• ঢাকা
  • শনিবার, ২৩ নভেম্বর, ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

খুদে লেখকের খাগড়াছড়ি ভ্রমণ


মুহাম্মদ ইসহাক
প্রকাশিত: এপ্রিল ২২, ২০২২, ০৫:৪৭ পিএম
খুদে লেখকের খাগড়াছড়ি ভ্রমণ

ভ্রমণ কাহিনি পড়লে মনে ভ্রমণের আনন্দ জাগে। ভ্রমণের স্থান ও কালে নিজেকেও অনুভব করা যায়। বাংলাদেশের পর্যটন এলাকাগুলোর মধ্যে অসাধারণ ও মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্যসমৃদ্ধ স্থান হলো খাগড়াছড়ি। সবুজ পাহাড় ও প্রকৃতির অপূর্ব মিলন ঘটেছে এ পার্বত্য জেলার  সাজেক ভ্যালিতে। ওখানে ভ্রমণে গিয়ে প্রকৃতির অপরূপ দৃশ্য অবলোকন  অন্য এক অনুভূতি জাগায়। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পর্যটকেরা ভ্রমণ করতে সেখানে যায়।পাহাড়ি অঞ্চল খাগড়াছড়িতে একদা ভ্রমণে করেছিলো লেখক ও তাঁর পরিবার। সেই ভ্রমণের স্মৃতি নিয়ে সুনিপুণভাবে লিপিবদ্ধ করেছেন ‍‍`খাগড়াছড়ি ভ্রমণ‍‍` বইয়ে। বইটি লিখেছেন শিশু লেখক আয়াত মোস্তফা খান। বইটি প্রকাশিত হয় মার্চ ২০২২ সালে। 

 

বয়সে ছোট হলেও চিন্তা শক্তি ও তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ  প্রতিভার পরিচয় বিধৃত হয়েছে এ গ্রন্থে। পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ার সময় সে খাগড়াছড়ি গিয়েছিল। এটা লেখকের দ্বিতীয় বই। আয়াত মোস্তফা খান চতুর্থ শ্রেণিতে পড়াকালীন ভ্রমণে যায় পাহাড়ি জনপদ রাঙ্গামাটিতে। রাঙ্গামাটির স্মৃতি ও ভ্রমণের বর্ণনা লিপিবদ্ধ করেছে ‍‍`রাঙ্গামাটি ভ্রমণ ‍‍` বইটিতে। রাঙ্গামাটি ভ্রমণ  বইটি প্রকাশিত হয় ২০১৯ সালে।এটি লেখকের প্রথম পুস্তক।  দেশের বা বিদেশের কোনো জায়গায় ভ্রমণে গেলে বিভিন্ন কিছু দেখার সুযোগ হয়। জীবনে সিঞ্চিত হয় নতুন অভিজ্ঞতা। বিশেষ করে ছোট শিশুরা  আনন্দ-বিনোদনে সময় কাটাতে পারে। লেখক এ বইয়ে সহজ সরল ও সাবলীল ভাষায় অকপটে নানান স্মৃতি তুলে ধরেছে। ভ্রমণে যাবার জন্য গাড়ির অপেক্ষা থেকে ভ্রমণ শেষ করে বাসায় পৌঁছা পর্যন্ত হরেক রকমের মজার ও আনন্দময় মুহূর্ত  চিত্রায়িত করেছে সার্থকভাবে। 

 

