সরকারের নানা ধরনের গুরুত্বপূর্ণ কাজের মধ্যে সবচেয়ে কম গুরুত্বের কাজ হচ্ছে কোনো কিছুর নাম রাখা। তারপরও স্কুল, রাস্তা, সেতু, শহর ইত্যাদির নাম রাখতে হয়। আবার কখনো কখনো পুরোনো নামগুলো আপত্তিকর হয়ে উঠতে পারে, তখন সেই নামগুলো পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়।
১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হয়েছে। এরপর নতুন দেশ গড়তে গিয়ে ভারতীয় নেতারা পুরোনো ঔপনিবেশিক শাসকদের দেওয়া বহু প্রতিষ্ঠানের নাম পরিবর্তন করেন। তাদের এ দৃষ্টিভঙ্গি নিঃসন্দেহে সৃজনশীল ও উদার। যেমন : প্রযুক্তিবিষয়ক নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর নাম দেওয়া হয় ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি। আবার উত্তরের একটি বড় রাজ্যের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘উত্তর প্রদেশ’।
প্রথমদিকে এসব নাম পরিবর্তনের বেশির ভাগ কাজই করেছে কংগ্রেস পার্টি। দলটি গত ৭৭ বছরের মধ্যে ৫৪ বছরই ভারতে সরকার পরিচালনা করেছে। এর মধ্যে আবার ৩৮ বছরই ছিল নেহরু বা গান্ধীর শাসনের অধীনে। এত দীর্ঘ সময় কোনো দল রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকলে তাদের প্রভাব রাষ্ট্রের সর্বত্র পরিলক্ষিত হতে বাধ্য। এ কারণে দিল্লি বিমানবন্দরের নাম হয়ে গেছে ইন্দিরা গান্ধী বিমানবন্দর। হায়দরাবাদের নামকরণ করা হয়েছে রাজীব গান্ধীর নামে। মুম্বাইয়ের জাতীয় উদ্যানের নামকরণ করা হয়েছে সঞ্জয় গান্ধীর নামে।
২০১৪ সালে ভারতের ক্ষমতায় আসে নরেন্দ্র মোদির দল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)। এরপর ঐতিহ্যবাহী ওষুধ বিভাগের নাম হয়ে যায় ‘আইয়ুষ’। এটি একটি সংস্কৃত শব্দ, যার অর্থ ‘সুস্থতা’। কিন্তু ইংরেজি AYUSH হচ্ছে আয়ুর্বেদ, ইয়োগা, ইউনানি, সিদ্ধ ও হোমিওপ্যাথির সংক্ষিপ্ত রূপ।
আবার অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটের দেওয়া হয় ‘উড়ান’। হিন্দিতে এর অর্থ ‘উড্ডয়ন’। একইভাবে ‘মহাঋষি’ নামটি দেওয়া হয়েছে ‘মিলেটস অ্যান্ড আদার্স অ্যনসিয়েন্ট গ্রেইন্স ইন্টারন্যাশনাল রিসার্চ ইনিশিয়েটিভ’–এর সংক্ষিপ্ত রূপ হিসেবে।
বিজেপিশাসিত রাজ্যগুলোতেও পারস্য নামগুলোর হিন্দুকরণ করা হয়েছে। এটি একটি উপনিবেশবিরোধী পদক্ষেপ। যেমন: ব্রিটিশ আমলের ক্যালকাটা (Calcutta) শহরের নাম পরিবর্তন করে করা হয়েছে কলকাতা (Kolkata)। উত্তর প্রদেশের মুঘলসরাই শহরের নাম দেওয়া হয়েছে পণ্ডিত দ্বীনদয়াল উপাধ্যায় নগর। মহারাষ্ট্র, যার অর্থ বড় রাজ্য, সেটির নাম রাখা হয় ‘ঔরঙ্গাবাদ’। পরে সেটিও পরিবর্তন করে রাখা হয়েছে ‘ছত্রপতি শিবাজিনগর’। এ ছাড়া উত্তর ভারতের নেতারা সেখানকার রেলস্টেশনসহ যত প্রতিষ্ঠানে মুসলিম নাম রয়েছে, সব পরিবর্তন করার হুমকি দিয়েছেন।
