ইউরোপের ছোট্ট দেশ লিথুনিয়ায় ১১-১২ জুলাই অনুষ্ঠিত হবে পশ্চিমাদের সামরিক জোট ‘ন্যাটো’র শীর্ষ সম্মেলন। এই সম্মেলনকে ঘিরে চলছে নানা প্রস্তুতি। দেশটির রাজধানী ভিলনিয়াসে ব্যাপক সামরিক সরঞ্জাম পাঠাচ্ছে জোটের সদস্য দেশগুলো। এই সমাবেশকে ঘিরে এক হাজারেরও বেশি সেনা মোতায়েন, যুদ্ধ বিমান, আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, ড্রোন বিধ্বংসী এবং পারমাণবিক হামলা মোকাবিলা ব্যবস্থার সরঞ্জামও নিয়ে আসা হয়েছে।
এদিকে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল এবং এশিয়ায় ন্যাটো সম্প্রসারণকে ঘিরে জোটের মধ্যে দেখা দিয়েছে বিরোধ। চীনের আপত্তি বিবেচনায় নিয়ে জোটের বেশকটি দেশ সম্প্রসারণের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘ন্যাটো’ সম্প্রসারণের প্রচেষ্টা যতোটা না সামরিক বা কৌশলগত তার চেয়ে বেশি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত।
জানা গেছে, ‘ন্যাটো’র সঙ্গে সম্পর্ক বাড়াতে জোটটির শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে যাচ্ছেন জাপানের প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদা। এই সম্মেলনে সদস্য দেশগুলোর বাইরে আরও যোগ দেবে দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড। তবে সম্মেলনের আগেই বিভক্ত হয়ে পড়েছে জোটের সদস্যরা। এশিয়ায় জোটের সম্প্রসারণে চীনের আপত্তির বিষয়টি কিভাবে মোকাবিলা করা হবে, মূলত তা নিয়েই বিরোধ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে সদস্য দেশগুলোর মধ্যে।
এশিয়ায় ন্যাটোর সম্প্রসারণে বেইজিংয়ের আপত্তি আছে। তারপরও জাপানের প্রধান মন্ত্রীপরিষদ সচিব হিরোকাজু মাতসুনো বলেন, ‘সম্মেলনে কিশিদা জাপান ও ‘ন্যাটো‘র মধ্যকার সম্পর্ক আরও শক্তিশালী করার ওপর জোর দেবেন। ইন্দো প্যাসিফিক এবং ইউরোপের নিরাপত্তা যে অবিচ্ছিন্ন কিছু নয়, তা কিশিদার সফরের মাধ্যমে দেখানো হবে। সফরটি এই অঞ্চলে ন্যাটোর শক্তিশালী সম্পৃক্ততা নিশ্চিত করবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক জ্যেষ্ঠ ইউরোপীয় কূটনীতিক একটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমকে জানান, মিত্ররা চার ইন্দো-প্যাসিফিক দেশের সঙ্গে একটি সম্ভাব্য বিবৃতি নিয়ে আলোচনা করছে। যেখানে দুই পক্ষের সঙ্গে গভীর সহযোগিতা স্থাপন ও ইউরোপের নিরাপত্তা এ অঞ্চলের আন্তঃসম্পর্কিত থাকবে।–ঠিক এই বক্তব্য পুনর্ব্যক্ত করা হবে।
ওই কূটনীতিক আরও জানান, ‘ন্যাটো’র মধ্যে এসব বিষয়ে মতবিরোধ তৈরি হয়েছে। একপক্ষ চাইছে সদস্য দেশগুলোতেই ‘ন্যাট‘র পূর্ণ মনযোগ থাকুক। অন্যপক্ষ বলছে, জোটের নিরাপত্তাকে প্রভাবিত করে এমন বিষয়গুলোতে নজর দেওয়া উচিত।
জানা যায়, গত বছর চীনকে জোটের জন্য হুমকী হিসেবে ঘোষণার পর ‘ন্যাটো’ এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রদের সঙ্গে সম্পর্ক গভীর করার চেষ্টা করে। কিন্তু গত মে মাসে যখন এশিয়ায় ‘ন্যাটো’র প্রথম কার্যালয় খোলার পরিকল্পনা হয়, তখন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমান্যুয়েল মাখোঁ জোটের পরিধি বাড়ানো একটি বড় ভুল বলে আখ্যায়িত করে সতর্ক করেন।
অপরদিকে, ‘ন্যাটো’র এই শীর্ষ সম্মেলন যেখানে হতে যাচ্ছে তা রাশিয়া থেকে ১৫১ কিলোমিটার এবং রুশমিত্র বেলারুশ থেকে মাত্র ৩২ কিলোমিটার দূরে লিথুনিয়ার রাজধানীতে অবস্থিত।
