• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৩ ডিসেম্বর, ২০২৪, ২৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১২ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ইউরোপজুড়ে ভয়াল আগ্রাসন ঘটাতে পারে অগ্নিপিঁপড়া


সংবাদ প্রকাশ ডেস্ক
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১৭, ২০২৩, ০৫:৫০ পিএম
ইউরোপজুড়ে ভয়াল আগ্রাসন ঘটাতে পারে অগ্নিপিঁপড়া
ছবি: সংগৃহীত

অগ্নিপিঁপড়া এমন এক ধরনের পিঁপড়া যেটা কামড়ের জন্য কুখ্যাত। পৃথিবীতে বাস করা কীট প্রজাতির মধ্যে এটি বিরল। এটি লাল পিঁপড়া বলেও পরিচিত। এই পিঁপড়া ইতালিতে বাসা বেঁধেছে এবং জলবায়ু আরও উষ্ণ হলে এরা গোটা ইউরোপে ছড়িয়ে পড়তে পারে। এই আশঙ্কা করছেন গবেষকরা। লাল এই পিঁপড়ার কামড়ে মানুষ এবং পাণি উভয়েই মারাত্মক আহত হতে পারে।

এই পিঁপড়া ফসল ধ্বংস করা ছাড়াও এয়ারকন্ডিশনার, ট্রান্সফরমার এবং সার্কিটব্রেকারগুলোর মতো বৈদ্যুতিক সরঞ্জামগুলো নিমেষেই অকেজো করে দিতে পারে বলে গবেষকরা জানিয়েছেন। স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোতে এই পিঁপড়ার দেখা এখনো না মিললেও বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এবং সবাইকে সজাগ দৃষ্টি রাখার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।

অগ্নিপিঁপড়া- যার বৈজ্ঞানিক নাম সোলেনোপসিস ইনভিক্টা। মূলত দক্ষিণ আমেরিকার জলাভূমিতে দেখা যায়। তবে বাতাসের প্রবাহ এবং পণ্যবাহী জাহাজে চড়ে এরা বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে বলে গবেষকরা জানান। এক শতাব্দীরও কম সময়ে এই পিঁপড়া অস্ট্রেলিয়া, চীন, ক্যারিবিয়ান, মেক্সিকো এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিজেদের ঘর তৈরি করতে পেরেছে বলে জানা যায়। শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই এই প্রজাতির ভয়ংকর আগ্রাসনের কারণে ক্ষতির পরিমাণ বছরে প্রায় ছয় বিলিয়ন মার্কিন ডলার বলে অনুমান করা হয়।

স্প্যানিশ ইনস্টিটিউট ডি বায়োলজিয়া ইভোলুটিভার গবেষক মাতিয়া মেনচেত্তির বলেন, “লাল আগুনে পিঁপড়াটি এখন ইতালিতে নিজেদের আবাস গড়েছে, যা শুধুই সময়ের ব্যাপার ছিল।”

তিনি বলেন, “লাল আগুনে পিঁপড়ার বিভিন্ন প্রজাতির মধ্যে এস ইনভিক্টা হচ্ছে সবচেয়ে ভয়ংকর আক্রমণকারী প্রজাতির একটি।” এটি উদ্বেগজনকভাবে খুব দ্রুততার সঙ্গে ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে এক বিবৃতিতে জানান তিনি। 

ইতালির সিসিলির সিরাকিউসের নিকটবর্তী এলাকার বাসিন্দারা ২০১৯ সাল থেকে মারাত্মক বেদনাদায়ক এবং ক্রমবর্ধমান ঘন ঘন পিঁপড়ার কামড়ের অভিযোগ করে আসছেন। যখন মেনচেত্তির গবেষক দলটি একটি সন্দেহভাজন লাল আগুনে পিঁপড়ার ছবি দেখতে পায়, তখন সেটির নমুনা সংগ্রহে এবং প্রজাতির পরিচয় নিশ্চিত করতে তারা ইতালির সেই দ্বীপে যায়। সেখানে তারা ৪.৭ হেক্টর এলাকাজুড়ে মোট ৮৮টি লাল আগুনে পিঁপড়ার উপনিবেশ খুঁজে পায় এবং তারপর তাদের গবেষণার ফলাফল বৈজ্ঞানিক জার্নাল ‘কারেন্ট বায়োলজিতে’ প্রকাশ করে।

তবে পিঁপড়ার এই প্রজাতিটি কিভাবে ইতালিতে এসেছে তা তারা ঠিকভাবে নির্ণয় করতে পারেনি। তারা ধারণা করেছে, এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা চীন থেকে আসতে পারে।

