ডায়াবেটিস সম্পূর্ণ নিরাময় করা যায় না, শুধু নিয়ন্ত্রণ করা যায়- এমন ধারণা নিয়েই জীবন কাটাচ্ছেন বিশ্বের কোটি কোটি ডায়াবেটিস রোগী। রক্তে শর্করার মাত্রা বেড়ে গেলে অবস্থা বুঝে রোগীদের খাওয়ার ওষুধ বা ইনসুলিন দেন চিকিৎসকরা। এটাই ছিল শেষ চিকিৎসা। তবে এবার চীনা বিজ্ঞানীরা দেখালেন নতুন পথ।
বিশ্বে প্রথমবারের মতো একজন ডায়াবেটিক রোগীকে সম্পূর্ণভাবে সুস্থ করে তুলেছেন চীনা বিজ্ঞানীরা। যে ঘটনাকে চিকিৎসাবিজ্ঞানে যুগান্তকারী সাফল্য হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। এ বিষয়ে গত ২৭ মে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট।
চিকিৎসকরা দাবি করছেন, অভিনব কোষ থেরাপির মাধ্যমে ডায়াবেটিস নির্মূল হওয়ার পর দুই বছর ধরে কোনও ইনসুলিন বা ওষুধ খেতে হয়নি রোগীকে। শুধু তা-ই নয়, তার রক্তে শর্করার মাত্রাও বিন্দুমাত্র ওঠানামা করেনি।
এ ব্যাপারে কানাডার ব্রিটিশ কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সেলুলার এবং শারীরবৃত্তীয় বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক টিমোথি কিফার বলেন, “আমি মনে করি এই গবেষণা ডায়াবেটিসের জন্য সেল থেরাপির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতির প্রতিনিধিত্ব করে।
চীনের সাংহাই চাংঝেং হাসপাতাল ও চাইনিজ একাডেমি অব সায়েন্সেসের অধীনে সেন্টার ফর এক্সেলেন্স ইন মলিকিউলার সেল সায়েন্সের একদল বিজ্ঞানী অভিনব কোষ থেরাপির বিস্ময়কর এ পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। গত ৩০ এপ্রিল সেল ডিসকভারি জার্নালে এ বিষয়ে গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে।
যে ব্যক্তিকে নিয়ে গবেষণা করা হয় ও সম্পূর্ণভাবে সুস্থ করে তোলা হয় তিনি ৫৯ বছর বয়সী। তিনি ২৫ বছর ধরে টাইপ টু ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ছিলেন। এতে গুরুতর ঝুঁকিতে ছিলেন। গত ২০১৭ সালে সেই রোগীর একটি কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয়েছিল।
তবে বেশিরভাগ অগ্ন্যাশয়ের আইলেটের কার্যক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছিলেন তিনি, যা রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে। প্রতিদিন একাধিক ইনসুলিন ইনজেকশনের ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল থাকতে হতো সেই রোগীকে।
চলতি মে মাসের শুরুর দিকে সাংহাই চাংজেং হাসপাতালের শীর্ষস্থানীয় গবেষক ইয়িন হাও সাংহাইভিত্তিক নিউজ আউটলেট দ্য পেপারকে বলেন, ওই ব্যক্তি গুরুতর ডায়াবেটিস জটিলতার ঝুঁকিতে ছিলেন। তিনি ২০২১ সালের জুলাই মাসে ‘উদ্ভাবনী কোষ প্রতিস্থাপন’ (ইনোভেটিভ সেল ট্রান্সপ্ল্যান্ট) সেবা পেয়েছিলেন। প্রতিস্থাপনের ১১ সপ্তাহ পর তিনি বাহ্যিকভাবে নেওয়া ইনসুলিন ইনজেকশনের প্রয়োজন থেকে মুক্তি পান।
সেই সময় রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণের জন্য মুখে খাওয়ার ওষুধের ডোজও ধীরে ধীরে কমিয়ে আনা হয়েছিল। বছর খানেক পর মুখে খাওয়ার ওষুধও সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে দেয়া হয়। ফলো-আপ পরীক্ষায় দেখা গেছে, ওই রোগী তার অগ্ন্যাশয় আইলেটের কার্যক্ষমতা পুরোপুরি ফিরে পেয়েছেন। ৩৩ মাসের জন্য সম্পূর্ণরূপে ইনসুলিন নেওয়া বন্ধ রেখেছেন।
অধ্যাপক টিমোথি কিফার মনে করেন, এই কোষ থেরাপি পদ্ধতি বৃহত্তর গবেষণায় কার্যকর প্রমাণিত হলে এটি রোগীদের দীর্ঘস্থায়ী ওষুধের বোঝা থেকে মুক্ত করতে পারে। এর ফলে মানুষের স্বাস্থ্য ও জীবনযাত্রার মান উন্নত হবে এবং চিকিৎসা ব্যয় কমবে।
মূলত, ডায়াবেটিস এমন একটি দীর্ঘমেয়াদী শারীরিক অসুস্থতা, যা সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হয়। এ রোগে বিশ্বে প্রতিবছর ১০ লাখেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়। শরীর যখন রক্তের সব গ্লুকোজকে ভাঙতে ব্যর্থ হয়, তখনই ডায়াবেটিস হয়। এই রোগ জটিল অবস্থায় পৌঁছালে মানুষের হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক পর্যন্ত হতে পারে।
এ ছাড়া ডায়াবেটিসের কারণে মানুষ অন্ধ হয়ে যেতে পারে। বিকল হয়ে যেতে পারে কিডনিও। নতুন এই কোষ থেরাপি গবেষণায় বলা হচ্ছে, ওষুধ ও ইনসুলিন ছাড়াই টাইপ টু ডায়াবেটিস থেকে চিরতরে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। যদিও এটি নিয়ে আরো বিস্তর গবেষণার প্রয়োজন।