লিথুনিয়ার প্রেসিডেন্ট গিতানাস নাওসেদা বলেন, সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনসহ ৪০টি দেশের নেতারা আসছেন। এসময় আমাদের আকাশ সুরক্ষিত না রাখা হবে দায়িত্ব জ্ঞানহীন কাজ।
বাল্টিক দেশ লিথুনিয়া, এস্তোনিয়া এবং লাটভিয়া একসময় সোভিয়েত ইউনিয়নভুক্ত ছিল। এই দেশগুলো এখন একই সঙ্গে ‘ন্যাটো’ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত। দেশগুলো বাৎসরিক বাজেটের ২ শতাংশ প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় করে। যা ‘ন্যাটো’ভুক্ত অনেক দেশের তুলনায় অনেক বেশি। তবে অবাক করার বিষয় হলো মাত্র ৬০ লাখ মানুষ বসবাস করে এই অঞ্চলটিতে।
অন্যদিকে, এই সম্মেলনের নিরাপত্তার জন্য জার্মানি ১২টি প্যাট্রিয়ট মিশাইল লাঞ্চার মোতায়েন করেছে। স্পেন দিয়েছে নাসমাস আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। ফ্রান্স পাঠাচ্ছে সিজার সেল্ফ-প্রপেলড হাউটজার ক্ষেপণাস্ত্র। ফ্রান্স, ফিনল্যান্ড ও ডেনমার্ক লিথুনিয়ায় নিয়ে গেছে যুদ্ধবিমান। যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স পাঠাচ্ছে ড্রোন প্রতিরোধী সরঞ্জাম। জোটের অন্যান্য দেশও তাদের প্রয়োজনীয় সামরিক সরঞ্জাম পাঠাচ্ছে দেশটিতে।
জানা যায়, রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণের পর থেকে এখন পর্যন্ত ক্রেমলিনের বিরোধীতা করেনি চীন। বরং দেশটির সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক আরও জোরদার হয়েছে। চীন ও রাশিয়ার এই অংশিদারিত্বকে আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার অবমাননা হিসেবে নিন্দা করে ‘ন্যাটো’ ঘোষণা দেয় যে, চীন জোটের জন্য একটি ‘পদ্ধতিগত চ্যালেঞ্জ’ তৈরি করেছে।
সম্প্রতি ন্যাটোর মহাসচিব স্টলটেনবার্গ বলেন, ‘এশিয়ায় যা ঘটে তা ইউরোপের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, এবং ইউরোপে যা ঘটে তা এশিয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ন্যাটো প্রধানের এই বিবৃতি এমন সময় এসেছে যখন ওয়াশিংটন ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে বহুপাক্ষিক কার্যকলাপ বিকাশের চেষ্টা করছে। চীন বলছে তার উত্থান ঠেকাতেই যুক্তরাষ্ট্র এমনটা করছে।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের সংবাদে জানা যায়, গত কয়েক বছরে যুক্তরাষ্ট্রের আকাশে চীনা নজরদারি বেলুন দৃশ্যমান হওয়ার পর থেকেই ওয়াশিংটন ও বেইজিংয়ের মধ্যে উত্তেজনা বেড়ে যায়। তবে সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রীর বেইজিং সফরের পর দুই দেশের পরিস্থিতি অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে আসে। তবু দুই দেশের মধ্যে সংঘাতের সূত্রপাত ঘটতে পারে এমন বিষয়ে এশীয় নেতারা সতর্ক করে চলেছেন সবসময়।
এশিয়ায় ‘ন্যাটো’র অনুরূপ জোট গঠনের চেষ্টা করছে যুক্তরাষ্ট্র এমন অভিযোগ চীনের। সেই অভিযোগ অস্বীকার করছে যুক্তরাষ্ট্র।
চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ওয়াং ওয়েনবিন গত জুন মাসে সাংবাদিকদের বলেন, ‘এই অঞ্চলের অধিকাংশ দেশের মনোভাব খুবই স্পষ্ট। তারা সামরিক ব্লকের উত্থানের বিরোধীতা করে। এশিয়ায় ন্যাটোর প্রবেশকে তারা স্বাগত জানায় না।’