ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলের ‘নৃশংস’ হামলার কথা সবার জানা। সেখানের নারী-শিশুর কান্না যেন সবার চোখে ভাসে। ধ্বংসস্তূপ ও মরদেহ দেখলে মনে হবে যেন কোনো ‘সিনেমার’ শেষ দৃশ্য। গত বছরের অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া ইসরায়েলি বাহিনীর এই আগ্রাসন যেন থামছেই না। প্রতিদিনই বাড়ছে হতাহতের সংখ্যা। এ ঘটনায় কয়েকটি দেশ ইসরায়েলের পক্ষ নিলেও প্রতিবাদ ও নিন্দা জানিয়েছে জাতিসংঘসহ বিশ্বের প্রায় সব দেশ।
এদিকে গাজা তথা ফিলিস্তিনিদের রক্ষার্থে শুরু থেকে যুদ্ধ করে আসছে স্বাধীনতাকামী সংগঠন ‘হামাস’। এরপর তাদের সঙ্গে যুক্ত হয় লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহও। পরবর্তীকালে নিরীহ গাজাবাসীর ওপর হামলার তীব্র প্রতিবাদ জানায় ইরান। একসময় সরাসরি সংঘাতে জড়ায় ইরান-ইসরায়েলও। শুরু হয় পাল্টিপাল্টি হামলা। এতে হামাস প্রধানসহ শীর্ষ কয়েক নেতার মৃত্যু হয়। চলমান সংঘাতের মধ্যে এক দুর্ঘটনায় মারা যান ইরানের প্রেসিডেন্ট।
হামাস প্রধান ইয়াহিয়ার মৃত্যু
চলতি বছরের ১৬ অক্টোবর দক্ষিণ গাজায় এক অভিযান চালিয়ে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসের প্রধান ইয়াহিয়া সিনওয়ারকে হত্যা করে ইসরায়েলি বাহিনী।
হামাস প্রধান নিহতের পর ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থা শিন বেত যৌথ বিবৃতিতে জানায়, ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীর ৮২৮তম ব্রিগেডের অভিযানে দক্ষিণ গাজায় তিনজন নিহত হন। ওই তিনজনের মরদেহের পরিচয় শনাক্তের পর ইয়াহিয়া সিনওয়ারের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে।
ইয়াহিয়া সিনওয়ার ১৯৬২ সালে গাজার খান ইউনিস শরণার্থী ক্যাম্পে জন্ম গ্রহণ করেন। তার পরিবারের আদি বাসস্থান ছিল মাজদাল আসকালানে। পরবর্তী সময়ে দখলদার ইসরায়েল যার নাম দেয় আসকেলন। ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘের ভোটাভুটির মাধ্যমে ইসরায়েলের সৃষ্টি হওয়ার পর সিনওয়ারের পরিবারকে মাজদাল আসকালান ছেড়ে গাজার খান ইউনিসে চলে যেতে হয়। সেখানে শরণার্থী হিসেবে জীবন শুরু করেন তারা।
সিনওয়ার তার জীবনের ২২ বছর দখলদার ইসরায়েলের কারাগারে ছিলেন। ১৯৮৮ সালে দুই ইসরায়েলি সেনাকে জিম্মি এবং তাদের হত্যা করায় সিনওয়াকে আটক করা হয়েছিল। ২০১১ সালে বন্দী বিনিময় চুক্তির মাধ্যমে মুক্তি পান তিনি।
সিনওয়ার যখন কারাগারে ছিলেন তখন ইসরায়েলি সরকার তাকে পর্যবেক্ষণ করে বলেছিল, তিনি ‘দয়ামায়াহীন’ এবং ‘শক্তিশালী’। ইসরায়েলি কারাগারে বন্দী থাকার সময় হিব্রু ভাষা আয়ত্ত করেছিলেন তিনি।
ইসরায়েলের হামলায় ইসমাইল হানিয়ার মৃত্যু
ইয়াহিয়া সিনওয়ারের মৃত্যু আগে গত জুলাইয়ে ইরানের রাজধানী তেহরানে ইসরায়েলের হামলায় নিহত হন হামাসের রাজনৈতিক শাখার তৎকালীন প্রধান ইসমাইল হানিয়া। এরপর সিনওয়ারকে হামাসের প্রধান করা হয়।
ইসমাইল হানিয়া হামাসের রাজনৈতিক শাখার প্রধান ও ফিলিস্তিনের প্রধানমন্ত্রী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠনটির সূচনালগ্ন থেকেই এর সদস্য ছিলেন তিনি।
ইসমাইল হানিয়া ১৯৬৩ সালে গাজার আল-শাতি শরণার্থীশিবিরে জন্মগ্রহণ করেন। তার জন্মের ১৫ বছর আগে ইসরায়েল রাষ্ট্রের জন্ম হয়। ওই সময় হানিয়ার পরিবার গাজা থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে আশকেলন শহরে পালিয়ে যায়।
ইরান-ইসরায়েলের পাল্টাপাল্টি আক্রমণ
