েলে গেছেন বলেও বলা হয় ওই অনুষ্ঠানে। তিনি ইসরায়েলে হামলার জন্য হামাসকে নির্মূল করার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন।
এদিকে চীন এবং রাশিয়া ইসরায়েল-হামাসের ভয়ংকর সংঘাতে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের নেতাদের মতো ইসরায়েলের পক্ষ সমর্থন করেনি চীন-রাশিয়া এবং হামাসকে নিন্দাও জানায়নি তারা। এছাড়া পশ্চিমা দেশগুলির সঙ্গে বিভাজন তীক্ষ্ণ হওয়ায় চীন ও রাশিয়া ইসরায়েলের সমালোচনা করেছে।
বেইজিংয়ে বেল্ট অ্যান্ড রোড ফোরামে জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস অবিলম্বে মানবিক যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, “আমি ৬৫ বছরের দখলদারিত্বে ফিলিস্তিনি জনগণের গভীর ক্ষোভ সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন। ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে বেসামরিকদের বিরুদ্ধে হামাসের সন্ত্রাসী হামলা কখনোই ন্যয্যতা দিতে পারে না। আমি সে ঘটনায় তীব্র নিন্দা জানিয়েছিলাম। হামাসের হামলার জন্য সব ফিলিস্তিনিকে সম্মিলিত শাস্তির ন্যয্যতাও দেওয়া যায় না।”
শি জিনপিং তার বক্তব্যে সংঘাতের কথা বলেননি, তবে বৈশ্বিক ক্ষমতা ও নেতৃত্ব পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিয়েছেন। তিনি বলেন, “বিশ্বের পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা এমনভাবে প্রকাশ পাচ্ছে যা আগে কখনো হয়নি।”
শি বলেন, “চীন নিজেকে একটি শক্তিশালী দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে এবং চীনা জাতিকে আধুনিকীকরণের মাধ্যমে সকল ক্ষেত্রে পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা করছে। আমরা যে আধুনিকীকরণের চেষ্টা করছি তা শুধু চীনের জন্য নয়। এটি যৌথ প্রচেষ্টার মাধ্যমে সব উন্নয়নশীল দেশের জন্য।”
চীনা নেতা বলেছিলেন যে চীন একতরফা নিষেধাজ্ঞা, অর্থনৈতিক জবরদস্তি, এবং সরবরাহ ব্যবস্থায় বাধার বিরোধিতা করে। শি জিনপিং আরও বলেন, “মতাদর্শগত দ্বন্দ্ব, ভূ-রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং ব্লকের রাজনীতি আমাদের জন্য পছন্দ নয়। অন্যের উন্নয়নকে হুমকি হিসাবে দেখা, বা পরস্পরিক অর্থনৈতিক নির্ভরতাকে ঝুঁকি হিসাবে গ্রহণ করা কারো জীবনকে উন্নত করবে না এবং তার বিকাশকেও ত্বরান্বিত করবে না।”
অনুষ্ঠানে কাজাখের রাষ্ট্রপতি কাসিম-জোমার্ট টোকায়েভ এবং ইন্দোনেশিয়ার জোকো উইদোদো সহ উপস্থিত অন্যান্য বিশ্ব নেতারাও ভাষণ দেন। তারা বিশ্বব্যাপী বহুমাত্রিক উন্নয়ন ও বহুপাক্ষিক, সহযোগিতামূলক বিশ্বের জন্য শি জিনপিংয়ের আহ্বানে সাড়া দিয়ে সমস্বরে বক্তব্য রাখেন।
