মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কয়েকটি দেশে দীর্ঘদিন ধরেই অস্থিরতা বিরাজ করছে। কয়েকটি দেশে যুদ্ধও চলছে। এর মধ্যে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন, ইসরায়েল-ইরান-লেবানন ছিল সবচেয়ে বেশি আলোচনা-সমালোচনায়। কিন্তু এসবকে ছাড়িয়ে হঠাৎ করেই আলোচনায় আসে ‘সিরিয়া ইস্যু’। যদিও দীর্ঘদিন ধরে বিদ্রোহীদের সঙ্গে সংঘর্ষ চলছিল দেশটির আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর। চলমান এই আন্দোলন হঠাৎ করেই তীব্র হয়ে ওঠে। এতে মাত্র ১৪ দিনেই দেশটির ক্ষমতায় থাকা বাশার আল-আসাদের পতন হয়। শুধু পতন নয়, দেশ ছাড়তেও বাধ্য হন দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকা এই প্রেসিডেন্ট।
বাশার আল-আসাদের বাবা হাফিজ আল-আসাদের হাত ধরে গত শতকের সত্তরের দশকে সিরিয়ায় ‘আসাদ পরিবার’র শাসন শুরু হয়েছিল। হাফিজ আল-আসাদ ১৯৭১ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট ছিলেন। ২০০০ সালে তার মৃত্যু হয়। বাবার মৃত্যুর পর সিরিয়ার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন বাশার আল-আসাদ।
ক্ষমতায় আসার পর দেশ সংস্কারের ব্যাপারে উদ্যোগী হন বাশার আল-আসাদ। তার সংস্কার উদ্যোগের মধ্যে প্রশাসনিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। এর মধ্যে বাবার ২৯ বছরের শাসনামলের বেশ কিছু নিষেধাজ্ঞা শিথিল করেন বাশার। কিন্তু বাশার আল-আসাদ পরবর্তী সময়ে সংস্কারকের ভূমিকা থেকে বাবা হাফিজ আল-আসাদের মতোই একজন কর্তৃত্ববাদী স্বৈরশাসকে পরিণত হন।
২০১১ সালের মার্চে আরব বসন্তের ঢেউ লাগে সিরিয়ায়। দেশটিতে শুরু হয় বাশার আল-আসাদবিরোধী বিক্ষোভ। বিক্ষোভ দমনে সহিংস উপায় বেছে নেন বাশার। সরকারি দমন–পীড়নের মুখে এক পর্যায়ে বাশার আল-আসাদবিরোধীরা হাতে অস্ত্র তুলে নেন। দেশটিতে শুরু হয় এক রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ। দেশজুড়ে বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠী বাশার আল-আসাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামে। এই লড়াইয়ে একের পর এক এলাকা বাশার আল-আসাদ সরকারের হাতছাড়া হয়।
সিরিয়ায় কিছু মিত্র দেশ ছিল। যারা সব সময় বাশার আল-আসাদকে সহযোগিতা করে আসছিল। চলমান সংকটে বাশার আল–আসাদের পক্ষ নিয়ে তাকে রক্ষায় সামরিক শক্তি নিয়োগ করে রাশিয়া ও ইরান। শেষের দিকে লেবাননের ইরানপন্থী প্রভাবশালী রাজনৈতিক ও সশস্ত্র সংগঠন হিজবুল্লাহও সক্রিয়ভাবে বাশার আল-আসাদের পাশে দাঁড়ায়। মূলত এই শক্তিগুলোই বাশার আল-আসাদের ক্ষমতাকে দীর্ঘায়িত করে। মিত্রদের সামরিক সহায়তা নিয়ে ২০২০ সাল নাগাদ আলেপ্পোসহ সিরিয়ার মূল শহরগুলোর নিয়ন্ত্রণ ফিরে পান বাশার আল-আসাদ। তখন থেকে সিরিয়ার সিংহভাগ এলাকায় চলছিল বাশার আল-আসাদের শাসন।
সিরিয়ায় সংঘাত, রক্তপাত পুরোপুরি থেমে থাকেনি। প্রায় ১৩ বছরের গৃহযুদ্ধে ৬ লাখের বেশি মানুষ নিহত হন। বাস্তুচ্যুত ১ কোটি ৩০ লাখের বেশি মানুষ। গৃহযুদ্ধে ভয়াবহ মানবিক সংকটে পড়ে সিরিয়া। কিন্তু এদিকে সামান্যতম ভ্রুক্ষেপ না করে বাশার আল-আসাদ তার ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করতে ব্যস্ত থাকেন।
এভাবেই চলতে থাকায় বিশ্বের নজর সিরিয়া থেকে অন্যত্র সরে যায়। ২০২২ সালে শুরু হয় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। এরপর গত বছরের ৭ অক্টোবর ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় নির্বিচার হামলা শুরু করে ইসরায়েল। গাজা যুদ্ধ ঘিরে আঞ্চলিক উত্তেজনা বেড়ে যায়। ইসরায়েল-হিজবুল্লাহ সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে। ইরান-ইসরায়েলের মধ্যে বড় ধরনের পাল্টাপাল্টি হামলার ঘটনা ঘটে। এরপর গত নভেম্বরে অনুষ্ঠিত হয় মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। এই নির্বাচনের দিকে মধ্যপ্রাচ্যসহ পুরো বিশ্বের দৃষ্টি ছিল। নির্বাচনে রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প জয়ী হয়ে চমক দেন।