গত ১ এপ্রিল সিরিয়ার দামেস্কে ইরানি কনস্যুলেটে হামলা চালায় ইসরায়েল। এর জবাবে গত ১৩ এপ্রিল ইসরায়েল অভিমুখে ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ার কথা জানায় ইরান। হামলার জবাবে পাল্টা হামলা।
শুরুতে তেহরান বলেছিল, এটি তাদের ভূখণ্ডে হামলা করার শামিল। ইরান তখন ১৯৬১ সালের ভিয়েনা কনভেনশনের কথা উল্লেখ করে বলেছিল, কোনো কূটনৈতিক এলাকা, দূতাবাস ও কনস্যুলেটে কারও হামলা চালানো উচিত নয়। তবে ইরান কিংবা ইরানি স্থাপনাকে হামলার লক্ষ্যবস্তু করাকে বৈধ বলে দাবি করে থাকে ইসরায়েল।
দামেস্কে কনস্যুলেটে হামলার ১৩ দিন পর পাল্টা হামলা চালায় ইরান। তারা ইসরায়েল অভিমুখে প্রায় ২০০টি ব্যালিস্টিক মিসাইল ছুড়েছিল। ইসরায়েলের হামলায় হামাসের রাজনৈতিক নেতা ইসমাইল হানিয়া, হিজবুল্লাহ নেতা হাসান নাসরাল্লাহ এবং ইরান রেভলিউশনারি গার্ড কর্পসের কুদস ফোর্সের অপারেশন কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আব্বাস নিলফোরোশানের মৃত্যুর প্রতিক্রিয়ায় ইসরায়েলে এই হামলা চালায় ইরান।
এর আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পূর্বে ইসরায়েলকে পরামর্শ দিয়েছিল যেন তারা পারমাণবিক ও তেলের স্থাপনাগুলোতে হামলা না চালায়, কারণ এটি মধ্যপ্রাচ্যে সংঘাতের প্রসার ঘটাতে পারে।
এ বিষয়ে ওই সময় র্যান্ডস প্রজেক্ট এয়ার ফোর্সের কৌশল এবং পরামর্শ কর্মসূচিবিষয়ক পরিচালক কোহেন বলেন, ইসরায়েল আগে থেকেই মনে করে, ইরানের সঙ্গে তাদের যুদ্ধ চলছে। কারণ, তারা বিশ্বাস করে গাজায় হামাস, লেবাননের হিজবুল্লাহ এবং ইয়েমেনে হুতি বিদ্রোহীদের আশ্রয়-প্রশ্রয়, তহবিল জোগানো ও অস্ত্রশস্ত্র দেয় ইরান।
ইরানে ইসরায়েলের পাল্টা হামলা
হামলা প্রতিবাদে গত ২৬ অক্টোবর ভোরে ইরানের ‘সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে’ হামলা চালায় ইসরায়েল। এরপর ইসরায়েলি হামলায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিয়ে বিবৃতি দেয় ইরানের এয়ার ডিফেন্স ফোর্স।
বিবৃতিতে বলা হয়, তেহরান, খুজেস্তান ও ইলাম প্রদেশে কয়েকটি ঘাঁটিতে হামলা হয়েছে। এসব হামলাকে সাফল্যের সঙ্গে মোকাবিলা করা হয়েছে। তবে কিছু জায়গায় ‘সীমিত ক্ষতি’ হয়েছে।
অন্যদিকে ইসরায়েলি ডিফেন্স ফোর্স বা আইডিএফ এক বিবৃতিতে জানায়, ইসরায়েলে নিক্ষেপ করা ক্ষেপণাস্ত্র নির্মাণের জন্য ব্যবহৃত স্থাপনায় তারা হামলা করেছে। হামলা শেষে তাদের বিমানগুলো নিরাপদে দেশে ফিরেছে। এ ছাড়া ভূমি থেকে আকাশে উৎক্ষেপণযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র প্রক্রিয়াসহ ইরানের আকাশ সক্ষমতাকে টার্গেট করে হামলা করা হয়।
আইডিএফ জানায়, তারা ইরানের ‘সামরিক স্থাপনায় সুনির্দিষ্ট হামলা’ চালিয়েছে। গত কয়েক মাস ধরে ইরানের ধারাবাহিক হামলার জবাবে এ হামলা চালানো হয়েছে।
অন্যদিকে হোয়াইট হাউজ জানায়, ‘আত্মরক্ষার’ অংশ হিসেবে ইরানে এই হামলা করেছে ইসরায়েল।
দুই ইসরায়েলি কর্মকর্তার বরাত দিয়ে নিউইয়র্ক টাইমস জানায়, ১৪০টি যুদ্ধবিমান ব্যবহার করে ইরানের প্রায় ২০টি স্থানে আঘাত করার পর স্থানীয় সময় ভোর ৫টা নাগাদ ইসরায়েল হামলা সমাপ্ত ঘোষণা করে।
ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসির মৃত্যু
ইসরায়েল-ফিলিস্তিন ইস্যুতে ইরান সংঘাতে জড়ানোর পর গত মে মাসে এক হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি-পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেন আমির আব্দুল্লাহিয়ানসহ বেশ কয়েকজন মারা যান। যে মৃত্যু নিয়ে পরবর্তীতে অনেক আলোচনা-সমালোচনার সৃষ্টি হয়।