সুইডেনের এসএলইউ আর্টডেটা ব্যাংকের কীটতত্ত্ববিদ এবং পরিবেশ বিশ্লেষক মোয়া পেটারসন এ প্রসঙ্গে বলেন, “এটি একটি তথাকথিত ডোর-নকার বা দরজায় কড়া নাড়া প্রজাতির অন্তর্গত, যারা সহজেই পরিবাহিত ও সুনির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছে যেতে পারে।” 

তিনি বলেন, “ব্রাজিলের যে অঞ্চল থেকে এটি এসেছে, সেখানে প্রজাতিটি খুব বড় কোনো সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে না, এজন্য যে সেখানে এই প্রজাতির বিরোধীপক্ষ বা প্রাকৃতিক শত্রু রয়েছে। সুতরাং সেখানে প্রাকৃতিকভাবেই এটির ব্যালান্স হয়। কিন্তু এদেরই যদি সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি বাস্তুতন্ত্র বা ইকোসিস্টেমে রাখা হয়, যেখানে সেগুলোর বংশবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করে এমন বিরোধীপক্ষ থাকে না, তাহলে সেগুলো দ্রুত ছড়িয়ে পড়বে।”

এই গবেষণার পেছনের গবেষকরা বিশ্বাস করেন যে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে লাল আগুনে পিঁপড়াগুলো একটি মহাদেশজুড়ে খুব অল্প সময়ের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে পারে। তাদের উপযুক্ত বাসস্থানের বিশ্লেষণ এটাও ইঙ্গিত করে যে ইউরোপের প্রায় সাত শতাংশ এই পিঁপড়ার সম্ভাব্য আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হতে পারে, বিশেষ করে ভূমধ্যসাগরের আশপাশের দেশগুলোতে। বর্তমানের জলবায়ু যেমন দেখা যাচ্ছে, তাতে সুইডেন বা স্ক্যান্ডিনেভিয়ান অন্য দেশগুলোর ঠাণ্ডা আবহাওয়ায় এই আগুনে পিঁপড়ার আগ্রাসন খুব একটা সুবিধা করতে পারবে না বলে মনে করেন গবেষক মোয়া পেটারসন। তিনি এই গবেষণায় জড়িত ছিলেন না। তবে আশ্চর্যের বিষয় হলো, কয়েক বছর আগে ফিনল্যান্ডে এই আগুনে পিঁপড়ার অস্তিত্ব পাওয়া গিয়েছিল। যদিও সেটি ছিল বাড়ির ভেতরে উষ্ণ আবহাওয়ায়।

মোয়া বলেন, “সুইডেনের কোনো গ্রিনহাউস বা এর মতো সুনির্দিষ্ট কোনো উষ্ণ অভ্যন্তরীণ স্থানে এই পিঁপড়ার অস্তিত্ব দেখা গেলে সহজেই তা প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে।”

অগ্নিপিঁপড়া প্রজাতির বিস্তার এড়াতে গবেষকরা অঞ্চলভেদে প্রাথমিক শনাক্তকরণের জন্য সমন্বিত এবং জরুরি প্রচেষ্টার আহ্বান জানিয়েছেন। অদ্যাবধি শুধু নিউজিল্যান্ড আগুনে পিঁপড়া সম্পূর্ণভাবে নির্মূল করতে সফল হয়েছে। একই সময়ে অস্ট্রেলিয়া ছয় লাখ হেক্টরে ছড়িয়ে পড়া চলমান আগুনে পিঁপড়ার উপদ্রব বন্ধ করার জন্য মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার ব্যয় করেও ব্যর্থ হয়েছে। আক্রমণাত্মক আগুনে পিঁপড়ার প্রজাতিগুলো জীববৈচিত্র্যের ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে। বিশ্ব-খাদ্যভাণ্ডার হুমকির সম্মুখীন হয় এবং পরিবেশগত বিপর্যয় বাড়িয়ে দেয়।

সম্প্রতি গ্লোবাল এক্সপার্ট প্যানেল আইপিবিইএস প্রকাশিত এক রিপোর্টে জানা যায়, প্রতিবছর বিশ্বব্যাপী কমপক্ষে ৪২৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের খাদ্য বিনষ্ট হয় এই আগুনে পিঁপড়ার কারণে।

লাল আগুনে পিঁপড়া, ব্ল্যাক ফায়ার পিঁপড়া (সোলেনোপসিস রিচটেরি) এবং গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ফায়ার পিঁপড়া (সোলেনোপসিস জেমিনাটা) ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) আক্রমণাত্মক এলিয়েন প্রজাতির কালো তালিকায় স্থান পেয়েছে। অর্থাৎ এই তিন প্রজাতি আমদানি, বিক্রি, জমানো, পরিবহন, ব্যবহার, বিনিময় এবং প্রকৃতিতে ছেড়ে দেওয়া ইত্যাদির বিরুদ্ধে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।

Link copied!