সহজেই চা পানের জন্য ‘টি ব্যাগ’ সহজ ও আরামদায়ক পদ্ধতি হলেও বাড়িয়ে দিচ্ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি। টি ব্যাগ দিয়ে চা তৈরি করার সময় বের হয়ে আসছে লাখ লাখ ন্যানো-আকৃতির কণা আর ন্যানোফিলামেন্ট। যা মাইক্রো আর ন্যানোপ্লাস্টিকের বড় উৎস। যেসব প্লাস্টিক মানবস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।
বার্সেলোনার অটোনোমাস বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত এক গবেষণায় এমন তথ্য উঠে এসেছে। সম্প্রতি ‘কেমোস্ফিয়ার’ জার্নালে প্রকাশিত গবেষণায় আরও বলা হয়, ন্যানো আকৃতির প্লাস্টিক কণাগুলো মানুষের শরীরের ভেতরের বিভিন্ন অন্ত্রের কোষে শোষিত হয়ে রক্তপ্রবাহে চলে যেতে পারে এবং শরীরের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে যেতে পারে।
পলিমার ভিত্তিক উপাদান দিয়ে তৈরি বাণিজ্যিক টি ব্যাগ দিয়ে চা তৈরি করার এসব লাখ লাখ ন্যানো-আকৃতির কণা বেরিয়ে আসে। গবেষণায় ব্যবহৃত টি ব্যাগের ব্র্যান্ডগুলোর নাম প্রকাশ করা না হলেও সেগুলো যে ‘বাজারে পাওয়া’ যায় তা জানানো হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গবেষণায় ব্যবহার করা টি ব্যাগগুলো নাইলন-৬, পলিপ্রোপিলিন ও সেলুলোজ দিয়ে তৈরি করা। গবেষণা অনুযায়ী, চা তৈরি করার সময় পলিপ্রোপিলিন প্রতি মিলিলিটার ১ দশমিক ২ বিলিয়ন কণা ত্যাগ করে, সেলুলোজ ১৩৫ মিলিয়ন কণা এবং নাইলন-৬ ত্যাগ করে ৮ দশমিক ১৮ মিলিয়ন কণা।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, প্রথমে মাইক্রোকণাগুলোকে চিহ্নিত করা হয়। পরবর্তীতে অন্ত্রের মিউকাস উৎপন্নকারী কোষের সঙ্গে পরীক্ষা করা হয়। এতে গবেষকরা দেখতে পান, অন্ত্রের কোষ কেবল কণাগুলো শুষেই নেয়নি, বরং সেগুলো কোষের নিউক্লিয়াসে পৌঁছেছে। এই নিউক্লিয়াসেই জেনেটিক উপাদান থাকে।
টি ব্যাগ থেকে মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর ন্যানো-আকৃতির কণা বিষয়ে বার্সেলোনার অটোনোমাস বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক আলবা গার্সিয়া-রদ্রিগেজ বলেন, ‘আমরা এই দূষণ কণাগুলোকে নতুন প্রযুক্তি দিয়ে চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়েছি। এটি মানবস্বাস্থ্যের ওপর কণাগুলোর প্রভাব সম্পর্কে গবেষণা এগিয়ে নিতে সাহায্য করবে।’
প্লাস্টিক আবিষ্কার ও দূষণ
ব্রিটিশ উদ্ভাবক ও ধাতুবিদ আলেকজান্ডার পার্কস ১৮৫৫ সালে প্রথম প্লাস্টিক আবিষ্কার করেন। যা জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে কৃত্রিম বা রাসায়নিকভাবে তৈরি পলিমার। প্লাস্টিককে প্রথমে পার্কেসিন বলা হতো। পরবর্তীতে মার্কিন শিল্প রসায়নবিদ লিও বেকল্যান্ড ১৯০৭ সালে সম্পূর্ণ সিনথেটিক প্লাস্টিক আবিষ্কার করেনা যার নাম দেন বেকেলাইট। তিনিই প্রথম প্লাস্টিক শব্দটি ব্যবহার করেন।
স্বল্প খরচ, সহজ উৎপাদন ও ব্যবহারের বহুমুখিতার কারণে আবিষ্কারের পর থেকেই সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে প্লাস্টিক। তবে মানুষের জীবনযাত্রা সহজ করা এই প্লাস্টিক পণ্যসামগ্রীই এখন সভ্যতার অস্তিত্বের জন্য হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে। প্লাস্টিক দূষণ বর্তমানে সামুদ্রিক ও বন্যপ্রাণী, তাদের আবাসস্থল, জল, স্থল, সর্বোপরি মানবস্বাস্থ্যের জন্য চরম ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে। কারণ, অপচনশীল প্লাস্টিক বর্জ্য পরিবেশে প্রায় এক হাজার বছর পর্যন্ত বিদ্যমান থাকে। যা প্রতিবেশ ও মানবস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি।
জীববিজ্ঞানী রিচার্ড থম্পসন ১৯৯৩ সালে যুক্তরাজ্যের সৈকত পরিষ্কারের সময় বিভিন্ন রঙিন বালির সন্ধান পান। সেই বালির রহস্য উন্মোচন করতে গিয়ে মাইক্রোপ্লাস্টিক কণা আবিষ্কার করেন। নিত্যব্যবহার্য বিভিন্ন প্লাস্টিকসামগ্রী এই মাইক্রোপ্লাস্টিকের প্রধান উৎস।
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায়, গ্রাম-শহরে দৈনন্দিন কাজে ব্যবহৃত শ্যাম্পু, সাবান, ফেসওয়াশ, বডিওয়াশ, সেভিং ফোম, পাউডার, ডিটারজেন্ট, পেস্ট, নেইলপলিশ, মিনারেল ওয়াটার, প্লাস্টিক মোড়কজাত খাবার ইত্যাদি সামগ্রীতে মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি লক্ষণীয়। বর্তমানে বোতলজাত পানি ও টি ব্যাগেও মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি শঙ্কা বাড়িয়ে দিয়েছে।
মানবদেহের জন্য এই মাইক্রোপ্লাস্টিক চরম ক্ষতিকর। বিভিন্ন মাধ্যমে মানবদেহে প্রবেশ করা মাইক্রোপ্লাস্টিক দীর্ঘদিন অপরিবর্তিত অবস্থায় থেকে যায়। ফলে থাইরয়েড ও কিডনিজনিত সমস্যা ছাড়াও হতে পারে ক্যান্সারের মতো দুরারোগ্য অসুখ। মাইক্রোপ্লাস্টিকে ‘ফেতালেটস’ নামক একটি রাসায়নিক শরীরে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে কোষের বিভাজনে নানা পরিবর্তন হতে শুরু করে, যা থেকে লিভার ক্যান্সারের মতো রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়।
মানবদেহে থাকা মাইক্রোপ্লাস্টিকের ওপর বিভিন্ন ক্ষতিকর অণুজীব বাসা বাঁধে এবং মানুষের শরীরে থাকা হরমোনে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা সৃষ্টি করে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায়, প্লাস্টিকের বিভিন্ন উপকরণ থেকে মাইক্রোপ্লাস্টিক মানুষের শরীরের রক্তে মিশে যাচ্ছে।