দুর্ঘটনার আগেরদিন আজারবাইজানের সীমান্তবর্তী এলাকায় ২ দেশের যৌথভাবে নির্মিত একটি বাঁধ উদ্বোধন করতে যান ইব্রাহিম রাইসি। সেখানে আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট ইলহাম আলিয়েভও ছিলেন। সেখান থেকে ৩টি হেলিকপ্টারের বহর নিয়ে ইরানের পূর্ব আজারবাইজান প্রদেশের রাজধানী তাবরিজে ফিরছিলেন ইব্রাহিম রাইসি ও তার সঙ্গে থাকা অন্য কর্মকর্তারা। পথে পূর্ব আজারবাইজানের জোলফা এলাকার কাছে দুর্গম পাহাড়ে প্রেসিডেন্টকে বহনকারী হেলিকপ্টারটি বিধ্বস্ত হয়। তবে অন্য দুটি হেলিকপ্টার নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছায়।
এটি নিছক ‘দুর্ঘটনা’ ছিল, নাকি গভীর কোনো ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছিলেন রাইসি, সে রহস্য আজও অজানা। রাইসির মৃত্যু ঘিরে কয়েকটি ষড়যন্ত্র তত্ত্ব শোনা গিয়েছিল। যদিও ওই ঘটনার পরদিন ইরানের সংবাদমাধ্যমগুলো খুব সরল ভাষায় প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হয়ে নিহত হয়েছেন বলে খবর প্রকাশ করেছিল।
যুদ্ধবিরতি নিয়ে বৈঠক
ইসরায়েল-ফিলিস্তিনের সংঘাতের ইতি ঘটাতে মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশ তৃতীয় পক্ষ (মধ্যস্থতা) হিসেবে কাজ করেছে। সর্বশেষ ফিলিস্তিনের গাজায় যুদ্ধ বন্ধে একটি ‘স্পষ্ট ও সমন্বিত’ যুদ্ধবিরতি চুক্তি নিয়ে আলোচনা করতে স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসের প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠক করেছেন কাতারের প্রধানমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ বিন আবদুলরহমান বিন জসিম আল-থানি।
শনিবার (২৮ ডিসেম্বর) কাতারের রাজধানী দোহায় এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে হামাসের প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন সংগঠনটির জ্যেষ্ঠ নেতা খলিল আল-হাইয়া।
এক বিবৃতিতে এ তথ্য জানায় কাতারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
বিবৃতিতে বলা হয়, বৈঠকে গাজায় যুদ্ধবিরতি আলোচনার সর্বশেষ পরিস্থিতি পর্যালোচনা করা হয়। এ অঞ্চলে চলমান যুদ্ধের সমাপ্তি টানতে একটি স্পষ্ট ও সমন্বিত চুক্তি নিশ্চিত করতে এ প্রক্রিয়াকে কীভাবে এগিয়ে নেওয়া যায়, সে উপায় নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
এদিকে ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েলি হামলায় আরও ৪৮ ফিলিস্তিনি নিহত ও ৫২ জন আহত হয়েছেন। এতে করে গত বছরের অক্টোবর থেকে এ পর্যন্ত মোট নিহতের সংখ্যা ৪৫ হাজার ৪৮৪ জনে পৌঁছাল। গত বছরের অক্টোবর থেকে চলা এই হামলায় আহত হয়েছেন আরও লক্ষাধিক ফিলিস্তিনি।
শনিবার এক প্রতিবেদনে বার্তা সংস্থা আনাদোলু জানায়, গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলের চলমান হামলায় কমপক্ষে আরও ৪৮ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। এতে করে গত বছরের অক্টোবর থেকে এ পর্যন্ত মোট মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৪৫ হাজার ৪৮৪ জনে পৌঁছেছে বলে শনিবার অবরুদ্ধ এই ভূখণ্ডের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে।
অনেক মানুষ এখনো ধ্বংসস্তূপের নিচে এবং রাস্তায় আটকা পড়ে আছেন। উদ্ধারকারীরা তাদের কাছে পৌঁছাতে পারছেন না। বাড়ির ধ্বংসস্তূপের নিচে এখনো ১০ হাজারের বেশি লোক নিখোঁজ রয়েছেন।
এ ছাড়া ইসরায়েলি আগ্রাসনের কারণে প্রায় ২০ লাখের বেশি বাসিন্দা তাদের বাড়িঘর ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। অবরুদ্ধ এই ভূখণ্ডের ৬০ শতাংশ অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস হয়ে গেছে।