এসব বৈশ্বিক ঘটনার ডামাডোলে সিরিয়া ইস্যু হারিয়ে যেতে বসেছিল। তবে গেল নভেম্বরের শেষ দিকে দেশটির বিদ্রোহীদের আচমকা ও বিস্ময়কর অগ্রযাত্রার মধ্য দিয়ে আবার বৈশ্বিক নজরের কেন্দ্রে চলে আসে সিরিয়া। ২৭ নভেম্বর সিরিয়ার বিদ্রোহী যোদ্ধারা নতুন করে, নতুন উদ্যমে বাশার আল-আসাদ সরকারবিরোধী অভিযান শুরু করেন। এই অভিযানে নেতৃত্ব দেয় বিদ্রোহী গোষ্ঠী হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস)। এতে মার্কিন সরকারের ব্যাপক সহযোগিতা ছিল।
পরিস্থিতি আঁচ করতে পেরে গত ২৮ নভেম্বর মস্কোয় ছুটে যান বাশার আল-আসাদ। তিনি রাশিয়ার কাছে সামরিক সহায়তা চান। তাকে টিকিয়ে রাখার আবেদন জানান। কিন্তু রাশিয়ার চিন্তায় এখন ইউক্রেন। তাই মস্কো আর আগের মতো বাশার আল-আসাদকে সামরিক সহায়তা দিতে আগ্রহ দেখায়নি।
দারুণ হতাশা নিয়ে দেশে ফেরেন বাশার আল-আসাদ। তবে তিনি তার মস্কো সফরের ব্যর্থতা চেপে রাখেন। ঘনিষ্ঠ সহযোগী, সামরিক কমান্ডারদের তিনি মিথ্যা আশার বাণী শোনান। বিদ্রোহীদের সমূলে নির্মূলের হুমকি দেন। এর আবার শুরু অভিযান।
অভিযান শুরুর মাত্র ৪ দিনের মাথায় ৩০ নভেম্বর সিরিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর আলেপ্পো দখল করে নেন বিদ্রোহীরা। বিদ্রোহী যোদ্ধাদের অভিযানের মুখে সিরিয়ার বিভিন্ন কৌশলগত অবস্থান থেকে পালিয়ে যেতে থাকেন সরকারি সেনাসদস্যরা। এ ঘটনার পর বাশার আল-আসাদকে টিকিয়ে রাখতে রাশিয়া নামকাওয়াস্তে বিদ্রোহীদের ওপর বিমান হামলা চালায়। অন্যদিকে আলেপ্পো থেকে বিদ্রোহীদের দামেস্ক যাওয়া ঠেকাতে মধ্যবর্তী হামা শহরে যোদ্ধা পাঠায় হিজবুল্লাহ। কিন্তু এসব বিদ্রোহীদের অগ্রযাত্রা থামাতে ব্যর্থ হয়।
৫ ডিসেম্বর হামা দখল করে নেন বিদ্রোহীরা। তারা দুর্বার গতিতে দামেস্কের দিকে অগ্রসর হতে থাকেন। বিদ্রোহীদের হাতে সিরিয়ার তৃতীয় বৃহত্তম শহর হোমসের পতন হয় ৭ ডিসেম্বর। এরপর দামেস্কের কাছের দেরা ও সুয়েইদা শহরের নিয়ন্ত্রণ হারায় সরকারি বাহিনী।
৭ ডিসেম্বর বাশার আল-আসাদ তার সরকারের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে বৈঠক করেন। বৈঠকে দেশটির শীর্ষস্থানীয় সেনা ও নিরাপত্তা কর্মকর্তারা অংশ নেন। বৈঠকে সিরিয়ার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ এই বলে নিশ্চয়তা দেন যে রুশ বাহিনী তাকে সহায়তা করতে এগিয়ে আসবে। ওই দিন রাত সাড়ে ১০টা নাগাদ সিরিয়ার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আল-জালালির সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেন বাশার আল-আসাদ। এই ফোনালাপে মাঠের কঠিন পরিস্থিতির কথা বাশার আল-আসাদকে জানিয়েছিলেন আল-জালালি। জবাবে বাশার আল-আসাদ বলেছিলেন, “আগামীকাল, আমরা বিষয়টি দেখব।” তবে বিষয়টি পরদিন আর দেখার সুযোগ হয়নি বাশার আল-আসাদের। ৮ ডিসেম্বর ভোরে সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে ঢুকে পড়েন বিদ্রোহী যোদ্ধারা।
বিদ্রোহীদের দামেস্ক দখলের মুখে বাশার আল-আসাদ এদিন ভোরে একটি উড়োজাহাজে করে রাজধানী ছাড়েন। দামেস্ক থেকে বাশার আল-আসাদ যান সিরিয়ার উপকূলীয় শহর লাতাকিয়ায়। লাতাকিয়ার রুশ বিমানঘাঁটি থেকে বাশার আল-আসাদকে মস্কোয় উড়িয়ে নেওয়া হয়।
এর মধ্য দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের আধুনিক ইতিহাসে সবচেয়ে নৃশংস এক স্বৈরাচারী সরকারের পতন ও দেশটিতে ১৩ বছরের গৃহযুদ্ধের ইতি ঘটে। এরপর থেকে রাশিয়ায় অবস্থান করছেন বাশার আল-আসাদ।
বিশ্লেষকদের মতে, সিরিয়া যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল পরাশক্তি দেশগুলো। ফলে বাশার আল-আসাদ সরকারের পতনের পরে মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতিতে বড় ধরনের একটি পরিবর্তন এখন অনিবার্য হয়ে উঠেছে।