বইটি পড়তে পড়তে মনে হবে আপনিও খাগড়াছড়ি ভ্রমণে আছেন।  লেখকের সাথে  সফর সঙ্গী ছিলেন তাঁর মা,বাবা, ছোট বোন, খালাত বোন, মামা,খালামণি ও বাসার কাজে সহায়তাকারী কলি। নতুন নতুন জায়গায় ভ্রমণে যাবার আগ্রহ তার প্রবল। তার বই থেকে জানা যায় পরিকল্পনা  ছিলো  সিলেটের টাঙ্গুয়ার হাওড়ে যাবার, কিন্তু বিভিন্ন কারণে সেখানে  আর যাওয়া হয়নি। পরে খাগড়াছড়ি ভ্রমণের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত হয়। ১৯ ডিসেম্বর, ২০১৯ তারিখে রাতে ঢাকা থেকে ভ্রমণের উদ্দেশ্যে গাড়িতে উঠেন। গাড়ি দেরিতে আসায় বাস কাউন্টারে অপেক্ষার  অস্থির সময়গুলো দারুণভাবে সে উপস্থাপন করতে পেরেছে বলে আমার মনে হয়েছে। গাড়ির জন্য অপেক্ষার ফাঁকে মামা কফির ব্যবস্থা করলেন। যাত্রাটা এভাবেই বর্ণনা করেছে সে।  ‍‍`রাত ১২টায় গাড়ি ছাড়ল। আস্থা আর বৃন্ত ভাইয়া পাশাপাশি সিটে বসল। মা আর আমিও বসলাম পাশাপাশি । মা জানতেন এবারও আমাদের বমি হবে। মা আগে থেকেই আমাদের টিস্যু ও পলিথিন দিয়ে তৈরি করে দিলেন। এবার তো আর বাবাকে বকা দিতে পারবেন না, তাই চুপচাপ ঘুমিয়ে পড়লেন। আমিও ঘুমিয়ে পড়লাম। কিন্তু কিছুসময় পরেই আবার বমি শুরু হলো। রাতে আমরা কেউ ঘুমাতে পারলাম না।‍‍` আস্থা হলেন লেখকের ছোট বোন। আর তাঁর বাবা ঢাকা থেকে ভ্রমণের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেনি। কারণ লেখকের পিতা লেখক সাদাত উল্লাহ খান সেই সময় চট্টগ্রামে অবস্থান করছিলেন। চট্টগ্রাম থেকে লেখকের বাবা খাগড়াছড়িতে চলে গিয়েছিলেন। কুমিল্লার এক হোটেলে যাত্রা বিরতিতে নাস্তার কথা সুন্দরভাবে উল্লেখ রয়েছে। 

 

লেখককের মামা পরোটা নিয়ে চমৎকার একটা গল্প শোনালেন। মন্ত্রমুগ্ধের মতো সবাই শুনলেন  এবং সবাই না হেসে থাকতে পারলো না। সকাল ৬টায় খাগড়াছড়ির শাপলাচত্বরে বাস থামল। আর এখান থেকে সাজেক ভ্যালির দূরত্ব ৬৫ কি.মি.। তিন ঘন্টা সময় লাগে। ড্রাইভারের সাথে তার বাবার ঝগড়ার কথা তুলে ধরেছে এভাবে—‍‍`আমাদের ড্রাইভার আগে তেল না ভরে মাঝপথে তেল ভরার কারণে আমাদের পৌঁছাতে ১০টা ৩০মিনিট বেজে যায়।এজন্য বাবা রেগে গিয়ে ড্রাইভারের সাথে ঝগড়া করেন। ড্রাইভার যেহেতু সেখানকার স্থানীয় চাকমা ছিল, সে প্রচণ্ড রেগে গেল। এরপর বলল সে আমাদের নিয়ে সাজেক ভ্যালি যাবে না। এরপর  মা,বড়মামা  এবং মেজমামা ড্রাইভারকে অনুরোধ করলে ড্রাইভার বলে  সে বাবাকে নিয়ে যাবে না।‍‍` 

 

সাজেক যেতে চেকপোস্টের বর্ণনা সুন্দরভাবে ফুটে তুলেছে। লেখক সাদাত উল্লাহ খানের সাথে কেউ না কেউ একজন সফরসঙ্গী থাকেন। তখন সঙ্গে ছিলেন ওমর ফারুক। চেকপোস্টে ওমর ফারুকের বিষয় উল্লেখ রয়েছে। মামার সাথে আস্থার পাহাড়ি মুরগির আলাপ অসাধারণভাবে তুলে ধরেছে সে। গাড়ি দুপুর ২টায় সাজেকে পৌঁছালো। তাদের অবস্থান ছিলো ক্লাসিক রিসোর্টে । দুপুরের খাওয়া শেষে পাহাড় দেখার ও বালু দিয়ে ভরা রাস্তার কথা উল্লেখ রয়েছে। উঁচুনিচু রাস্তার কারণে বাঁশ নিয়ে হাঁটতে হয়। লেখকের পিতা রাস্তার করুণ দৃশ্য দেখে হাঁটা বন্ধ করে দিলেন। ‍‍`মা যখন বাঁশ কিনে সবাইকে দিচ্ছেন,  তখন মা খেয়াল করেন আস্থা আর বড়মামা নেই। মা অস্থির হয়ে গেলেন। তখন বৃন্ত ভাইয়া বলল মামা আর আস্থা অনেক আগেই বাঁশ কিনে এতক্ষণে পাহাড়ে উঠে গেছে। মা তাড়াতাড়ি হেঁটে পাহাড়ের সামনে গেলেন। গিয়ে দেখেন মা আর আস্থা পাহাড়ের চূড়ায় উঠে গেছে।‍‍` পাহাড়টির নাম কংলাখ পাহাড়। এই পাহাড়ের উচ্চতা ১৮০০ফুট। ভ্রমণের গাইড থেকে এসকল তথ্যগুলো পেয়েছে লেখক। সে মজার মজার ছবি তুলেছে। বাঁশ কেটে বানানো কাপে কফি পান করেছে। কাপ দেখতে সুন্দর লাগে। হেলিপ্যাডও দেখা হয়েছে। 

 

আয়াত, আস্থা ও বৃন্ত অল্প সময়ের জন্য কার্ড খেললো। হোটেলে ঝামেলার দৃশ্য সুন্দরভাবে বয়ান করেছে সে। সাজেক ভ্যালিতে গিয়ে সূর্যোদয়ের দৃশ্য দেখার অনুভূতি অন্যরকম । যা বর্ণনা করা যায় না। লুসাই গ্রামের একটি কটেজে মামারা উঠেছেন। মামাদের দেখতে গিয়ে লুসাই গ্রামের পাহাড়ি সাজপোশাক দেখা হলো। এবার ফিরে যাবার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। পেদা টিং টিং একটি কটেজের নাম। এটা নিয়ে অনেকে হাসাহাসি করলো। সপ্তডিঙ্গা ট্র্যাভেলসের ব্যানারে ছবি তুলা হয়েছে। কারণ ঢাকা থেকে এর মাধ্যমে টুর বুকিং করা হয়েছিল। ফেরার পথে খাগড়াছড়ির আলুটলা গুহাও দেখা হয়েছে। হর্টিকালচার পার্ক ও ঝুলন্ত ব্রিজ দেখা হয়েছে । মারমাদের তৈরি সুস্বাদু পিঠা খাওয়া হয়েছে। বড়মামার বন্ধুর বাসায় দাওয়াত খেয়েছি। নৌকাও চড়া হয়েছে। লেখকের গলার স্বর পরিবর্তন হয়েছে। ঠান্ডা লাগার কারণে এ অবস্থা। ‍‍`আমার জীবনের মজার এবং অভিজ্ঞতাপূর্ণ ভ্রমণ ছিল খাগড়াছড়ি।‍‍` 

 

লেখক আয়াত মোস্তফা খান সপ্তম শ্রেণির একজন মেধাবী শিক্ষার্থী। স্কুলের নাম ম্যাপেল লিপ ইন্টান্যাশনাল স্কুল। ২০০৮ সালে আয়াত মোস্তফা খান ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেছে। তার পৈত্রিক নিবাস চারদিকে সমুদ্রবেষ্টিত  পাহাড়ি দ্বীপ  মহেশখালি উপজেলার সিপাহীরপাড়া। আয়াত মোস্তফা খান লেখক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছেন। তাঁর বাবার নাম সাদাত উল্লাহ খান। সমাজবিজ্ঞানী হিসেবে তাঁর সুনাম রয়েছে। তিনি একজন লেখক, গবেষক ও অনুবাদক। ‍‍`প্রতিবুদ্ধিজীবী ‍‍`নামে একটি জার্ণাল বহু বছর ধরে সম্পাদনা করে আসছেন।  প্রকাশক হিসেবেও দেশে তাঁর পরিচিত রয়েছে। মায়ের নাম কাজী ফারহানা আক্তার। তিনি একজন ব্যাংকার। তাঁর আরেকটা পরিচয় রয়েছে। তিনিও একজন লেখক ও অনুবাদক। তাঁর ফুফু হলেন শিক্ষাবিদ শাওয়াল খান। তিনি একজন  চিন্তাশীল লেখক, অনুবাদক ও সম্পাদক। সবচেয়ে বড় পরিচয় হল আয়াত মোস্তফা খান হলো বহুমাত্রিক চিন্তাবিদ অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খানের আপন ভাতিজি। অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান এমন একজন জ্ঞানী ও মনস্বী চিন্তাবিদ, যার তুলনা পাওয়া ভার। আয়াত মোস্তফা খান একজন শিল্পী এবং  অনুবাদকও। নবীন লেখক আয়াত মোস্তফা খানের ‍‍`খাগড়াছড়ি ভ্রমণ‍‍` বইটির ব্যাপক প্রচার ও সফলতা কামনা করছি।

 

খাগড়াছড়ি ভ্রমণ, আয়াত মোস্তফা খান, প্রতিবুদ্ধিজীবী, ঢাকা, মার্চ ২০২২, দাম ২০০ টাকা, পৃ.১৫।

লেখক : শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

 

Link copied!