বৈশ্বিক উত্তেজনার মধ্যে চলতি সপ্তাহে রাষ্ট্রীয় সফরে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে স্বাগত জানিয়েছেন। তাকে লালগালিচা সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছে। শি ও পুতিন একে অপরকে জড়িয়ে ক্যামেরার সামনে ছবিও তুলেছেন। দুই নেতার সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্কের বিষয়টি বেশ ফলাও করে প্রচার করেছে রাশিয়া ও চীনের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম।
বিশ্লেষকরা বলছেন, পুতিনের জন্য এটি ছিল বিশ্বকে প্রমাণ করার একটি সুযোগ যে রাশিয়ার সঙ্গে শক্তিশালী মিত্র রয়েছে। সফরে সামরিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক উন্নয়নের চেয়ে শি জিনপিং ও ভ্লাদিমির পুতিন পারস্পরিক সম্পর্কের গভীরতা দেখানোর ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন বেশি।
সফর শেষে বিদায় নেয়ার সময় শি জিনপিংয়ের সঙ্গে পুতিন এমনভাবে আলিঙ্গন করেন যা তার ভালোবাসার বিরল প্রকাশ। বিশ্লেষকরা এ আলিঙ্গনকে ‘ইচ্ছাকৃত’ বলেই মনে করছেন। এর উদ্দেশ্য ছিল পশ্চিমা বিশ্বকে দেখানো, আগের চেয়ে জিনপিং ও পুতিন আরো কাছাকাছি। ক্রেমলিন দেশের জনগণকেও বোঝাতে চাইছে, রাশিয়া একা নয় সঙ্গে আছে চীন। ইউরোপের দরকার নেই।
ওই আলিঙ্গন নজরে এসেছে যুক্তরাষ্ট্রেরও। দেশটির জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের মুখপাত্র জন কিরবি তো টিপ্পনী কেটে বলেই বসেছেন, ‘একে অন্যকে আলিঙ্গন? ভালো, এটা তাদেরই মানায়।’
সফরে চীনের ভূয়সী প্রশংসা করে ভ্লাদিমির পুতিন বলেছেন, তার পরিবারের সদস্যরা মান্দারিন ভাষা শিখছেন। ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে পুতিনের এমন বক্তব্য খুব বিরল। শি জিনপিংয়ের সঙ্গে সম্পর্ককে ‘ভাইয়ের মতো ঘনিষ্ঠ’। অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের মুখে থাকা বেইজিংকে আশ্বস্ত করতে অর্থনীতির উন্নয়নের প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন পুতিন।
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর থেকে এটা ছিল পুতিনের ১৯তম চীন সফর। সফরে পুতিনকে ‘গার্ড অব অনার’ দিয়েছে পিপলস লিবারেশন আর্মি। বৈঠকে শিকে ‘বন্ধু ও ভাই’ বলে দাবি করেন পুতিন। স্পষ্ট জানিয়ে দেন, ‘রাশিয়া ও চীনের মধ্যে সম্পর্ক কারো বিরুদ্ধাচরণ করার জন্য গড়ে ওঠেনি।’ সাম্প্রতিক সময়ে ইউক্রেন ইস্যুতে পশ্চিমারা যে চীনকে চাপ দিয়ে আসছে তারই যেন জবাব দিলেন পুতিন।
চীনের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদে দেখা যায়, বৃহস্পতিবার আনুষ্ঠানিক আলোচনার পর কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সুউচ্চ প্রাচীরঘেরা বেইজিংয়ের ঝংনানহাই পার্কে হাঁটছেন দুই নেতা। এ সময় তাদের দুই দোভাষী ছাড়া আর কেউই ছিলেন না। কিছুদূর হাঁটার পর একটি জায়গায় গিয়ে বসেন দুই নেতা। চা পান করেন তারা।
সবকিছু মিলিয়ে এ সফর চীনের চেয়ে পুতিনের জন্য বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ব্যক্তিগত সৌহার্দ দেখানোতেও যেন বেশি আগ্রহ ছিল পুতিনের। তিনি শি জিনপিংকে ‘বন্ধুর মতো ভাই’ বলে উল্লেখ করেছেন। যদিও অনেকটা সংযত আচরণ করেছেন চীনা প্রেসিডেন্ট। তিনি রাশিয়াকে ‘ভালো বন্ধু ও ভালো প্রতিবেশী’ বলে মন্তব্য করেন।
বিবিসি বলছে, ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে ইউরোপ তথা পশ্চিমা বিশ্বে বলা যায় একঘরে রাশিয়া। তবে চীন সেই পথে হাঁটতে চায় না। পশ্চিমের সঙ্গে সম্পর্কে তিক্ততা থাকলেও নিজেকে একঘরে করতে চায় না বেইজিং। পুতিনের সফরে সে বার্তা কিছুটা হলেও দিয়েছেন শি জিনপিং।
এ সফর ঘিরে নানা অনুষ্ঠানে সব মিলিয়ে শি প্রমাণ করতে চেয়েছেন তিনি পশ্চিমা চাপে প্রভাবিত নন। একই সঙ্গে ইউক্রেন যুদ্ধকে ঘিরে চীন রাশিয়াকে সরাসরি সহায়তা করবে সে বিষয়ে কোনো ইঙ্গিত দেননি।
পুতিনের সঙ্গে ঐক্য প্রদর্শন করলেও পর্দার আড়ালে শি এ বার্তাও দিয়েছেন যে পারস্পরিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে বেইজিং আসলে কতদূর যেতে পারে। কারণ দিন শেষে রাশিয়ার স্বার্থ চীনের স্বার্থ নয়। বড় অংশীদার হিসেবে চীন যতটুকু উপকৃত হবে ততটুকুই সহযোগিতা রাশিয়াকে দেবেন শি। এমনকি প্রিয় বন্ধুর ভীষণ প্রয়োজন হলেও। খবর বিবিসি ও রয়টার্স।
সফরটির মূল উদ্দেশ্য ছিল অর্থনৈতিক। সফরসঙ্গী হিসেবে পুতিন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর, অর্থমন্ত্রী ও অর্থনৈতিক উপদেষ্টাকে নিয়ে এসেছেন। যৌথ বিবৃতিতে ‘সহযোগিতা’ শব্দটি ছিল ১৩০ বার। এতে বাণিজ্য বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, দীর্ঘদিনের বিরোধপূর্ণ দ্বীপে একটি বন্দর নির্মাণ এবং জাপান সাগরে নৌ চলাচলের অধিকারের জন্য উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে আলোচনা।
সর্বোপরি চীনের বার্তা ছিল স্পষ্ট
বেইজিং নিজের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেবে। অংশীদারিত্বে বড় অংশীদার হিসেবে চীন যতটুকু উপকৃত হবে সেটুকু সহযোগিতা রাশিয়াকে দেবেন শি। এর মাধ্যমে জোট ও নিজের স্বার্থ বজায় রাখার মতো জটিল ভারসাম্যের পথে হাঁটছেন তিনি।