গাজায় যুদ্ধ করতে গিয়ে মানসিকভাবে ভেঙে পড়ছেন বহু ইসরায়েলি সেনা। যুদ্ধের মাঠ থেকে ফিরে এসে চরম অবসাদে ভুগছেন তারা। আবারও গাজায় পাঠানোর আতঙ্কে অনেক সেনা আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছেন। এ নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে সিএনএন।
প্রতিবেদনে গাজা ফেরত সেনা চার সন্তানের বাবা এলিরান মিজরাহির মানসিকভাবে ভেঙে পড়া ও আত্মহত্যার পথ বেছে নেওয়ার তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। এলিরানের মা জেনি মিজরাহি বলেন, “সে গাজা ছেড়েছিল, তবে গাজা তাকে ছাড়েনি। সেই অবসাদেই আমার ছেলে মারা গেল।”
এলিরানকে গেল বছর ইসরায়েলে হামাসের হামলার পর গাজায় লড়াই করতে পাঠানো হয়েছিল। যুদ্ধ এখনো চলছে। এরই মাঝে গাজা থেকে ফিরিয়ে আনা হয় আহত এলিরানকে। তবে তত দিনে একজন ভিন্ন মানুষে পরিণত হয়েছিলেন এলিরান।
এলিরান ‘পোস্টট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার’ (পিটিএসডি) নামে মানসিক সমস্যায় ভুগছিলেন। এলিরানের মতোই গাজা থেকে ফেরার পর ইসরায়েলের হাজার হাজার সেনা পিটিএসডিসহ নানা মানসিক সমস্যায় ভুগছেন। তবে তাদের কতজন আত্মহত্যা করেছেন, তা সুনির্দিষ্টভাবে জানা যায়নি।
গাজা থেকে ফেরার পর একটুতেই রেগে যেতেন এলিরান। রাতের পর রাত ঘুম হতো না। ঘামতে থাকতেন। পরিবারকে বলতেন, গাজায় তিনি যে কী অবস্থার মধ্য দিয়ে গেছেন, তা কেবল সেখানে তার সঙ্গে থাকা ব্যক্তিরাই বুঝবেন। এলিরানের বোন শির বলেন, ‘সে সব সময় বলত, “আমি যে কী দেখে এসেছি, তা কেউ বুঝবে না।”’
এলিরানের মা বলছিলেন, ‘সে অনেককে মারা যেতে দেখেছে। হয়তো কাউকে হত্যাও করেছে। তবে সন্তানদের এসব করার শিক্ষা আমরা দিই না। তাই যখন সে এমন কিছু করেছিল, তখন হয়তো বড় একটা ধাক্কা খেয়েছিল।’
গাজায় এলিরানের সহযোদ্ধা ছিলেন গুই জাকেন। দুই বন্ধু গাজায় বুলডোজার চালাতেন। জাকেন ফিরে এসে এখন আর মাংস খেতে পারেন না। খাওয়ার সময় গাজায় বুলডোজারের ভেতর থেকে দেখা নানা দৃশ্যের কথা তার মনে পড়ে। ঘুমাতে গেলে একপ্রকার সংগ্রাম করতে হয়। কারণ, তার কানে সব সময় বাজে বিস্ফোরণের শব্দ।
গাজায় যেসব মরদেহ দেখেছেন, সেগুলোকে এখন ‘মাংসের’ মতো মনে হয় গুই জাকেনের কাছে। তিনি বলেন, ‘আপনি যখন বুলডোজারের বাইরে তাদের (ফিলিস্তিনি) ও আমাদের (ইসরায়েলি সেনা) প্রচুর রক্ত ও মাংস পড়ে থাকতে দেখবেন, তখন তা সত্যিকার অর্থে আপনার খাবারের ওপর প্রভাব ফেলবে।’
