প্রিয় এর্নেস্তা, আজ আপনার জন্মদিন। আর তা পালিত হচ্ছে তুমুলভাবে। যদিও ৫৬ বছর হয়ে গেছে আপনার অনন্তলোক যাত্রার।
জীবনটা ছিল আপনার মাত্র ৩৯ বছরের। বন্ধু ফিদেলের ভাষায় আপনি ‘অস্থির’ হয়ে পড়েছিলেন। বলিভিয়ার লা হিগুয়েরার স্কুলঘরে সার্জেন্ট মারিও টেরেন আপনার কথা শুনেছিল ঠিকঠাক। সে রাইফেল হাতে বন্দী আপনার সামনে দাঁড়িয়ে থর থর করে কাঁপছিল। আপনি তখন বলে ওঠেন, “গুলি করো কাপুরুষ। বিপ্লবের মৃত্যু নেই।” সাতটি বুলেটের শব্দ শোনা যায় এরপর।
বহু কিছু হলো তখনের পর থেকে। সবচেয়ে বেশি হলো এবং হচ্ছে ব্যবসা। শহীদ বিপ্লবীর ছবি লেপ্টে মদের বোতল হলো। যৌনতার বণিকেরা নারীর বিকিনি বানালো। আর পোস্টার, টি-শার্ট তো হচ্ছে দেদারসে। বিপ্লবের চকলেট বয় মানে যেন আপনি।
কিউবার বিপ্লবী সরকারের শিল্পমন্ত্রী ছিলেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গর্ভনরের দায়িত্বও সামলেছেন। আপনার নামে তো বহু কিছু করবেই লোকেরা। বিশেষত দালালেরা। যাদের ধারণাই নেই আপনার লেখা ‘ফিদেলের জন্য গান’ কবিতার সেই লাইন।
. . .“ যখন তোমার কণ্ঠস্বর বাতাসকে করবে চার ফালি–
ভূমি সংস্কার, সুবিচার, রুটি, স্বাধীনতা
তখন সেখানে আমরাও
তোমার পাশে থাকব,
আমাদের কণ্ঠে ধ্বনিত হবে–
একই উচ্চারণ।
দিনের শেষে
অত্যাচারীর বিরুদ্ধে অভিযান
সাঙ্গ হলে,
তখন দেখবে সেখানে
শেষ যুদ্ধে
আমরাও রয়েছি
তোমার পাশে।” . . .
: ফিদেলের জন্য গান, চে গুয়েভারা (অনুবাদ : মতিউর রহমান)
পাবলো নেরুদা সঙ্গে সংক্ষিপ্ত দেখায় আপনি বলেছিলেন, “যুদ্ধ… যুদ্ধ… আমরা সব সময় যুদ্ধবিরোধী, কিন্তু একবার যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে যুদ্ধ ছাড়া আমরা বাঁচতে পারি না। তারপর সর্বদা খালি যুদ্ধের কাছেই ফিরে যেতে চাই আমরা।”
এর্নেস্তা, চারপাশে যা কিছুই চলুক, আমরা আপনার যুদ্ধের কাছেই ফিরতে চাই। আমরা অবিনাশী যুদ্ধ চাই। এর অ্যাম্বুশ প্রহরে আপনারই মতোন মাথার কাছে কবিতার বই রেখে সতর্ক তন্দ্রা চাই।
একাধিক চিঠিতে নিজেকে ‘ব্যর্থ কবি’ বলেছেন আপনি। এই ‘ব্যর্থ কবি’ আর জীবন দেওয়া বিপ্লবী হয়ে আজও পৃথিবীর অন্যরকমদের বেঁচে থাকার অফুরন্ত এক শক্তি আপনি। কারণ সন্তানদের কাছে লেখা আপনার চিঠিতে ‘বিপ্লবী’ শব্দের শ্রেষ্ঠতম সাবলীল তরজমা পাই।
“এই পৃথিবীর যে কোনো অংশে যে কোনো মানুষের বিরুদ্ধে যে কোনো অন্যায়-অবিচার সংগঠিত হলে তা গভীরভাবে অনুভব করার চেষ্টা করবে। এটাই একজন বিপ্লবীর সবচেয়ে বড় গুণ।”
: সন্তানদের লেখা চিঠিতে চে গুয়েভারা। (অনুবাদ : শ্রী শুভেন্দু সরকার)
আপনার আর্বিভাব ছিল আর্জেন্টিনার সান্তা ফে’তে ১৯২৮ সালের ১৪ জুন। যৌবনেই মোটরবাইক নিয়ে পুরো লাতিন আমেরিকা ঘুরে দেখেছেন। মানুষ দেখার অনবদ্য এ বীক্ষণ নিয়ে লিখেছেনও। আপনার মৃত্যুর বহু পরে মোটরসাইকেল ডায়েরি নিয়ে সিনেমা হয়েছে।
হাঁপানী রোগ জীবনজুড়ে আপনাকে ভুগিয়েছে। কিন্তু একটি গেরিলা যুদ্ধেও আপনিও নিরত ছিলেন না। রোগ, শোকের ঊর্ধ্বে উঠেই না মানুষ বিপ্লবী। “ওয়ার্ডস আর বিউটিফুল, বাট অ্যাকশনস আর সুপ্রিম” বলে ইতিহাসের বাঁক বদলে নিজের দায় জীবন দিয়ে শোধ করেছেন।
এর্নেস্তা, ডাক্তারি ডিগ্রি ছিল আপনার। অথচ শুধু ব্যক্তির ব্যাধির চিকিৎসায় নিজেকে আবদ্ধ রাখেননি। সভ্যতার ব্যাধি জুলুমতন্ত্র উচ্ছেদে আপনি অস্ত্র ধরেছেন। আর সৃষ্টি করে যাচ্ছেন এখনের দিন পর্যন্ত কোটি কোটি অনুসারী।
‘সেইন্ট চে’ হয়ে ল্যাতিন চার্চে চার্চে আপনি এখন মুক্তির যিশু। আর আমাদের এই কাণ্ডজ্ঞানহীনতার জনপদে কোনো ভাবেই ধর্ম নিয়ে বিবাদ থামছে না।
প্রিয় এর্নেস্তা, অনেক দেরি হয়ে যাচ্ছে আমাদের। অনবরত দেরি হয়ে যাচ্ছে . . .
...“আমারও কথা ছিল হাতিয়ার নিয়ে তোমার পাশে দাঁড়াবার
আমারও কথা ছিল জঙ্গলে কাদায় পাথরের গুহায়
লুকিয়ে থেকে
সংগ্রামের চরম মুহূর্তটির জন্য প্রস্তুত হওয়ার
আমারও কথা ছিল রাইফেলের কুঁদো বুকে চেপে প্রবল হুঙ্কারে
ছুটে যাওয়ার
আমারও কথা ছিল ছিন্নভিন্ন লাশ ও গরম রক্তের ফোয়ারার মধ্যে
বিজয়-সঙ্গীত শোনাবার-
কিন্তু আমার অনবরত দেরি হয়ে যাচ্ছে!” ...
: চে গুয়েভারার প্রতি, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়