এই লেখাটা যখন লিখতে বসেছি ঠিক তখনি আমার পরিচিত একজন ৪৫ বছর বয়সী লোক এক কিশোরী মেয়েকে বিয়ে করছে, যার বয়স ১৮ বছর। এবং সে নিজে দুই বাচ্চার জনক। না, ব্যাপারটা আমাদের সমাজে হয়তো কঠিন না, হারহামেশাই ঘটছে এসব বিয়েপার্বণ। বরং দেখা যায় যত বয়স যত টাক তত টাকা ধর্মে বিশ্বাসী আমাদের সমাজের লোকজন। তাই টাকার কাছে মেয়ের বাকি সব সম্বল গচ্ছিত দিয়ে হলেও এই সমাজের বাবা-মায়েরা মেয়েদের এমন পাত্রস্থ করে সুখ অনুভব করে। বাংলাদেশের বিধান অনুযায়ী এমন কোনো আইনও নেই যে কত বছর বয়সী ছেলে কত বছর বয়সী মেয়েকে বিয়ে করবে। হ্যাঁ, তবে সামাজিক দৃষ্টিকটু বলে একটা ব্যাপার তো আছেই বটে। স্বজ্ঞানে স্বইচ্ছায় দুটো মানুষ একত্রে হতেই পারে।
কিন্তু একবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে এটা এতটাও সহজ ছিল না যদি সেটা সামাজিক রীতিনীতি বজায় রেখে ও পারিবারিকভাবে না হয়। এটাই আবার সহজ ছিল যদি পারিবারিকভাবে বিয়েটা দেয়া হয়। ধীরে ধীরে সব আইনের শিথিলতা চলে আসে এবং গ্রহণযোগ্যতা পায়।
পাঠকেরা জানেন যে এই একটি নির্দিষ্ট কারণ নিয়ে ঠিক কতটা গঞ্জনার মুখোমুখি হতে হয়েছে ঔপন্যাসিক, গীতিকার ও চলচ্চিত্র নির্মাতা হুমায়ূন আহমেদকে। সেসময় আপু সমাজের মধ্যেও এই নেগলেন্সি দেখা গেছে। আড্ডার এক মুখরোচক আলাপ যেনো কতসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ।
তেমনি আবার উলটো চিত্রটার ঔজ্জ্বল্য যেনো বেশিই ছিল। সেই ১৯ জুলাই, ২০১২। তখন আমি কেবল এসএসসি পরীক্ষায় বসব। তার জন্য দিনরাত একাকার করে পড়ছি। যেনো কোনোদিকে একটু সময় ক্ষেপণ করা চলবে না। এরমধ্যে সারা দেশে খবর হলো কথার জাদুকর “হুমায়ূন আহমেদ’ নিউইয়র্কের ম্যানহাটনের বেলেভ্যু হাসপাতালে মারা গেছেন। কী এক শোকের মাতম পুরো দেশ জুড়ে। যেনো এক একান্ত স্বজন চলে গেছেন আমাদের ছেড়ে। দমকে দমকে প্রোথিত হচ্ছে হুমায়ূনপ্রেমীদের কান্না। কেউ প্রিয় কদম ফুলে ছিঁড়ে এনেছেন জাদুকরকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে। কেউবা এনেছে ছাদবাগানের গোলাপ ছিঁড়ে। খুব প্রিয় নীল শাড়ি আর হলুদ পাঞ্জাবি পড়ে এসেছে অধিকাংশ লোকজন। কেউবা লম্বা লম্বা লাইন ধরে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে অপেক্ষা করছে কখন আসবে লাশবাহী বিমানটি। সব বাসার টিভিতে একই ব্রেকিং নিউজ যেনো বেজে চলছে। থমথমে মুখ গোমরা এক সকাল গড়িয়ে যাচ্ছে দুপুরের দিকে। বিল্ডিং লাগোয়া অন্যান্য বাসার টিভি স্ক্রিন থেকে ঝলসে উঠছে জাদুশিল্পীর মুখ। আশ্চর্যের ব্যাপার কারো বাসার টিভি চ্যানেলই চেঞ্জ করছে না কেউ। পুরো শহর এক গভীর শোকে মুহ্যমান। আমার বড় বোন তখন ইডেন কলেজের ছাত্রী। সে মাস্টার হিসেবে খুব ভালো। তার এক ছোট ছাত্রের কথা বলি—
সেদিন হঠাৎ সে কান্না করতে করতে বন্ধুর বাসা থেকে দৌড়ে এসেছে। এসে বলছে ‘মা, হুমায়ূন মারা গেছে।’ বলে এসে কি কান্না! দমকে দমকে কাঁদছে ছেলেটা। সে যেন ওর কত চেনা! এসে বলছে ‘হুমায়ূন’। ভাবছি ও কী করে বুঝল দেশ এক প্রিয় সাহিত্যিক হারানোর শোকে বিহ্বল হয়ে আছে?
