মধ্যরাতে রাশিয়া থেকে ছুটে আসে ঝাঁকে ঝাঁকে ড্রোন। শুরু হয় হামলা। ঠিক তখনই ইউক্রেনের বুচা শহরে সক্রিয় হয়ে ওঠেন একদল নারী। তারা নিজেদের পরিচয় দেন ‘বুচার ডাইনি’ নামে। ইউক্রেনের পুরুষেরা যখন সম্মুখযুদ্ধে ব্যস্ত, তখন শত্রুপক্ষের হাত থেকে দেশের আকাশকে রক্ষার দায়িত্ব নিয়েছেন এই নারীরা।
এই নারীরা দিনের বেলায় ভিন্ন এক পরিচয়ে থাকেন। এ সময় তাদের কেউ শিক্ষক, কেউ চিকিৎসক, কেউ আবার বিউটি পারলারে কাজ করেন। রাত হলে ‘ডাইনি’ পরিচয়ে যুদ্ধে নামেন তারা। ২০২২ সালে যুদ্ধের শুরুর দিকে রাশিয়ার হামলার মুখে নিজেদের একেবারে দুর্বল মনে করতেন এই নারীরা। তবে এখন লড়াইয়ে সক্রিয় হওয়ার পর তাদের সেই হতাশা কেটেছে।
ইউক্রেনের এই দলের অস্ত্রগুলো বহু পুরোনো। তাদের মেশিনগানগুলো ‘ম্যাক্সিম’ মডেলের-১৯৩৯ সালে তৈরি। গোলাবারুদের বাক্সের ওপর সেকেলে সোভিয়েত আমলের লাল তারকা চিহ্ন।
নরওয়ে অঞ্চলের রূপকথায় ‘ভ্যালকাইরি’ নামে একটি নারী চরিত্র আছে। দেবরাজ ওডিনের হয়ে যুদ্ধে যেত তারা। এই ভ্যালকাইরি নাম নিজের জন্য বেছে নিয়েছেন ‘বুচার ডাইনি’ দলের এক সদস্য। তার আসল নাম ভ্যালেনটিনা। চলতি গ্রীষ্মেই দলে যোগ দিয়েছেন। তিনি বললেন, ‘আমার বয়স ৫১। ওজন ১০০ কেজি। দৌড়াতে পারি না। তারপরও আমি দলে যোগ দিয়েছি।’
সেকেলে এই অস্ত্রগুলোই অত্যন্ত সুনিপুণভাবে ব্যবহার করে যাচ্ছেন ‘বুচার ডাইনিরা’। তাদের দাবি, চলতি গ্রীষ্মেই শত্রুপক্ষের তিনটি ড্রোন ধ্বংস করেছেন তারা। ভ্যালকাইরি বলেন, ‘আমার কাজ ড্রোনের শব্দের খোঁজ রাখা। এই কাজে খুব চাপে থাকতে হয়। (ড্রোনের) সামান্যতম শব্দের জন্য আমাদের সব সময় চোখকান খোলা রাখতে হয়।’
ভ্যালকাইরির বান্ধবীর নাম ইনা। তিনি বেছে নিয়েছেন ‘চেরি’ ছদ্মনাম। তার বয়স পঞ্চাশের কোঠার শুরুর দিকে। হাসতে হাসতে তিনি বলেন, ‘কাজটা খুবই ভয় ধরানো। তবে সন্তান জন্ম দেওয়াও একই রকমের ভয়ের। আর আমি তা তিনবার করে ফেলেছি।’ চেরির কথায়, ‘ইউক্রেনের নারীরা কী করতে পারেন না? আমরা সব করতে পারি।’
ইউক্রেনে এ ধরনের মোট কতটি স্বেচ্ছাসেবী দল রয়েছে, তা নিয়ে কোনো সরকারি তথ্য নেই। কত সংখ্যক নারীই–বা এ কাজে জড়িত, সে হিসাবও পাওয়া যায় না। তবে এটা ঠিক যে প্রায় প্রতি রাতেই বিস্ফোরকভর্তি ড্রোন পাঠায় রুশ বাহিনী। সেগুলোর কবল থেকে ইউক্রেনের বড় শহরগুলো রক্ষায় বাড়তি একটি সুরক্ষা বলয় তৈরি করেন এই নারীরা।
ভ্যালকাইরিদের দলের নেতা একজন পুরুষ। তার নাম কর্নেল আন্দ্রি ভারলেতি। ইউক্রেনের পূর্ব দনবাস অঞ্চলের পোকরোভস্ক এলাকা থেকে সবে ফিরেছেন তিনি। দনবাসে এখন তুমুল লড়াই চলছে। হাসিমুখে ভারলেতি বললেন, ‘সেখানে একের পর এক বিস্ফোরণ হয়। থামে না।’
বুচা অঞ্চলের আকাশ প্রতিরক্ষায় একসময় ভারলেতির দলে প্রায় ২০০ পুরুষ ছিলেন। তাদের অনেকেই সামরিক বাহিনীতে যোগ দেওয়ার জন্য উপযুক্ত ছিলেন না। পরে ইউক্রেনে সেনাসংকট দেখা দেয়। নতুন সেনা সংগ্রহে আইনে পরিবর্তন আনা হয়। ফলে ভারলেতির দলে যারা এত দিন সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার জন্য উপযুক্ত ছিলেন না, তারা যোগ্য হয়ে পড়েন।
বুচার এই ‘ডাইনিদের’ অনেকেই যুদ্ধে নেমেছেন আবেগের তাড়নায়। যুদ্ধ শুরুর পর ভ্যালকাইরির পরিবার বুচা ছেড়ে চলে যায়। পথে রাশিয়ার একটি তল্লাশিচৌকিতে তাদের গাড়ি থামানো হয়। তখন এক রুশ সেনা তার শিশুসন্তানের মাথায় বন্দুক ঠেকিয়েছিলেন। ভ্যালকাইরির ভাষ্যমতে, এতে খুবই ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন তিনি।
রাশিয়া যখন বুচা দখল করে, তখন শহরটির ঘরে ঘরে হানা দিয়েছিলেন রুশ সেনারা। সে সময় তাদের বিরুদ্ধে ধর্ষণ ও হত্যার অভিযোগ আনা হয়। এরই মধ্যে একদিন গুজব ছড়িয়ে পড়ে, বুচার শিশুদের হত্যা করতে আসছে রুশ বাহিনী। সেদিনের কথা মনে পড়ে ৫২ বছর বয়সী আনিয়ার। ‘বুচার ডাইনিদের’ একজন এই নারী বলেন, ‘সেদিনই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, রুশদের কখনোই মাফ করব না।’ সূত্র: বিবিসি