ভারতের হরিয়ানা অঙ্গরাজ্যের পানিপথ শহরে তিন বছর আগে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন এক ব্যবসায়ী। এবার একটি হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজের সূত্র ধরে এবং পুলিশের নিবিড় তদন্তে বেরিয়ে এসেছে ওই ব্যবসায়ীকে হত্যার সুনিপুণ পরিকল্পনা করেছিলেন তারই স্ত্রী।
মঙ্গলবার (১৮ জুন) এনডিটিভির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২১ সালের ১৫ ডিসেম্বর নিজ বাড়িতেই গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়েছিলেন ব্যবসায়ী বিনোদ ভারারা। দেব সুনার নামে এক ট্রাকচালক তাকে গুলি করেছিলেন। তার কিছুদিন আগে দেব সুনারের ট্রাকের নিচেই চাপা পড়ে গুরুতর আহত হয়েছিলেন বিনোদ। বিনোদকে হত্যার ঘটনায় দেবকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এ সময় দেব পুলিশকে জানিয়েছিলেন, দুর্ঘটনার মামলা নিয়ে মীমাংসায় না আসার কারণেই রাগান্বিত হয়ে তিনি বিনোদকে গুলি করেছিলেন।
বিনোদ মৃত, হত্যাকারী দেব কারাগারে, আর মামলাটি তত দিনে ঝিমিয়ে পড়েছিল। কিন্তু তারপরই জেলা পুলিশ প্রধান ও আইপিএস কর্মকর্তা অজিত সিং শেখাওয়াতের ফোনে একটি হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ আসে। এই মেসেজে বিনোদের হত্যাকাণ্ডটি আবার পর্যালোচনা করার অনুরোধ করা হয়।
মেসেজে সন্দেহ প্রকাশ করা হয়, বিনোদের খুব কাছের কেউ তার হত্যার পরিকল্পনা করেছিলেন। পুলিশকে ওই বার্তাটি পাঠিয়েছিলেন আসলে নিহত বিনোদের ভাই প্রমোদ। তিনি অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী।
হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ পেয়ে বিনোদের হত্যাকাণ্ডের পুরোনো ফাইলগুলো আবারও ঘনিষ্ঠভাবে পর্যালোচনা করে কিছু গলদ দেখতে পান পুলিশ কর্মকর্তা অজিত সিং শেখাওয়াত। পরে তিনি মামলাটি হরিয়ানা পুলিশের অপরাধ তদন্ত সংস্থার দীপক কুমারকে নতুন করে দেখতে বলেন। পুলিশ এবার তদন্ত করে দেখতে পায়, হত্যায় অভিযুক্ত দেব সুনার ঘনিষ্ঠ ছিলেন সুমিত নামে এক ব্যক্তির।
সুমিত ছিলেন একজন জিম প্রশিক্ষক, যিনি বিনোদের স্ত্রী নিধিকে ভালোভাবে চিনতেন। পুলিশ এবার নতুন করে সন্দেহভাজনদের জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে এবং হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যের ঘটনাগুলো উদ্ধার করতে সক্ষম হয়।
সন্দেহভাজনেরা জিজ্ঞাসাবাদের মুখে পুলিশের বিনোদের হত্যাকাণ্ড নিয়ে স্বীকারোক্তি দিতে বাধ্য হয়। এতে জানা যায়, বিনোদের স্ত্রী ও এক কন্যা সন্তানের জননী নিধি ভারারা জিমে ভর্তি হলে তার সঙ্গে পরিচয় হয় সুমিতের। ধীরে ধীরে তারা একে অপরের কাছাকাছি হতে শুরু করেন এবং বিষয়টি পরকীয়ার দিকে মোড় নেয়। বিষয়টি জেনে গিয়েছিলেন বিনোদ। ফলে নিধির সঙ্গে তার ঘন ঘন ঝগড়া-বিবাদ শুরু হয়। ব্যবসায়ী বিনোদ সুমিতের সঙ্গেও দেখা করেন এবং তার স্ত্রীর কাছ থেকে দূরে থাকতে বলেন। এই বিবাদ চলতে থাকলে বিনোদকে হত্যা করার পরিকল্পনা করেন নিধি ও তার প্রেমিক সুমিত।
পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে সুমিত জানান, বিনোদকে হত্যা করার জন্য পাঞ্জাবের ট্রাকচালক দেব সুনারের সঙ্গে তারা দেখা করেন। এই কাজের জন্য দেবকে তারা নগদ ১০ লাখ রুপি অফার করেন। এই প্রস্তাবে রাজি হন দেব। পরে একটি পিকআপ ভাড়া করে ২০২১ সালের ৫ জানুয়ারি বিনোদের গাড়ির ওপর সজোরে আঘাত করেন দেব। এই ঘটনায় সৌভাগ্যক্রমে প্রাণে বেঁচে গেলেও মারাত্মক আহত হন বিনোদ।
হত্যাচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ায় হতাশ হয়ে পড়েন সুমিত ও নিধি। তবে এরপরই তারা বিনোদকে হত্যা করার জন্য ‘প্ল্যান-বি’ তৈরি করেন। দ্বিতীয় পরিকল্পনা অনুযায়ী, দুর্ঘটনার মামলাটি আদালতের বাইরে মীমাংসা করার জন্য বিনোদের বাড়ি যান ট্রাকচালক দেব সুনার। কিন্তু আদালতের বাইরে কোনো ধরনের মীমাংসায় আসতে অপারগতা প্রকাশ করেন বিনোদ। এ অবস্থায় ক্ষুব্ধ হওয়ার অভিনয় করে বিনোদকে গুলি করে হত্যা করেন দেব।
তদন্তে আরও জানা যায়, বিনোদের খুনের কয়েক দিন পরই তার স্ত্রী নিধি মানালি ঘুরতে গিয়েছিলেন সুমিতের সঙ্গে। আর কন্যা সন্তানকে তার চাচা তথা বিনোদের অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী ভাইয়ের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন তিনি।
নিধি এবং সুমিত দুজনই তাদের অপরাধ স্বীকার করেছেন। তারা এটাও জানিয়েছেন, কারাগারে থাকা দেব সুনারের আইনি এবং বাড়ির খরচ নিধি ভারারাই পরিশোধ করে আসছেন। মূলত বিনোদের মৃত্যুর পর তার বিমা ভাঙিয়ে এসব অর্থ পরিশোধ করছেন নিধি। আর স্বামী হত্যার প্রধান সাক্ষী হিসাবে আদালতে তিনি তার বক্তব্যও প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন। এতে মামলাটি মারাত্মকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছিল। খুব শিগগিরই হয়তো ছাড়া পেয়ে যেতেন দেব সুনার।
বিনোদ হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত রহস্য উন্মোচিত হওয়ায় নিধি ও সুমিতকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে হাজির করে পুলিশ। আদালত তাদের দুজনকেই কারাগারে পাঠিয়েছেন।