ভারতের দিল্লির রাজঘাটে বৃষ্টিভেজা গান্ধী স্মারকের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনে উপস্থিত রাষ্ট্রপ্রধানরা। বৈঠকের শেষে ঐক্যের এই ভাব থাকবে কি না, সম্মেলন শুরুর আগে তা নিয়ে সংশয় ছিল। তবে সংশয় কাটিয়ে ‘এক পথিবী ও এক পরিবারের জন্য এক ভবিষ্যত’ গড়ার লক্ষ্যে একমত হল সদস্য দেশগুলো। সম্মেলনে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে দ্বিমেরুকৃত বিশ্বে নিজেদের স্বতন্ত্র অবস্থান বজায় রাখতে সক্ষম হল ভারত।
শনিবার (৯ সেপ্টেম্বর) সম্মেলনের প্রথম দিন নয়াদিল্লি ঘোষিত ঘোষণাপত্রে একমত হয়েছিল সদস্য রাষ্ট্রগুলো। এই সাফল্যকে ‘ঐতিহাসিক ও যুগান্তকারী’ বলে অভিহিত করেছে দেশটি। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছিলেন, “আমি ভাল খবর পেয়েছি। আমাদের টিমের কঠোর পরিশ্রমের ফলে নয়াদিল্লির জি-২০ সম্মেলনের ঘোষণাপত্রে একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া সম্ভব হয়েছে।”
ঘোষণাপত্রে উল্লিখিত স্থায়ী ও ভারসাম্যপূর্ণ উন্নয়নের বিষয়ে একমত হয়েছে সদস্য দেশগুলো। বহুমুখী ও বৈষম্যহীন বাণিজ্যের পক্ষে বলা হয়েছে এই ঘোষণাপত্রে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষিতে মোদির পুরনো একটি মন্তব্যই একটু ভিন্নভাবে প্রতিফলিত হয়েছে ঘোষণাপত্রে। ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছে, “বর্তমান সময় কোনোভাবেই যুদ্ধের সময় নয়।”
জতিসংঘের সনদ উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে, “সব রাষ্ট্র ভূখণ্ড বাড়াতে অন্য দেশের ভৌগোলিক অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্বে হস্তক্ষেপ করা থেকে বিরত থাকবে।” তবে, রাশিয়ার ইউক্রেন আগ্রাসন নিয়ে ঘোষণাপত্রে কিছু বলা হয়নি।
ভারতের এই ভারসাম্যপূর্ণ কূটনীতি জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের সময়কে মনে করিয়ে দিতে পারে। কিন্তু ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতির নিরিখে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী ঠাণ্ডা-যুদ্ধের তুলনায় এখনকার পরিস্থিতি অনেকটাই আলাদা।
এতদিন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দুনিয়ার ধারাবাহিক চাপ সত্ত্বেও জাতিসংঘসহ কোনো আন্তর্জাতিক মঞ্চে ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে রাশিয়ার বিরুদ্ধে আনা প্রস্তাব সমর্থন করেনি ভারত। মস্কোর সঙ্গে বাণিজ্যিক যোগাযোগও ছিন্ন করেনি। বরং রাশিয়ার বিরুদ্ধে পশ্চিমা দেশগুলো অর্থনৈতিক অবরোধ চালিয়ে গেলেও মস্কোর থেকে অপরিশোধিত তেল কেনা অব্যাহত রেখেছে নয়াদিল্লি। ভারত সবসময়ই আলোচনার মাধ্যমে রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের সমস্যা সমাধানের কথা বলেছে।
এবারের সম্মেলনে সদস্য দেশগুলো জি-২০’র নতুন ঘোষণাকে একেক দেশ একেক ভাবে ব্যাখ্যা করছে। রাশিয়ার দাবি, এই সম্মেলনের যৌথ ঘোষণাপত্রে ‘ভারসাম্যের প্রতিফলন’ দেখা গিয়েছে। ফ্রান্সের বক্তব্য, বৈঠকের উপসিদ্ধান্তে রাশিয়াকে ‘কোণঠাসা’ করা গিয়েছে। কিন্তু অনেকেরই ধারণা, আয়োজক দেশ হিসেবে ভারত ভারসাম্যের কূটনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পেরেছে।
জি-২০ সম্মেলনে ভারত থেকে পশ্চিম এশিয়া হয়ে ইউরোপ পর্যন্ত একটি অর্থনৈতিক করিডর তৈরির প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হয়েছে। পশ্চিমা দুনিয়ার প্রায় সব দেশ এই প্রস্তাবকে সমর্থন জানিয়েছে।
লাদাখের সীমান্তসংঘাত নিয়ে চীন যেমন ভারতের মাথাব্যথা, তেমনই ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল ও দক্ষিণ চীন সাগরে বেইজিংয়ের ‘আগ্রাসন’ নিয়ে মাথাব্যথা রয়েছে ওয়াশিংটনেরও।
ইতোমধ্যেই ২০২৬ সালে জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনের আয়োজক দেশ হিসাবে যুক্তরাষ্ট্র নিয়ে আপত্তি জানিয়েছে চীন। এই পরিস্থিতিতে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ভারতের মতো শক্তিকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রয়োজন। ব্রিকস-এর মতো আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীকে চীন যাতে নিয়ন্ত্রিত করতে না পারে, সে দিকেও তীক্ষ্ণ নজর রয়েছে দেশটির।
সমুদ্রপথে চীনের আগ্রাসন রুখতে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে চতুর্দেশীয় কোয়াডে যোগ দিয়েছে ভারত।
সূত্রের খবর, ২০২৪ সালে প্রজাতন্ত্র দিবসের অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে পারেন কোয়াডের রাষ্ট্রপ্রধানেরা। তাই নতুন মেরুকৃত বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক ও অন্যান্য ক্ষেত্রেও সম্পর্ক বাড়াবে ভারত। আপাত নিরপেক্ষতার মধ্যে হয়তো আগেকার জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের পশ্চিমা বিরোধিতার ছাপ থাকবে না। বরং এ লড়াইয়ে ভারতের জয়ে সম্ভবত সক্রিয় ভূমিকা নেবে যুক্তরাষ্ট্রও। নয়াদিল্লির জি-২০ শীর্ষ সম্মেলন হয়তো তারই ইঙ্গিত দিয়ে রাখল।