চীনের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন সিসিটিভি জানিয়েছে, অনুষ্ঠানের পরও শি-পুতিন আলোচনা করেন। পুতিনকে ‘আমার পুরানো বন্ধু’ বলে অভিহিত করে শি জিনপিং। দুই দেশের মধ্যে রাজনৈতিক আস্থার গভীরতা এবং কার্যকর কৌশলগত সমন্বয়ের ঘনিষ্ঠতার বিষয়ে একে অপরকে স্বাগত জানান।
একটি বিকল্প বিশ্ব ব্যবস্থা
বিশ্বব্যাপী কীভাবে নিরাপত্তা ও উন্নয়ন নিশ্চিত করা যায়- সেরকম একটি দূরদর্শি দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে দৃঢ়চেতা চীনা নেতা শি জিনপিং মার্কিন যুক্তরাষ্টের বিকল্প হিসেবে নিজেকে তুলে ধরতে তার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন।
কোভিড-১৯ মহামারী শেষ হওয়ার পর চীনে এটিই প্রথম বড় আন্তর্জাতিক ইভেন্ট। বেইজিং-এ অনুষ্ঠিত সমাবেশে উপস্থিত দেশগুলির প্রতিনিধিদের কাছে শি জিনপিংয়ের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরাই মূল প্রচেষ্টা ছিল। গত এক দশক ধরে শির উদ্দেশ্য ব্যাপকভাবে প্রসার করার লক্ষ্যে তিনি চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। এবং দেশগুলির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কও তৈরি করেছে।
মধ্যপ্রাচ্য এবং তালেবান সহ ১৪০ টিরও বেশি দেশের বিশ্ব নেতা, এবং প্রতিনিধিরা শি জিনপিং-এর ফ্ল্যাগশিপ বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের দশক পূর্তি উপলক্ষে এই সমাবেশে যোগ দিচ্ছেন। তবে সমাবেশটির এই সময়েও চীন তার দেশের অর্থনীতি নিয়ে রয়েছে তীব্র চ্যালেঞ্জে। ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টির উচ্চ মহল থেকেও ধারাবাহিক চাপের মুখে রয়েছেন শি জিনপিং।
বেইজিংয়ের লক্ষ্য সমাবেশে এই চ্যালেঞ্জগুলিকে শক্তির উৎস হিসেবে নিয়ে এবং বিশ্বব্যাপী উন্নয়নে তার অবদানকে উচ্চতর নেতৃত্বের উদাহরণ হিসাবে প্রশংসা করা।
তাদের বৈদেশিক নীতি বিশ্বজুড়ে বন্দর, পাওয়ার স্টেশন, সেতু, রেল এবং রাস্তা নির্মাণের জন্য চীনা অর্থায়নে শত শত বিলিয়ন ব্যয় করা হয়েছে – যা চীনের আন্তর্জাতিক স্বার্থ এবং প্রভাবকে উল্লেখযোগ্যভাবে প্রসারিত করেছে।
১৫০টিরও বেশি দেশ এই কর্মসূচিতে সহযোগিতা করেছে। বেইজিং বলেছে যে “বিনিয়োগে এক ট্রিলিয়ন ডলার পর্যন্ত” সঞ্চালিত হয়েছে। যা উন্নয়নশীল দেশগুলিকে উৎসাহিত করেছে ৷
বিশ্লেষকরা বলছেন, চীনের অবকাঠামো নির্মাণের স্রোত এখন এটিকে বিশ্বের বৃহত্তম ঋণ সংগ্রহকারীতে পরিণত করেছে।
শি জিনপিং বুধবারের ভাষণে সমালোচনাকে দূরে সরিয়ে দিয়ে উদ্যোগের প্রতি তার প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, “গত ১০ বছরে যা অর্জন করা হয়েছে তা প্রমাণ করে যে বেল্ট অ্যান্ড রোড সহযোগিতা ইতিহাসের ডানদিকে রয়েছে। এটি আমাদের সময়ের অগ্রগতির প্রতিনিধিত্ব করে এবং এটি এগিয়ে যাওয়ার সঠিক পথ।
সিএনএন’র প্রতিবেদক সিমোন ম্যাকার্থি এবং নেক্টার গ্যান এর প্রতিবেদন অবলম্বনে