হিলিয়াম-৩ একটি বিরল মৌল। যেটি জ্বালানি উৎপাদনের অন্যতম এক জোগানদাতা। উপাদানটিকে ভবিষ্যত পৃথিবীর জ্বালানির একমাত্র ভরসা বলেই মনে করা হচ্ছে। হিলিয়াম-৩ পৃথিবীতে নেই বললেই চলে। এর ব্যাপক মজুদ রয়েছে পৃথিবীর উপগ্রহ চাঁদে। সে জন্য চাঁদ ও হিলিয়াম-৩, এ নিয়ে বিভিন্ন মহাকাশ গবেষণা সংস্থার আগ্রহের শেষ নেই।
সম্প্রতি এক গবেষণায় উঠে এসেছে খনিজ তেলের মজুদ ৫০ বছর, প্রাকৃতিক গ্যাসের ৫৩ বছর আর কয়লার মজুদ ১১৪ বছর পর পুরোপুরি শেষ হয়ে যাবে।
জ্বালানির এসব মজুদ শেষ হয়ে গেলে উন্নত দেশগুলো স্বাভাবিকভাবেই তখন পারমাণবিক শক্তির মাধ্যমে উৎপাদিত জ্বালানির দিকে ঝুঁকবে। আর পারমাণবিক শক্তি ব্যবহার করে যে জ্বালানি উৎপাদন করা হবে সেটির জন্যই প্রয়োজন হিলিয়াম-৩ নামক মহামূল্যবান এই মৌল। এটি পারমাণবিক শক্তি বৃদ্ধির অন্যতম উপাদান।
ধারণা করা হচ্ছে, চাঁদের মাটির নিচে বিদ্যমান হিলিয়াম-৩ নামক উপাদান নিউক্লিয়ার ফিউশনের মাধ্যমে শক্তি তৈরিতে বিপ্লব ঘটাতে পারে।
বিজ্ঞানীদের গবেষণায় জানা গেছে, চাঁদের মাটিতে এই হিলিয়াম-৩ এর রিজার্ভ আছে ২৪ লাখ ৬৯ হাজার টন। এই বিশাল পরিমাণের হিলিয়াম-৩ কাজে লাগানো গেলে পৃথিবীর জ্বালানির চাহিদা কয়েক হাজার বছর ধরে পূরণ করা সম্ভব।
তবে এই মুহূর্তে এমন কোনো প্রযুক্তি নেই, যার মাধ্যমে এই জ্বালানি এনে কাজে লাগানো যাবে। কিন্তু বিজ্ঞানীরাও বসে নেই। ইতোমধ্যে এই বিষয়ে গবেষণা শুরু হয়ে গেছে। ১৯৩৪ সালে হিলিয়াম-৩-এর অস্তিত্বের কথা প্রথম বলেন অস্ট্রেলিয়ার পারমাণবিক পদার্থবিদ মার্ক ওলিফ্যান্ট।
পৃথিবীর বুকে প্রাকৃতিকভাবে হিলিয়াম-৩ এর খোঁজ না পাওয়া পর্যন্ত এটিকে মূলত একটি তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ বলে মনে করা হচ্ছিল। এরপর বায়ুমণ্ডল এবং প্রাকৃতিক গ্যাসের কূপ থেকে খুব অল্প পরিমাণে হিলিয়াম-৩-এর খোঁজ পাওয়া যায়।
বর্তমানে সমস্ত পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে তাপ উৎপাদনের জন্য পারমাণবিক বিক্রিয়া ব্যবহার করে জলকে বাষ্পে পরিণত করা হয় এবং বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য টারবাইন চালানো হয়।
পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে পারমাণবিক বিভাজন চুল্লি (ফিশন রিঅ্যাক্টর) রয়েছে। যেখানে জ্বালানি হিসাবে ইউরেনিয়াম ব্যবহার করা হয়। এটি শক্তি উৎপাদন করার পাশাপাশি তেজস্ক্রিয় বর্জ্যও তৈরি করে। এই তেজস্ক্রিয় বর্জ্য নিরাপদে সংরক্ষণ করতে হয়।
নিউক্লিয়ার ফিউশন কার্যকরভাবে একই শক্তি উৎপন্ন করে। তবে তা তেজস্ক্রিয়তা এবং পারমাণবিক বর্জ্য তৈরি করে না। নিউক্লিয়ার ফিউশন থেকেই সূর্য এবং অন্যান্য নক্ষত্র শক্তি পায়।
ফিউশন বিক্রিয়ায়, দুটি হালকা নিউক্লিয়াস একত্রিত হয়ে একটি একক ভারী নিউক্লিয়াস তৈরি করে। প্রক্রিয়াটি শক্তি নির্গত করে কারণ একক নিউক্লিয়াসের মোট ভর দুটি মূল নিউক্লিয়াসের ভরের চেয়ে কম। ফলে অবশিষ্ট ভর শক্তিতে পরিণত হয়।
তবে বিজ্ঞানীদের অনুমান হিলিয়াম-৩ শক্তির উৎসের সবচেয়ে সম্ভাবনাময় বিকল্প হয়ে উঠতে পারে। এই অতেজস্ক্রিয় আইসোটোপ ফিউশন চুল্লিতে শক্তি উৎপাদনের আদর্শ জ্বালানি হিসাবে ব্যবহার করা যেতে পারে বলে মনে করছেন বিজ্ঞানীরা।
ডিউটেরিয়ামের সঙ্গে হিলিয়াম-৩ ব্যবহার করে ফিউশন চুল্লিতে শক্তি উৎপাদন করা যেতে পারে। যদিও এটি এখনো পরীক্ষামূলক পর্যায়ে রয়েছে। তবে বিজ্ঞানীদের বিশ্বাস, চুল্লির কন্টেনমেন্ট চেম্বার এই জাতীয় শক্তি ধারণ করে রাখতে পারলে এটি একটি কার্যকর শক্তির উৎস হয়ে উঠতে পারে। পৃথিবীর শক্তি উৎপাদনের চিন্তা দূর হওয়ার পাশাপাশি তেজস্ক্রিয় বিকিরণের ভয়ও থাকবে না।
এ-ও মনে করা হচ্ছে যে, শক্তির এই অফুরান উৎস হাতের মুঠোয় পাওয়ার জন্যই চাঁদের বুকে মহাকাশযান পাঠানোর এত ধুম দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন দেশের মধ্যে।
২০১৩ সালের ডিসেম্বরে চাঁদের মাটিতে একটি রোবট ল্যান্ডার অবতরণ করতে সক্ষম হয়েছিল চীন। এর উদ্দেশ্য ছিল চাঁদের মাটি এবং পাথর নিয়ে পৃথিবীতে ফিরে আসা। সেই মাটি এবং পাথর থেকে হিলিয়াম-৩ সংগ্রহ করে তা দিয়ে পরীক্ষা চালাচ্ছে চীন।
অন্যদিকে, রাশিয়ার বেসরকারি সংস্থা ‘এনার্জিয়া’ ২০০৬ সালে দাবি করেছিল, ২০১৫ সালে চাঁদের বুকে স্থায়ীভাবে ঘাঁটি তৈরি করে ২০২০ সাল পর্যন্ত হিলিয়াম-৩ সংগ্রহ করবে তারা। কিন্তু তা বাস্তবে পরিণত হয়নি।
২০১৯ সালে ভারতীয় মহাকাশ সংস্থা ইসরো চাঁদে দ্বিতীয় চন্দ্রযান পাঠানোর আগেও জল্পনা উঠেছিল, হিলিয়ামের আইসোটোপের খোঁজেই চাঁদে যান পাঠাচ্ছে ভারত।
সূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা