শুধু গানই গান না। এ মানুষ অন্য মানুষ। জানা হয়েছিল তখন।
. . .
“টিলার মাথায় দাঁড়িয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে দেখি কি, একটা তাঁবুতে আলো জ্বলছে। আর সেখান থেকে ভেসে আসছে গানের সুর।
বুঝলাম আজম খান গান গাইছে। আজম খানের সুন্দর গানের গলা। আবার অন্যদিকে ভীষণ সাহসী গেরিলা, দুর্ধর্ষ যোদ্ধা।…
আজম খানের সুর, মনে হচ্ছিল যেন চারদিকের ইথারে ভেসে ভেসে হাজার মাইল ছড়িয়ে পড়ছে। তখন আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠেছিল। এখন এ বৃষ্টিঝরা গভীর রাতের অন্ধকারে আমিও যেন চোখের সামনে দেখতে পেলাম নির্জন টিলার মাথায় কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা ৩০৩ রাইফেল হাতে সেন্ট্রি ডিউটিতে সব ইন্দ্রিয় টান করে দাঁড়িয়ে আছেন আর তাদের চারপাশ দিয়ে বায়ুমণ্ডলে ভেসে ভেসে যাচ্ছে আজম খানের উদাত্ত গলার গান—
হিমালয় থেকে সুন্দরবন, হঠাৎ বাংলাদেশ
কেঁপে কেঁপে ওঠে পদ্মার উচ্ছ্বাসে...”
: একাত্তরের দিনগুলি, জাহানারা ইমাম
এ বর্ণনা রুমীর দেওয়া। যে রুমী যুদ্ধে গিয়ে আর মায়ের কাছে ফিরে আসেননি। শহীদজননীর এ লেখা কিশোর বয়সী কাউকে অনেক কাঁদায়, ভাবায়। আবার জানায় আজম খান ছিলেন রুমীর বন্ধু, সহযোদ্ধা।
ইতিহাস তো পুরোনো হয় না কখনো। সে যত আগেরই হোক। ৭১ মনে হলেই প্রশ্ন আসে, কোথায় থাকতাম আমি? অবরুদ্ধ শহরে লুকিয়ে কোথাও? নাকি বুকের মধ্যে মন্ত্র বুনে দেওয়া খালেদ মোশাররফের দলে। যিনি বলতেন, “জীবিত গেরিলার দরকার নেই স্বাধীন দেশে। স্বাধীন দেশ চায় রক্তস্নাত শহীদ।”
আজম খান শহীদ হতে পারেননি। অজস্র সম্মুখযুদ্ধে শামিল ছিলেন। গিজগিজ করা পাকিস্তানি মিলিটারির শহর স্তম্ভিত হয়েছে এ সাহসী গেরিলার আক্রমণে। যুদ্ধ শেষে অস্ত্র জমা দিয়েছিলেন। কিন্তু নিজের খুব গভীরে রেখেছিলেন মেঘালয় ২ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার খালেদ মোশাররফের ট্রেনিং।
ষাটের দশকের শেষ দিকে ঢাকার বিলাসবহুল হোটেলে আবির্ভাব হয় বাংলা পপ বা রক সংগীতের। পশ্চিমা ব্যান্ডের ইংরেজি গানই ধনাঢ্যদের সামনে তখন গাওয়া হতো। সাধারণ মানুষের প্রবেশাধিকার ছিল না এতে। এর বাইরে দেশে তখন ছিল সিনেমার গান আর রবীন্দ্রনাথ-পরবর্তী সব গান ‘বাংলা আধুনিক’ শিরোনামে। অভাব ছিল যথার্থ বাদ্যযন্ত্রের সঙ্গে উপযুক্ত বাংলা গানের। সাহসের অভাব সবার। তখন স্বাধীন দেশে যোদ্ধা হতে হয় মাহবুবুল হক খান নামের আজম ডাকনামের তরুণকে। তার পক্ষেই প্রশ্ন উত্থাপন সম্ভব স্বাধীন দেশে “হায় রে হায় বাংলাদেশ…।” দেশ বদলেও শোষণের চেহারা যখন অপরিবর্তিত।
আজম খান একাই দাঁড় করিয়ে ফেলেন বাংলায় আমাদের অঞ্চলে আগে ছিল না, এমন এক সংগীত ধারা। ‘অপসংস্কৃতি’র তকমা লাগে এ গানে। অনেকে মানতে পারেননি তারুণ্যের এমন নতুন সংগীত।
কিন্তু কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করে পপগুরু আজম খান এগিয়ে যান একা। কাউকে তো সোচ্চার হতে হবে। তার গানের দলের নাম হয় ‘উচ্চারণ’। যদিও এর মর্মার্থ অনেকের বোঝা হয়নি। গুরু আজম খানের শুরু করা ব্যান্ড আন্দোলনে এরপরও অনেক ব্যান্ড দাঁড়িয়েছে। কী কারণে এদের হাতে গোনাদের নাম বাংলায়?
মনে হয়, অনেক দিন নির্বাক যুগ চলছিল। এমন উচ্চকণ্ঠের গান কখনো ছিল না আগে। সঙ্গে জোরালো বাদন। আশি-নব্বইয়ের দশকে ‘মুরব্বি মহল’ মেনে নেয় বাংলা ব্যান্ড সংগীতকে। ‘অপসংস্কৃতি’র তকমা সরে গা থেকে। স্ফুলিঙ্গ থেকে শত সহস্র মশাল জ্বালিয়ে আজম খান থেকে যান আড়ালে। সন্তানসম সংগীতশিল্পীরা বিপুল বিত্তের মালিক হয়েছেন। আজম খান সে লাইনে নেই। খামখেয়ালিপনায় অব্যাহত থাকেন। কাজ করেছেন বিজ্ঞাপনচিত্রে। অভিনয় করেন চলচ্চিত্রেও। মেতে থাকেন তরুণদের সঙ্গে ক্রিকেট খেলায়। শেষ জীবন সীমাহীন দুর্ভোগে। চিকিৎসার অর্থ নেই। শিষ্যরা এগিয়ে আসেন। কিন্তু শরীরে যার ক্যানসারের ছোবল, কে তাকে বাঁচায়? আজম খান চলে যান ২০১১ সালের আজকের দিন ৫ জুনে। জীবনকালে যিনি আরও বহু কিছুর মতো স্বাধীনতা পদক থেকে বঞ্চিত ছিলেন। তার চলে যাওয়ায় প্রমাণ হয়, কিংবদন্তির সম্মানদানে এ জাতি অপারগ। আর প্রকৃত যোদ্ধারা এমনই। যুদ্ধ ছাড়া জীবন সহ্য হয় না। এর চেয়ে বেশি ভালো বরং অদেখা ভুবন।
১৯৫০ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকার আজিমপুরে জন্মগ্রহণ করেন আজম খান। তার ৬১ বছরের জীবনের পরতে পরতে জড়িয়ে আছে নতুন ধারার বাংলা সংগীত। এর গুণেই মানুষের ভালোবাসায় তিনি ‘গুরু’ হয়েছেন। প্রয়াণদিবসে পপগুরুর প্রতি অনন্ত শ্রদ্ধা!