থ্যালাসেমিয়া একটি বংশগত রক্তস্বল্পতাজনিত রোগ। অর্থাৎ থ্যালাসেমিয়া এক ধরনের রক্তশূন্যতা, যেটা জন্মগতভাবে এক পরিবার থেকে আরেক পরিবারে বংশ পরম্পরায় চলতে থাকে। জিনগত ত্রুটির কারণে এই রোগে অস্বাভাবিক হিমোগ্লোবিন তৈরি হয় বলে লোহিত রক্তকণিকা সময়ের আগেই ভেঙে যায়। ফলে রক্তশূন্যতা দেখা দেয়। দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ১০ ভাগ এই রোগের বাহক।
থ্যালাসেমিয়া কেন হয়
কোনো ছোঁয়াচে রোগ নয়। রক্তের ক্যানসারও নয়। মা ও বাবা দুজনই থ্যালাসেমিয়া রোগের বাহক হলে সন্তান থ্যালাসেমিয়ার রোগী হওয়ার আশঙ্কা থাকে। মানবদেহে যে ২৩ জোড়া ক্রোমোসোম আছে তার ১৬ নম্বর ক্রোমোজোমে থাকে আলফা জিন আর ১১ নম্বর ক্রোমোজোমে থাকে বিটা জিন। আলফা ও বিটা জিনদ্বয় আলফা ও বিটা গ্লোবিন নামের প্রোটিন তৈরি করে। যদি কোনও কারণে আলফা অথবা বিটা গ্লোবিন চেইন ত্রুটিপূর্ণ থাকে তাহলে হিমোগ্লোবিনও ত্রুটিপূর্ণ হয়। হিমোগ্লোবিন তৈরির পরিমাণ স্বাভাবিকের তুলনায় সামান্য একটু কম হয়। তখন তাদেরকে বলা হয় থ্যালাসেমিয়ার বাহক বা ক্যারিয়ার( বা মাইনোর)। কিন্তু যদি হিমোগ্লোবিন তৈরির জন্য যে দুটি জিন দরকার সেই দুটি জিনের মধ্যেই ত্রুটি থাকে, তবে হিমোগ্লোবিন তৈরির পরিমাণ অনেক কমে যায় এবং রক্তকণিকাগুলো সময়ের আগেই ভেঙে যায়। স্বাভাবিক মানুষের লোহিত রক্তকণিকার গড় আয়ু ১২০ দিন হলেও ত্রুটিপূর্ণ গ্লোবিনের কারণে থ্যালাসেমিয়া রোগীর লোহিত রক্তকণিকার গড় আয়ু মাত্র ২০ থেকে ৬০ দিন। অপরিপক্ব অবস্থায় লোহিত রক্তকণিকা ভেঙে যায়, তাই রক্তস্বল্পতা দেখা দেয়। তখন তাদেরকে থ্যালাসেমিয়ার রোগী বা থ্যালাসেমিয়া মেজর বলা হয়।
তাদেরকে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নিয়মিত রক্ত নিয়ে বেঁচে থাকতে হয়। আবার কিছু থ্যালাসেমিয়া রোগীর উপসর্গ ও রক্তের প্রয়োজন মাঝামাঝি অবস্থানে থাকে বিধায় তাদেরকে থ্যালাসেমিয়া ইন্টারমেডিয়া বলে।
থ্যালাসেমিয়ার প্রকারভেদ
রোগীর ব্লাড নেওয়ার প্রয়োজনীয়তার ওপর ভিত্তি করে বা ক্লিনিক্যালি থ্যালাসেমিয়াকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে।
যেমন-
থ্যালাসেমিয়া মেজর (অতিমাত্রা)
মাইনর (অল্প মাত্রা)
এবং ইন্টারমিডিয়েট (মধ্যম মাত্রা)