শুধু এলিরান ও গুই জাকেনই নন, গাজা যুদ্ধ থেকে ফিরে আসা হাজার হাজার সেনা সদস্য মানসিক সমস্যায় ভুগছেন। আগস্টে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়, প্রতি মাসে এক হাজারের বেশি আহত সেনাসদস্যকে চিকিৎসার জন্য ফিরিয়ে আনা হচ্ছে। তাদের ৩৫ শতাংশ নিজেদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে অভিযোগ করেছেন।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, চলতি বছরের শেষ নাগাদ ১৪ হাজার ইসরায়েলি সেনাকে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে ভর্তি করা হবে। ধারণা করা হচ্ছে, তাদের মধ্যে প্রায় ৪০ শতাংশ মানসিক সমস্যার মুখোমুখি হবেন।
লেবানন যুদ্ধসহ ছয় বছর ধরে ইসরায়েলি বাহিনীর হয়ে কাজ করেছেন যুক্তরাজ্যের কিংস কলেজ লন্ডনের রাষ্ট্রবিজ্ঞানী আহরন বার্গম্যান। তার মতে, গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে সরাসরি যুদ্ধের মুখে পড়ছেন বুলডোজার চালকেরা। তারা মৃত মানুষ দেখছেন। ধ্বংসাবশেষের সঙ্গে মরদেহগুলোও তাদের বুলডোজার দিয়ে সরাতে হচ্ছে। অনেক সময় মরদেহগুলোর ওপর দিয়েই তাদের বুলডোজার চালিয়ে যেতে হচ্ছে।
যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ইসরায়েলে ফেরার পর অনেক সেনা সাধারণ জীবনযাপন করতে পারছে না বলে মনে করেন আহরন বার্গম্যান। কারণ, শহুরে এলাকায় এই যুদ্ধে বহু নারী ও শিশু নিহত হয়েছেন। তিনি বলেন, ‘গাজায় শিশুদের নিহত হতে দেখার পর কীভাবে আপনি আপনার সন্তানদের ঘুম পাড়াবেন?’
গাজায় যুদ্ধ করা ইসরায়েলি সেনারা জানিয়েছেন, উপত্যকাটিতে তারা যে ভয়াবহতা দেখেছেন, তা বাইরের মানুষ সত্যিকার অর্থে কল্পনাও করতে পারবেন না। এই বক্তব্য থেকে উপত্যকাটিতে চলমান নৃশংসতা সম্পর্কে একটা আঁচ পাওয়া যায়। সমালোচকদের ভাষায়- নেতানিয়াহু এই নৃশংসতার নাম দিয়েছেন ‘চিরকালের যুদ্ধ’।
গাজায় চার মাস ছিলেন ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনীর (আইডিএফ) একজন চিকিৎসক। পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, গাজার পর এখন অনেক সেনাকে লেবাননে পাঠানো হতে পারে- এই ভয় পাচ্ছেন তারা। ইসরায়েলি বাহিনীর বহু সেনাসদস্য এখন প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর সরকারকে বিশ্বাস করেন না।
গাজা যুদ্ধের সময় যত গড়াচ্ছে, লাশের মিছিল ততই দীর্ঘ হচ্ছে। গেল বছরের ৭ অক্টোবরে ইসরায়েলে হামাসের হামলায় প্রাণ হারান ১ হাজার ২০০ জন। এরপর থেকে ইসরায়েলের নৃশংস হামলায় তছনছ হয়েছে পুরো গাজা। সেখানে এখন পর্যন্ত নারী ও শিশুসহ ৪২ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। এরই মধ্যে আবার লেবাননে হামলা শুরু করেছে ইসরায়েল।
ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধে চরম মানসিক সংকটে ভুগছেন গাজার বাসিন্দারাও। প্রায় দেড় যুগ ধরে অবরুদ্ধ থাকা ও ইসরায়েলের সঙ্গে বেশ কয়েকটি যুদ্ধ গাজাবাসীর মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর ভয়াবহ প্রভাব ফেলেছে। যা বার বার তুলে ধরেছে জাতিসংঘ ও ত্রাণ সরবরাহকারী বিভিন্ন সংস্থা।