নাম পরিবর্তনের এই প্রতিযোগিতায় কংগ্রেসের চেয়ে বিজেপি কয়েক কাঠি সরেস। হিন্দুস্তান টাইমস বলছে, কখনো লক্ষ্ণৌ শহরে গেলে অটল বিহারী বাজপেয়ী সড়ক পার হয়ে অটল চৌরাহা দিয়ে অটল বিহারী বাজপেয়ী সম্মেলন কেন্দ্রে পৌঁছানো যায়! আবার অটল সেতু পার হয়ে অটল বিহারী কল্যাণ মন্ডপে পৌঁছানো যায়।
অটল বিহারী বাজপেয়ী হচ্ছেন বিজেপির একমাত্র সাবেক প্রধানমন্ত্রী। তবে আপাত স্বস্তির ব্যাপার হচ্ছে, নামকরণগুলো অন্তত বর্তমান প্রধানমন্ত্রী মোদির নামে হচ্ছে না (একমাত্র ব্যতিক্রম একটি স্টেডিয়াম ও একটি ট্রেন ছাড়া)।
এদিকে মহারাষ্ট্র একজন কিংবদন্তী যোদ্ধা রাজা শিবাজির নাম পরিবর্তন করে তাঁর ছেলেকে সম্মান জানাতে শুরু করেছে। ছেলের নাম ছত্রপতি শিবাজি মহারাজ। তাঁর নামে মুম্বাইয়ের একটি প্রধান সড়কের নাম দেওয়া হয়েছে ‘ছত্রপতি শিবাজি মহারাজ কোস্টাল রোড’। এত বড় নাম কে আর মনে রাখে! মুখে বলা তো দূরের কথা।
নাম দেওয়া ও নাম বদলে ফেলা, দুটোই সরকার ও ইতিহাসের অংশ। কিন্তু নাম বদলের এই রাজনীতি করতে গিয়ে সরকার অনেক সময়ই অসতর্কতার পরিচয় দেয় এবং ইতিহাসের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকরা করে থাকে। সাধারণ মানুষ এসব নাম বদলের তাগিদ অনুভব করে কি না, কিংবা নাম বদল করলে ভোটের মাঠে জেতার সম্ভাবনা বাড়ে কি না, তা কিন্তু স্পষ্ট নয়। তারপরও রাজনৈতিক নেতারা ক্ষমতায় এলেই পুরোনো নাম বদলে ফেলেন। অথচ বেশির ভাগ মানুষকে পুরোনো নামগুলোই ব্যবহার করতে দেখা যায়।
কোনো কিছুর নাম পরিবর্তন করা মুখের কথা নয়। এর পেছনে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় আছে। এ ছাড়া তিনটি ঔপনিবেশিক আমলের আইনগুলো পরিবর্তনের ব্যাপার আছে। যদিও এরই মধ্যে ঔপনিবেশিক আমলের কিছু ফৌজদারি আইন সংস্কার ও পুনঃপ্রণয়ন করা হয়েছে। কিন্তু এতে দেশের সাধারণ মানুষের খুব একটা লাভ হয়নি। তাদের কাছে আইনের নতুন নামগুলো আগের মতোই দুর্বোধ্য রয়ে গেছে। আইনের নাম পরিবর্তনের ফলে কি বিচার ব্যবস্থায় গতি এসেছে? মোটেও না। বরং আরও ধীরগতির হয়েছে।
পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতে কোনো রাস্তার অফিশিয়াল নাম কল্পকাহিনীর নামান্তর। সেখানে মানুষেরা রাস্তা চেনে ল্যান্ডমার্ক দেখে। বরং নতুন নতুন নামকরণ নতুন নতুন বিভ্রান্তি নিয়ে আসে। এসব নাম মনে রাখতে গিয়ে মানুষের ঘণ্টার পর ঘণ্টা নষ্ট হয়।
সূত্র : দ্য ইকনোমিস্ট