মনে করি আসাম যাবো
আসাম গেলে তোমায় পাবো
বাবু বলে কাম কাম, সাহেব বলে ধরে আন
আর ওই সর্দার বলে লিবো পিঠের চাম
হে যদুরাম, ফাঁকি দিয়া চলাইলি আসাম।
(আসামের লোকগীতি)
ভুলে থাকি আমাদের চুমুকে চুমুকে আর্তনাদ। আর তা গলা বেয়ে না নামলে সকাল, বিকেল, মধ্যরাত জমে না। আজ ২০ মে মনে করায় চা-শ্রমিকদের ওপর চালানো ঔপনিবেশিক শাসকদের নির্মমতম গণহত্যা। ‘মুল্লুকে চলো আন্দোলন’ দমনের শতবর্ষ পেরিয়ে আমরা।
মোহন রবিদাস লিখিত এক নিবন্ধে জানতে পাই, ১৬১০ সালে প্রথম ভারতবর্ষে চীন থেকে চা আমদানি শুরু করে ওলন্দাজ বণিকরা। ইংরেজ বণিকরাও প্রথম দিকে চা আমদানি করত চীন থেকে। চীন-জাপান যুদ্ধের কারণে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক অবনতি হলে আমদানি বন্ধ হয়ে যায়। তখন বিকল্প চা উৎপাদনের জন্য ভারতবর্ষের ওপর ইংরেজদের নজর পড়ে। শুরু হয় বাগান তৈরির কাজ। ১৮৩৫ সালে বিজ্ঞানীদের নিয়ে একটি কমিশন গঠন করা হয়। তার নাম ‘রয়্যাল সোসাইটি’। ভারতবর্ষে চা উৎপাদনের জন্য অধিকতর অনুসন্ধান করাই ছিল এই কমিশনের কাজ। এই কমিটি কাজ শুরু করার আগেই শিলচর এবং করিমগঞ্জে চা-গাছের সন্ধান পাওয়া যায়। সে বছরই প্রথম চীনের বাইরে বাণিজ্যিকভাবে চা-এর উৎপাদন কার্যক্রম শুরু হয়। ১৮৩৮ সালে সিলেট ও কাছাড়ে পরীক্ষামূলকভাবে চা উৎপাদন শুরু হয়। ভারতবর্ষে আসামের লখিমপুরে, সিলেট ও কাছাড় জেলায় চা-এর উৎপাদন ব্যাপকতা পায়।
চা-শিল্প একটি শ্রমঘন শিল্প। এর বাগান গড়ে তুলতে প্রচুর শ্রমিক লাগে। পাহাড়ি জঙ্গল পরিষ্কার করা, রাস্তাঘাট নির্মাণ, গৃহ নির্মাণ করা প্রাথমিক কাজ। তাছাড়া দ্রুত বর্ধনশীল আগাছা নিয়মিত পরিষ্কার করতে দরকার হয় অনেক শ্রমিক। সেই সময়ে আসামের সব প্রাপ্তবয়স্ক লোক দিয়েও এ চাহিদা মেটানো সম্ভব ছিল না। এ ছাড়া আসাম বা সিলেটের মানুষ চা-বাগানে কাজ করতে অনাগ্রহী ছিল।
ইংরেজ বণিকরা তখন মিথ্যার নীলনকশা বিস্তৃত করে। মানুষের মধ্যে ‘গাছ হিলায়ে গা তো পাইসা মিলেগা’ বা ‘গাছ নাড়লে টাকা মিলবে’ কথা প্রচার করতে থাকে। আজীবন কাজের শর্তে চুক্তিবদ্ধ করে ভারতের বিহার, মাদ্রাজ, উত্তর প্রদেশ, ওড়িশা প্রভৃতি অঞ্চল থেকে কানু, তেলেগু, লোহার, রবিদাস, গোয়ালাসহ প্রায় ১১৬টি আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে চা-বাগানের শ্রমিক হিসেবে সংগ্রহ করে।
কিন্তু চা-শ্রমিকরা এ অঞ্চলে এসে দেখে, গাছ নাড়লে টাকা পাওয়া তো দূরের কথা; হিংস্র জীবজন্তুর প্রতিকূল পাহাড়-জঙ্গলময় পরিবেশে নিজের জীবন বাঁচানোই দুঃসাধ্য। অনাহারে-অর্ধাহারে, অসুখে-বিসুখে এক বীভৎস জীবনের সম্মুখীন হয় তারা।