থ্যালাসেমিয়া অনেক ধরনের যেমন-হিমোগ্লোবিন বিটা, ই বিটা থ্যালাসেমিয়া, হিমোগ্লোবিন ই ডিজিজ, আলফা থ্যালাসেমিয়া, এস বিটা থ্যালাসেমিয়া, হিমোগ্লোবিন এস ডিজিজ, হিমোগ্লোবিন ডি পাঞ্জাব, হিমোগ্লোবিন ডি আরব ইত্যাদি। এর মধ্যে হিমোগ্লোবিন-বিটা এবং হিমোগ্লোবিন-ই এই দুই ধরনের থ্যালাসেমিয়া বাংলাদেশসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বেশি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০০৮ সালের এক পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ৭% মানুষ থ্যালসেমিয়ার বাহক, এর মধ্যে ৪% বাহক-ই এবং ৩% বাহক-বি। কিন্তু দেশে সাম্প্রতিক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ১০% থেকে ১২% মানুষ থ্যালাসেমিয়ার বাহক।
থ্যালাসেমিয়ার লক্ষণ
যারা থ্যালাসেমিয়ার বাহক তাদের মধ্যে তেমন কোনো লক্ষণ থাকে না। থ্যালাসেমিয়ার রোগী জন্মের ছয় মাস বয়স হতেই ফ্যাকাশে হতে থাকে, ক্রমে জন্ডিস দেখা দেয়। পেটের প্লীহা ও যকৃত বড় হয়ে যায়। ঠিকমতো শরীরের বৃদ্ধি হয় না। এ ছাড়া আরও নানা জটিলতা হতে পারে। থ্যালাসেমিয়া মেজর তাই শিশুকালেই ধরা পড়ে।
থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধ
- উচ্চ ঝুঁকিতে থাকা জনগোষ্ঠীকে যাদের বয়স ২৫ থেকে ৩৫ এর মধ্যে বিশেষ করে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালের ছাত্র-ছাত্রীদেরকে স্ক্রিনিংয়ের আওতায় আনতে হবে। তারা থ্যালাসেমিয়ার বাহক কি না সেটি বিয়ের আগে জানাতে হবে অর্থাৎ বাহক শনাক্ত করতে হবে। থ্যালাসেমিয়া স্ক্রিনিং প্রোগ্রাম না থাকায় বাংলাদেশে অনেকেই জানেন না যে তিনি থ্যালাসেমিয়ার বাহক কি না।
- বিয়ের আগে থ্যালাসেমিয়া পরীক্ষা করে নেওয়া প্রয়োজন। তাহলে তারা বাহক কি না জানতে পারবে এবং নিজেরা ভবিষ্যত প্ররিকল্পনা নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। কারণ দুজন বাহকের বিয়ে হলে সন্তান থ্যালাসেমিয়া রোগী হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। মা–বাবা উভয়ই থ্যালাসেমিয়ার বাহক হলে সন্তানের থ্যালাসেমিয়া রোগী হওয়ার ঝুঁকি ২৫ শতাংশ, বাহক হওয়ার ঝুঁকি ৫০ শতাংশ আর সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা ২৫ শতাংশ।
- থ্যালাসেমিয়ার বাহকদের মধ্যে যদি বিয়ে হয়েই যায় সেক্ষেত্রে গর্ভাবস্থার ১০ থেকে ১২ সপ্তাহের মধ্যে প্রিন্যাটাল ডিএনএ টেস্ট করতে হবে। সন্তান থ্যালাসেমিয়ার রোগী কি না সেটি এই পরীক্ষার মাধ্যমে বোঝা যাবে, যার ভিত্তিতে বাবা-মা ভবিষ্যত সন্তানের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন।
- চাচাতো, মামাতো, খালাতো, ফুফাতো ভাইবোনের অর্থাৎ পরিবারের মধ্যে বিয়ে হলে থ্যালাসেমিয়া রোগী হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়।
জনসাধারণকে থ্যালাসেমিয়া সম্পর্কে সচেতন করা জরুরি। থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধের জন্য আরও বেশি প্রচার দরকার। প্রয়োজন মানুষকে সচেতন করাও। তবেই হয়তো এই রোগ থেকে মুক্তি মিলবে।