প্রাণের উৎসবে মুখর সবুজ সুন্দর আমাদের প্রিয় পৃথিবীকে মহাবিপদের দিকে ঠেলে দিচ্ছে বিশ্বের তেল, গ্যাস, কয়লা আর সিমেন্ট উৎপাদনকারী ৫৭টি মেগা কোম্পানি। মানবসভ্যতাকে বিলুপ্তির ঝুঁকিতে ফেলছে। ২০১৬ সালে গ্রিনহাউজ নির্গমনকারী গ্যাস উৎপাদন কমাতে প্যারিস জলবায়ু চুক্তি সম্পাদনের পর গেল সাত বছর ধরেই এসব কোম্পানি তাদের অঙ্গীকার থেকে সরে এসে পৃথিবীকে ক্রমাগত বিপজ্জনক করে তুলছে। ফলে বিশ্ব উষ্ণায়নের মাত্রা বেড়েছে। তেঁতে উঠছে বিশ্ব। কোম্পানিগুলো যেসব দেশ পরিচালিত করে সেসব দেশেও দেখা দিচ্ছে অতি তাপমাত্রা, হিট ওয়েব, দাবানল। তবে এত কিছুর পরেও গ্রিন হাউজ নির্গমন থেকে সরে আসছে না কোম্পানিগুলো।
বৃহস্পতিবার (৪ এপ্রিল) দি গার্ডিয়ান পত্রিকা এ বিষয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
একটি গবেষণার উদ্ধৃতি দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৬ সালের প্যারিস জলবায়ু চুক্তির পর থেকে সাত বছর ধরে সরাসরি ৮০ ভাগ গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমন করে চলেছে চীন ও রাশিয়াসহ পশ্চিমাবিশ্বের তেল, গ্যাস, কয়লা এবং সিমেন্ট উৎপাদনকারী ৫৭টি প্রভাবশালী বহুজাতিক কোম্পানি। যারা জলবায়ু সংকট ও গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিয়েছে। একই সঙ্গে তারা প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিল, জীবাশ্ম জ্বালানি উৎপাদন ও ব্যবহার কমিয়ে নিয়ে আসবে।
তবে সেসব দেশ প্রতিশ্রুতি রক্ষা না করে গেল সাত বছরে ধরে গ্রিনহাউজ নির্গমন করে বিশ্বকে বিপজ্জনক অবস্থার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। বিশ্বের বৃহত্তম জলবায়ু দূষণকারী ১২২টি ডাটাবেজ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ৬৫ ভাগ রাষ্ট্রীয় সংস্থা আর বেসরকারি খাতের ৫৫ ভাগ বহুজাতিক কোম্পানি গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ করছে। আর এসব কোম্পানিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় বিনিয়োগকারী হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এক্সনমোবিল। কোম্পানিটি বিগত সাত বছরে ৩ দশমিক ৬ গিগাটন কার্বন-ডাই অক্সাইড নির্গমন করেছে। যা বিশ্বব্যাপী মোট নির্গমনের ১ দশমিক ৪ ভাগ। এই তালিকার শীর্ষে থাকা অন্য কোম্পানিগুলোর মধ্যে রয়েছে শেল, বিপি, শেভরন এবং টোটাল এনার্জি। যেসব কোম্পানির নির্গমনের পরিমাণ ছিল বৈশ্বিক নির্গমনের ১ ভাগ।
এক্ষেত্রে চমকে দেওয়া বিষয়টা হচ্ছে, আগে এশিয়ার দেশগুলো গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমনে পিছিয়ে থাকলেও গত সাত বছরে এগিয়ে এসেছে। কারণ, প্যারিস চুক্তি থেকে কঠোর বার্তা ছিল যে, বৈশ্বিক উষ্ণায়ন নিরাপদ সীমার মধ্যে রাখতে নতুন তেল ও গ্যাসক্ষেত্র খোলা যাবে না। জলবায়ু বিজ্ঞানীরা বলছেন, বৈশ্বিক তাপমাত্রা দ্রুত প্রাক-শিল্প যুগের তুলনায় ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখার প্যারিস লক্ষ্যমাত্রার কাছাকাছি। কার্বন মেজর ডেটাসেট প্রতিষ্ঠাকারী রিচার্ড হেইডে বলেন, এসব কোম্পানি যে কয়েক দশক ধরে কার্বন জ্বালানির অনুসন্ধান আর উৎপাদন করে চলেছে তা সত্যিই নৈতিকভাবে নিন্দনীয়।
শিল্প বিপ্লবের শুরু থেকে সমস্ত জীবাশ্ম জ্বালানি ও কার্বন-ডাই অক্সাইড নির্গমনের ৭২ ভাগের সঙ্গে জড়িত ১২২টি ডাটাবেজকে অন্তর্ভুক্ত করে। যার পরিমাণ এক হাজার ৪২১ গিগাটন। দীর্ঘমেয়াদি ডাকা বিশ্লেষণে দেখা গেছে, চীনা রাষ্ট্রীয় কয়লা উৎপাদন সবচেয়ে বেশি বৈশ্বিক ১৪ ভাগ কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমন করছে। যা দ্বিতীয় স্থানে থাকা সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের অনুপাতের দ্বিগুণেরও বেশি। আর তৃতীয় স্থানে থাকা সৌদি আরামকোর তুলনায় তিনগুণ বেশি।
শীর্ষে থাকা এসব কোম্পানির পরেই তালিকায় আসে মার্কিন মেগা কোম্পানি শেভরন যা ৩ ভাগ আর এক্সনমোবিল ২ দশমিক ৮ ভাগ। তালিকায় এর পরের অবস্থান রাশিয়ার গ্যাজপ্রম এবং ন্যাশনাল ইরানিয়ান অয়েল কোম্পানি। এরপরেই বিনিয়োগকারী-মালিকানাধীন ইউরোপীয় কোম্পানি বিপি এবং শেল (প্রতিটি ২ ভাগের বেশি)। শেষে থাকছে কোল ইন্ডিয়া। তবে সেই ২০১৬ থেকে গত বছরের তথ্যের সঙ্গে ঐতিহাসিক রেকর্ডের তুলনা করলে এশিয়ার একুশ শতকের উত্থান অনেক স্পষ্ট। সাম্প্রতিক চীনের কয়লার শেয়ার বৈশ্বিক কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমনের এক-চতুর্থাংশেরও বেশি। যেখানে সৌদি আরামকো প্রায় ৫ ভাগ।
এসব পরিসংখ্যা থেকে আগামীর ছবিটা আঁকা যেতে পারে। বিশ্ব মোড়ল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখন পর্যন্ত বিশ্বের বৃহত্তম তেল এবং গ্যাস উৎপাদনকারী দেশ। মার্কিন প্রেসিডেন্ট তেল, গ্যাস, কয়লার একাধিক নতুন অনুসন্ধান প্রকল্পের লাইসেন্স দিয়ে রেখেছেন। উপসাগরীয় দেশগুলোও তেল উৎপাদন বাড়ানোর পরিকল্পনা নিয়েছে। যদিও অনেক কোম্পানি নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে কিছুটা বিনিয়োগ করেছে। তবে সার্বিক এমন পরিস্থিতিতে আগামীতে গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমন কমানোর প্যারিস চুক্তি আইওয়াশ ছাড়া আর কী হতে পারে?