আমি অগত্যা বই খুলে বসে আছি। টপটপ করে কান্না ঝরে পড়ছে আর বেজে চলছে তাঁর লেখা আমার খুব প্রিয় গান-
‘এখন খেলা থেমে গেছে মুছে গেছে রং
অনেক দূরে বাজছে ঘণ্টা ঢং ঢং ঢং
এখন যাব অচিন দেশে, অচিন কোন গায়
চন্দ্রকারিগরের কাছে ধবল পঙ্খী নায়।’
এইসব ভালোবাসা তো মিছে কিছু নয়। এই ভালোবাসার প্রকাশ একযোগে সারা দেশে ফুটে ওঠে তার মৃত্যুতে।
বলা হয়ে থাকে এই কথাশিল্পীই এক বিশাল পাঠক সমাজকে অদ্ভুত সম্মোহনী শক্তি দ্বারা বেঁধে রেখেছিল অনেকটা সময়। এই শিল্পীর সাথে আমার প্রথম পরিচয় ঘটে যখন তখন আমি অনেক ছোট। মাত্র দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ি। পারিবারিক আবহে আমি বেড়ে উঠেছি সারাদিন মুখ গুজে পড়তে বসে থাকা পরিবেশ নিয়ে। সে সুবাদে বাড়িতে অনেক বইপত্তর পেয়েছি ছোট থেকেই। কিন্তু ওই যে মধ্যবিত্তের মানসিক টানাপোড়ন সেটাও তো ছিল এত বইপত্রের ভিড়েও। পাঠ্য বই ব্যতীত অন্যান্য বই পড়ার অনুমতি মিলত না সব সময়। কাজেই খানিকটা কৌশল অবলম্বন করেই সাহিত্য সখ্যতার চর্চা অব্যাহত রাখতে হয়েছে সে সময়গুলোতে।
স্কুল ফেরত হঠাৎ একটা বই চোখে পড়ে আমার। নামটা একটু অন্যরকম মনে হতে থাকে আমার কাছে। ‘আমার আছে জল’। ভাবলাম বইটার এমন নামকরণ হওয়ার স্বার্থকতা কী? আরেকটা বিষয়—বয়স বা ক্লাসের তুলনায় অনেক ছোটবেলাতেই আমি সব ধরনের সাহিত্যের বই পড়েছি হাতের নাগালে যা-ই পেয়েছি। তো সেই মানুসিকতার জায়গা থেকে মনে হলো এই বইয়ের নামকরণের বিষয়বস্তুটা পড়তেই হবে। স্বভাবতই খুব সংবেদনশীল মানুষ আমি। অন্যের দুঃখ কষ্টে সহজেই কান্নায় বুক ভারী হয়ে ওঠে আমার। আমার আছে জল পড়ার সময়েও এর ব্যত্যয় ঘটেনি। নিশাত আর দিলশাতের জন্য মনটা কেমন করে উঠেছে। লুকিয়ে লুকিয়ে বই পড়া যায়, কিন্তু কান্না লুকানো যায় না।
বই পড়তে পড়তে হুট করে আম্মা যখন চলে আসতো তখন বইটা লুকিয়ে ফেলতাম। মনে আছে সোফার নিচে বেশি লুকোতাম। অনেক আগ্রহ নিয়ে,উত্তেজনা নিয়ে পড়তাম। শুধু ভাবতাম তারপর কী হবে, তারপরে কী? শেষের দিকে এসে খুব কান্না পেত। টপটপ করে জল পড়ে বইয়ের পাতা ভিজে যেত। কাঁদতে গিয়ে আম্মার কাছে ধরে খেয়ে যেতাম। তখন বাস্তব-অবাস্তব, সাহিত্য এসবের আর কীইবা বুঝতাম! সবই চরম সত্য হয়ে ধরা দিত তখন। কিন্তু বইয়ের শেষের