আমাকে নিয়ে নানা গল্প আছে
সেই গল্পে আছে একটা ফাঁকি
বিরাট একটা বৃত্ত এঁকে নিয়ে
ভেতরে নাকি আমি বসে থাকি।
কেউ জানে না শাওন, তোমাকে বলি
বৃত্ত আমার মজার একটা খেলা
বৃত্ত-কেন্দ্রে কেউ নেই, কেউ নেই
আমি বাস করি বৃত্তের বাইরেই।
: হুমায়ূন আহমেদ, মেহের আফরোজ শাওনকে লেখা চিরকুট, বলপয়েন্ট
বৃত্ত বা বৃত্তের বাইরে কোথাও তিনি নেই। স্রেফ নেই। তার এই না থাকার ১১ বছরে নতুন বই আসেনি। দেখা যায়নি তার চলচ্চিত্র বা নাটক। পত্রিকায় সাড়া ফেলা তার লিখিত কলামও আছে বন্ধ। অমর একুশে গ্রন্থমেলা প্রাঙ্গণের প্রতিটি ধূলিকণার হাহাকার যেন তার জন্য। অদেখা ভুবনে থাকা হুমায়ূনের কেমন লাগছে এ ক্ষণ? এ প্রশ্নের উত্তর কোথা পাই?
বই আর গল্প দুটি ভিন্ন বিষয়। কাগজ, ছাপাখানা আবিষ্কারের বহু আগে গল্প ছিল। গল্পে ভর করেই মানুষ মানুষ হয়ে উঠেছে। শিকার শেষে, আহার শেষে, আনন্দে একাত্ম হওয়ার মুহূর্ত শেষে। প্রথম আগুন জ্বালাতে শেখার ক্ষণে গল্প ছিল। নিজের বোনা ফসলের মুখ দেখেও মানুষ গল্প বলেছে।
গল্প মানুষ হারায়নি তখনো, যখন সে শোকস্তব্ধ হয়েছে। গলার কাছে অজানা কিছু আটকে থাকা মুহূর্ত মানা যায় না। তখনো আবার গল্পে ফেরা, ধাতস্থ হওয়া। বইয়ের মলাটে গল্পবন্দীর হাজারও বছর আগে এমন গল্প ছিল। সমুদ্র, পর্বত অথবা ক্ষমতার রক্তচক্ষু সব প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে এ গল্প বিস্তৃত হয়েছে বিশ্বময়। মুখ থেকে মুখে অবিরাম।
পৃথিবী যখন আগের সময় পেরিয়ে এসেছে বলে ধারণা করা হয়, তখন হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন অনেকটা আদি স্বভাবের ধারক। মুখে মুখেই হুমায়ূনকে নিয়ে গল্পের প্রচলন হয়েছে। আর লেখা সব গল্পের চেয়ে ব্যক্তি হুমায়ূন নিজেই রূপ নিয়েছেন সেরা গল্পে। নন্দিত নরকের লিখিয়ে হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার প্রায় ৫০ বছর পরও তুমুলরকম কৌতূহল চলে তাকে নিয়ে। মৃত্যুতেও বিনাশ হয়নি যার এতটুকু।
গল্প কি পড়া হচ্ছে, নাকি কেউ বলছে পাশে বসে? ঠাহর করার উপায় নেই এর। বাংলায় কখনো ছিল না, এমন গদ্যের জনক তিনি। লেখনী এমন মাত্রায় পৌঁছানো আসলে যেকোনো ভাষার জন্যই এক ঘটনা। তার বই দিয়ে পাঠে অভ্যস্ত হয়েছে সাম্প্রতিক সময়ের পাঠকদের বড় একটি অংশ।
গল্প বলা তার নখদর্পণে ছিলই। এমন ভাষা, তা প্রকাশের পর কেন জনপ্রিয় হবে না? পাঠকরাও তাই লুফে নিয়েছেন তাকে। সাহিত্য যে এমন হতে পারে বাংলা পাঠকদের জানা ছিল না। একইরকম অজ্ঞাত ছিল বই বাজারসম্পর্কিত ধারণাও। বই যে কাটতিসম্পন্ন একটি পণ্য, বাংলা ভাষায় নিয়োজিত প্রকাশনা শিল্পে রতদের তা অজানা ছিল।
আশির দশকের শুরু থেকে বইমেলায় হুমায়ূন আহমেদের বই বেস্ট সেলার। যে ঘরে কোনো বই নেই, সে ঘরেও একটি হুমায়ূনের বই থাকে। যে কখনো বই কেনে না, সেও একটি বই কেনার জন্য ফেব্রুয়ারির মেলায় আসে। যেমন চলচ্চিত্র তারকাদের বেলায় ঘটে, তেমন ঘটত বইমেলায় হুমায়ূনকে নিয়ে। হাজারও পাঠকের উৎকণ্ঠা, তার অটোগ্রাফসংবলিত বইয়ের জন্য। মেলার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির পারদ ওঠানামা করত হুমায়ূনের বইমেলায় আসা না আসার ওপর। শুধু বাংলাদেশ নয়। একই চিত্র কলকাতা বইমেলায়। প্রবাসে যে দেশেই বই বিক্রির স্থানে হুমায়ূন হাজির হয়েছেন, সেখানে। বাংলা ভাষার সীমানা একা নিজেই হয়ে উঠেছিলেন এই লেখক। দেশের প্রকাশনা শিল্প নান্দনিকতা পেয়েছে তাকে ঘিরে। হুমায়ূন হয়তো এসব নিয়ে ভাবিত ছিলেন না। শুধু তার লেখনীর সামর্থ্যেই বাংলাভাষী প্রতিবেশী লেখকরা এ দেশের বইয়ের বাজারে সুবিধা করতে পারেনি। ভালো গল্পের সামনে বাজে গল্প মার খেয়েছে মাত্র। কোনো বিশেষ দেশবিরোধী স্লোগান হুমায়ূনকে আওড়াতে হয়নি কখনোই।
না থাকার এই ১১ বছরে হুমায়ূন যেন আরও অপ্রতিরোধ্য। প্রকাশনা শিল্পে রতরা জানাচ্ছেন, আরও বিক্রি বেড়েছে তার বইয়ের। শুধু হুমায়ূন আহমেদের বই নয়। তাকে নিয়ে, তার ওপর ভিত্তি করে প্রায় ৩০০ টি বই প্রকাশিত হয়েছে এ পর্যন্ত। বহু বিশ্ববিদ্যালয়ে সাহিত্য পড়ুয়ারা পিএইচডি করছেন এই জাদুকরকে নিয়ে।
না থাকলে পরাণ বেশি পোড়ে। হুমায়ূনহীনতা এ সত্যকেই প্রতিষ্ঠিত করে চলেছে আজকের দিন পর্যন্ত।