অসহায় শ্রমিকদের ওপর নির্যাতন শুরু তখন থেকে। কোনো শ্রমিক ইচ্ছা করলেই চাকরি থেকে ইস্তফা দিতে পারত না। বাগান থেকে পালিয়ে গেলে তাদের ধরে আনা হতো। দেওয়া হতো অমানবিক শাস্তি। যা অপরাধ হিসেবেও গণ্য হতো না। চাবুক-বুটের-লাথি ছিল এই নিরীহ মানুষগুলোর ওপর নিত্যনৈমিত্তিক নিপীড়ন। এভাবে মালিকদের হাতে শ্রমিকের মৃত্যুকেও সাধারণ ঘটনা হিসেবে দেখা হতো। মালিকদের কথাই সেখানে রাষ্ট্রীয় আদেশ হিসেবে গণ্য হতো। শ্রমিকদের ইচ্ছা-অনিচ্ছা বলতে কোনো কিছু কল্পনাই করা যেত না। বাগানের ভেতরে ছাতা মাথায় হাঁটাও অপরাধ হিসেবে গণ্য হতো। পুরুষ শ্রমিকদের বেতন চার আনা, নারীদের তিন আনা এবং শিশুদের দুই আনা। তখন চা-বাগানে শিশুশ্রম বৈধ ছিল (যা এখনো আছে)।
ফেলে আসা দাস যুগ যেন ইংরেজদের হাতে আবার শুরু হয়। জাহাজ ভর্তি করে তারা চা-শ্রমিক নামে নব্য দাসদের নিয়ে আসতে থাকে। কাতারে কাতারে মানুষ তখন জাহাজে মারা যেত। যখন তা খালাস করা হতো, তখন অর্ধেক নামত জীবন্ত আর অর্ধেক লাশ হয়ে। রোগ বিস্তারের অজুহাতে লাশগুলো ফেলে দেওয়া হতো পানিতে। শ্রমিকরা দেখত তাদের চোখের সামনেই সৎকারবিহীন ভাই, বাবা, চাচা, বন্ধু, স্বজনদের লাশ পানিতে ফেলা হচ্ছে ঝুপঝাপ শব্দ করে। তখনের এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, চা চাষের জন্য ১৮৬৩-১৮৬৬ সালে এ অঞ্চলে ৮৪ হাজার ৯১৫ শ্রমিক আনা হয়, যার মধ্যে অনাহারে-অর্ধাহারে, অসুখে-বিসুখে ৩০ হাজার শ্রমিক মারা যান।
১৯১১ সালে আসামের সরকার সে অঞ্চলের প্রধান চা-বাগানগুলোর শ্রমিকদের অবস্থা নিয়ে একটি প্রতিবেদন পেশ করে। সেখানে বলা হয়, ‘বাগান কর্তৃপক্ষ শ্রমিকদের সঙ্গে মধ্যযুগীয় ভূমিদাসদের মতো আচরণ করে।’
১৯২০ সালের দিকে পরিস্থিতি বদলাতে থাকে। এর পরের বছর ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন ও গণজাগরণ চা-শ্রমিকদের অনুপ্রাণিত করে। চরাঞ্চলের চা-শ্রমিকরা ঐক্যবদ্ধভাবে বিদ্রোহ ঘোষণা করে চা-বাগান থেকে বের হয়ে স্ত্রী, সন্তান, পরিজন নিয়ে রেলপথ ধরে হাঁটতে থাকে।
সিলেট ও কাছাড়ের প্রায় ৩০ হাজার চা-শ্রমিক এ অন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। তাদের দাবি ছিল তারা ইংরেজ মালিকদের অধীন কাজ করবে না। তাদের নিজের আবাসভূমিতে (মুল্লুকে) ফিরে যাবে। ১৯২১ সালের ৩ মার্চ অনিপুর চা-বাগান থেকে ৭৫০ জন শ্রমিক বেরিয়ে আসেন। এভাবে দলে দলে শ্রমিকরা বাগান থেকে বের হতে থাকেন। উদ্দেশ্য একটাই—নিজের মুল্লুকে ফিরে যাওয়া। সে সময়কার অসহযোগ আন্দোলন তাদের পুরোনো গ্রামের সেই কথা আবার মনে করিয়ে দেয়। চা-শ্রমিকরা বুঝতে পারেন, চা-মালিকরা প্রতারণা করে তাদের জঙ্গলে বন্দী করে রেখেছে। সোনালি অতীতে ফিরে যাওয়ার বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস তারা অনুভব করে। কোনো চিন্তা না করে বেরিয়ে যায় মাথা গোঁজার ঠাঁই ছেড়ে। কীভাবে যাবে, কী খাবে—এসব চিন্তা তাদের একটিবারের জন্যও থামাতে পারেনি। তারা বেরিয়ে পড়ে অজানা গন্তব্যে।