কয়েকটা পাতা না থাকায় জলভরতি চোখ নিয়ে মেয়েটা কী সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তা অনেকদিন অব্ধি জানা হয়নি। একেকটা সময় আমার মত করে একেক রকমের সমাপ্তি কল্পনা করতাম। অনেক দিন পর এসে জেনেছি নাটকে সিনেমায়, দিলু তার প্রিয় লাল স্কার্ট পানিতে ভেসে উঠেছে। সংবেদনশীল মন আমার দিলুর আত্মহননে আমিও একদিন লাল একটা স্কার্ট পড়ে আমাদের পুকুরে দীর্ঘক্ষণ বসে থেকে ভেবেছি দিলুর মনটা কেমন করছিল ভেসে ওঠার আগ মুহূর্তে?
এরপর আরেকটু বড় হয়ে যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডিতে পা দিয়েছি তখন দেখলাম হুমায়ূন আহমেদের ‘কোথাও কেউ নেই’। আমার মন খারাপ হলে তার গান শুনতাম, নাটক, সিনেমা দেখতাম। আমার নানাভাইয়ের পছন্দের সিনেমা ছিল শ্রাবণ মেঘের দিন। ছোটবেলায় দেখেছি বারী সিদ্দিকীর ‘সোয়া চাঁন পাখি’ গানটা ছেলেমেয়েরা মুখেমুখে গাইত আর মেহের আফরোজ শাওন অভিনীত শ্রাবণ মেঘের দিন সিনেমার কাহিনি জনে জনে ঘুরত।
একদিন কোনো এক অজানা কারণে মনটা ভীষণ খারাপ। তখন হলে থাকি। রাতে ঘুম আসছে না। ভাবলাম হুমায়ূন আহমেদের নাটক দেখব ঘুম না আসা পর্যন্ত। রুমমেটরা তখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। আমি কোথাও কেউ নেই-এর এক একটা পর্ব দেখি আর রাতের সমস্ত চরাচরের কান্না এসে আমার গলায় জমতে থাকে। জানি না, কোথাও হয়তো মুনাদের জীবনের সাথে একই ফল্গুধারায় মিলে গেছে আমাদের জীবনের বেদনা আর ক্লান্তি। জীবন থেকেই উৎসরিত হয় সিনেমা। আবার সিনেমাই আমাদের আনন্দ-বেদনার মর্মস্থলে নিয়ে ভাসিয়ে দেয়। তখন আর মুনা এবং বাকের ভাইয়ের কষ্ট নিজের কষ্টের থেকে আলাদা কিছু মনে হয় না। যুগে যুগে একই মানব সত্ত্বা আমরা। তাই বুঝি যে কারো বেদনাও আমাদের এসে নাড়িয়ে দেয় অদ্ভুতভাবে।
অনেকে একে হাস্যরসাত্মকধর্মী নাটক বললেও এটি মূলত প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থার কালো অধ্যায়ের স্বরূপ তুলে ধরে। সবকিছু হারিয়েও জীবনের পথে এগিয়ে যাবার সম্যক আহবান দেয়। সমাজের ওপরের তলার মানুষদের সুসজ্জিত বেডরুমের চিত্র প্রদর্শিত করে।
আজ দীর্ঘ বারো বছর পেরিয়ে গেছে আমাদের সাহিত্যক চলে গেছেন। তার সৃষ্টিকর্ম যা আমাদের জীবনের শিক্ষা দেয় তা বেঁচে থাকুক পাঠককুলের চর্চায়।