স্থাপত্যবিদ্যা ভূমিতে দাঁড়িয়ে থাকা মানব নির্মিত এক শিল্প। সে ভূমির সঙ্গে জলবায়ু ও ভূমিপুত্রদের চরিত্রের মিল থাকা অত্যাবশ্যক। কপি পেস্ট করেও অবশ্য কাজ চালানো যায়। তাতে স্থাপত্যবিদ্যা হয় প্রশ্নবিদ্ধ।
আমরা ঢাকার রমনায় ব্রিটিশ পিরিয়ডে নির্মিত কিছু দালান দেখি। যাতে শোভা পায় ফায়ারপ্লেসের চিমনি। কিন্তু আমাদের অঞ্চলে তো বরফ পড়ে না। দালানে ফায়ারপ্লেসের চিমনি অনেক নান্দনিকতা স্বত্ত্বেও এসব স্থাপত্য সম্পর্কে প্রশ্ন উত্থাপন করে।
এ তো গেল আগের আমলের কথা। এবার সমসময়ে চোখ রাখা যেতে পারে। ভূ-প্রকৃতি বিবেচনায় না রেখে নির্মাণ এখনো থেমে নেই। শহর এক কথায় হয়েছে কংক্রিটের বস্তি। আর উন্নয়নের নামে অবিবেচক নির্মাণে গোটা দেশও আক্রান্ত। একটু বেশি মাত্রার বৃষ্টিতে বন্যায় তলিয়ে যায় বিশাল জনপদ। এ পরিস্থিতিতে একজন নগর পরিকল্পনাবিদ ও স্থপতি মাজহারুল ইসলামের স্মরণ বিপদে দিশা দেখাতে পারে। ২০১২ সালের আজকের দিন ১৫ জুলাই ৮৮ বছর বয়সে তিনি প্রয়াত হন।
বাংলাদেশে আধুনিক স্থাপত্য চর্চার পথিকৃত মাজহারুল ইসলাম বলতেন, আমাদের দেশের স্থাপত্য হবে আমাদের প্রকৃতি, মানুষ ও সংস্কৃতির সাথে সম্পর্কিত। নিজের মাটিকে ভালোবাসাই একজন মানুষের স্থপতি হয়ে উঠার প্রথম বুনিয়াদ।
মাজহারুল ইসলাম তার কাজে এটি প্রমাণ করেছেন। তার নকশায় তৈরি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউট, ঢাবির লাইব্রেরি ভবন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাণিজ্য অনুষদ, বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ ভবন, মতিঝিলের জীবন বিমা ভবন, জাতীয় আর্কাইভ ভবন, ২০ তলা গার্ডেন সিটি প্রকল্প, রাজশাহী, বগুড়া, পাবনা, সিলেট ও বরিশালের পলিটেকনিক ইনিস্টিটিউটের ভবনগুলো। ঢাকার সড়ক গবেষণা পরীক্ষাগার, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের আবাসন প্রকল্প, চট্টগ্রাম ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার প্ল্যান সে সাক্ষ্যই দেয়।
এই মাজহারুল ইসলাম গ্রাহ্য হন উপনিবেশিক ধ্যান ধারণা বিযুক্ত প্রথম বাঙালি স্থপতিরূপে। তিনি তার শিক্ষক বিশ্ব বিখ্যাত স্থপতি লুই কানকে দিয়ে সংসদ ভবনসহ গোটা শেরে বাংলা নগর এলাকার ডিজাইন করান। এর জন্য তিনি কোনো অর্থ পর্যন্ত গ্রহণ করেননি। বিশ্বখ্যাত স্থপতি পল রুডলফকে দিয়ে মাজহারুল ইসলাম ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের নকশা করিয়েছিলেন।
মাজহারুল ইসলামের জন্ম ১৯২৩ সালের ২৫ ডিসেম্বর পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদে। তিনি কৃষ্ণনগর কলেজ স্কুলে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েন। এরপর তার বাবার বদলির চাকরির জন্য তাদের পরিবার চলে আসেন রাজশাহী। তার পড়াশোনা শুরু হয় রাজশাহী কলেজ স্কুলে। এখান থেকে তিনি ম্যাট্রিক পাশ করেন। পরে ভর্তি হন রাজশাহী কলেজে। রাজশাহী কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক শেষে তিনি রাজশাহী কলেজেই পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগে অনার্সে ভর্তি হন। এ কলেজে ভর্তি হওয়ার আগে তিনি পরীক্ষা দিয়েছিলেন ভারতের বিখ্যাত শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে। সুযোগও পেয়ে যান সেখানে অধ্যায়নের। ১৯৪৬ সালে শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে তিনি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া শেষ করেন।
ভারতভাগের পরে সহকারি প্রকৌশলী হিসেবে সরকারি চাকরিতে যোগ দেন মাজহারুল ইসলাম। ১৯৫০ সালে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অরিগান বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপত্য নিয়ে পড়তে চলে যান। আড়াই বছর স্থাপত্যবিদ্যায় পড়াশোনার পর তিনি প্রথম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হন। আমেরিকায় তার জন্য ছিল মোটা বেতনের চাকরি। কিন্তু পড়া শেষে তিনি দেশে ফিরে আসেন। ১৯৫৬ সালে বৃত্তি নিয়ে মাজহারুল ইসলাম ট্রপিক্যাল আর্কিটেকচার বিষয়ে পড়তে চলে যান লন্ডনের এএ স্কুল অব আর্কিটেকচারে। ১৯৬০ সালে আবার যান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। এবার ভর্তি হন ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে বিশ্বখ্যাত স্থপতি পল রুডলফ-এর অধীনে তিনি মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। অনেক প্রলোভন উপেক্ষা করে আবার ফেরেন দেশে।
১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে মাজহারুল ইসলাম প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ছিলেন। তিনি কলকাতায় ন্যাপের কাজকর্মের নেতৃত্ব দিতেন। ভূমিকা রাখেন বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গঠনে। স্বাধীন দেশেও সংগ্রাম বিযুক্ত ছিলেন না এই মানুষটি। দেশের প্রতিটি প্রগতিশীল আন্দোলন ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে তিনি ছিলেন অগ্রসর। ১৯৯০ সালে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের সাথে যুদ্ধাপরাধী এবং মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ নেতা গোলাম আযমের প্রতীকী বিচারের দাবিতে গড়ে ওঠা গণ আদালতের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন স্থপতি মাজহারুল ইসলাম।
স্থপতি মাজহারুল ইসলাম তার কাজের জন্য বহু জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পুরষ্কার ও পদকে ভূষিত হয়েছেন। বিশ্বের বহু দেশে তার কাজ নিয়ে প্রদর্শনী হয়েছে। দেশখ্যাত স্থপতি ও চলচ্চিত্র নির্মাতা এনামুল করিম নির্ঝর এই কীর্তিমানকে নিয়ে “তিনি”নামে প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেছেন। তাতেও উঠে এসেছে মাজহারুল ইসলামের দেশ ও জন্মভূমিকে ভালোবাসার বিরলতম নিদর্শন।
প্রয়াণ দিবসে এই মৃত্তিকানিষ্ঠ গর্বের বাঙালি মাজহারুল ইসলামের প্রতি অনন্ত শ্রদ্ধা!