বন্দিজীবনের কারণে শ্রমিকদের কাছে বাইরের পৃথিবী ছিল অজানা। এই অপরিচিত জগতে তারা বেরিয়ে আসে স্ত্রী, পুত্র, কন্যার হাত ধরে। কীভাবে যাবে? রাস্তাঘাট চিনবে কী করে? তারা তো শুধু চেনে চাঁদপুর জাহাজঘাট। সেখানে যেতে পারলেই জাহাজে চড়ে বাড়ি ফেরা যাবে। জাহাজঘাট যাবে কী করে? সবাই জড়ো হতে থাকে রেলস্টেশনে। বিভিন্ন প্রান্ত থেকে রেললাইন ধরেই হাঁটা শুরু করেন চা-শ্রমিকরা। সবার গন্তব্য চাঁদপুর জাহাজঘাট। এই আন্দোলন ‘মুল্লুকে চলো’ আন্দোলন হিসেবে পরিচিতি পায়।
১৯২১ সালের ২০ মে রাতের অন্ধকারে গুর্খা রেজিমেন্টের সৈন্যরা চাঁদপুরের রেলওয়ে ইয়ার্ড ঘিরে ফেলে। সরকারপক্ষ থেকে নিষিদ্ধ এলাকায় কোনো লোকজনকে যেতে নিষেধ করা হয়। সরলপ্রাণ ক্লান্ত শ্রমিকরা গণহত্যার কৌশল বুঝতে পারেননি। গভীর রাতে সবাই যখন ঘুমে অচেতন, কমিশনার কে সি দের নির্দেশে গুর্খা সৈন্যরা ঘুমন্ত শ্রমিকদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। গুলিতে, বেয়নেটে তারা শ্রমিকদের হত্যা শুরু করে নির্বিচারে। আর্তচিৎকারে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। রাতের অন্ধকারে অনেক লাশ গুম করে ফেলে গুর্খা বাহিনী। হাজার হাজার চা-শ্রমিককে পেট কেটে মেঘনা নদীতে ভাসিয়ে দেয়। চা-শ্রমিকদের রক্তে রঞ্জিত হয় মেঘনা নদীর পানি। কত মানুষ সে রাতে খুন হন এর কোনো সঠিক হিসাব নেই। মুল্লুকে আর ফেরা হয় না চা-শ্রমিকদের।
এখন চাঁদপুর পৌরসভার মূল হেড বড় স্টেশন এলাকাটি শত বছর ধরে চা-শ্রমিকদের ওপর নিপীড়নের সাক্ষ্য দিচ্ছে। কিন্তু চা-শ্রমিকদের সেই আন্দোলনের কোনো স্মৃতিচিহ্ন নেই। জেলা প্রশাসনের কাছে সেই ঘটনার নথিও নেই। ২০১৬ সালে জেলা প্রশাসনের প্রকাশ করা ‘চাঁদপুর পরিক্রমা: ইতিহাস ও ঐতিহ্য’ বইতে এ ঘটনার কোনো উল্লেখ নেই।
এখন চা-শিল্প দেশের গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক খাত। এক শতকে বাগানে উপনিবেশ আমলের সেই পরিবেশ পাল্টেছে। বাংলাদেশে প্রতি দশকে বেড়েছে চায়ের উৎপাদন। বাংলাদেশ টি বোর্ডের হিসাবে, স্বাধীনতার পর দেশের চায়ের উৎপাদন ছিল ২ কোটি ৩০ লাখ কেজি। ২০২০ সালে দেশের ১৬৭টি চা-বাগান থেকে উৎপাদিত হয়েছে ৮ কোটি ৬৩ লাখ কেজি চা। দেশে চা-শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় সোয়া লাখ। কিন্তু আজ এত বছর পর তাদের জীবনে উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি।
দুরবস্থা কোনো নিয়তি নয়। মানুষের সক্রিয়তায় তা বদলায়। সেই সঙ্গে চা-শ্রমিকদের ওপর নিপীড়নের ইতিহাস মুছে দেয়া অসাধ্য। ‘মুল্লুকে চলো’র কাফেলা নিজ ভূমে ফেরায়নি চা-শ্রমিকদের। কিন্তু এর জুলুম বিরোধী লড়াইয়ের স্পৃহা ভবিষ্যতের পথ দেখায়। সব প্রতিরোধে তা দৃষ্টান্ত হয়ে সাহসে বুক ভরায়।