কয়েকদিন ধরেই তাপদাহে পুড়ছে রাজধানীসহ সারাদেশ। অসহনীয় গরমে অতিষ্ঠ জনজীবন। তীব্র গরমের কারণে বাড়ছে রোগ ও রোগীর সংখ্যা। ডায়রিয়া, জ্বর, কাঁশি, নিউমোনিয়াসহ বিভিন্ন রোগ নিয়ে অনেকেই ভর্তি হচ্ছেন নগরীর হাসপাতালগুলোতে। সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে শিশুরা। রোগী বেড়ে যাওয়ায় শয্যা সংকট দেখা দিয়েছে হাসপাতালগুলোতে।
হাসপাতালের সামনে অভিভাবক ও স্বজনদের সারি অনেক দীর্ঘ হয়েছে। এরই মধ্যে কেউ কেউ অভিযোগ করে বলছেন, চাপ বাড়ার কারণে রোগীর রোগ পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফলাফল পেতে অনেক বিলম্ব হচ্ছে। এতে চরম ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে তাদের।
রোববার (২১ এপ্রিল) ঢাকা শিশু হাসপাতালে সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে রোগী ও স্বজনদের প্রচণ্ড। টিকিট কাউন্টারের সামনে লাইনে দাঁড়িয়েছেন অনেক মানুষ। সেখানে দুই সন্তানকে নিয়ে হাসপাতালে এসেছেন সোনিয়া আক্তার নামে এক অভিভাবক। দুই সন্তানসহ সঙ্গে ছিলেন তার স্বামীও। দুই দিন আগে দুই সন্তানকে ডাক্তার দেখিয়েছেন।
সোনিয়া আক্তার সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “প্রচণ্ড গরমে দুই সন্তানকে নিয়ে ভোলো নেই। সবাই অসুস্থ হয়ে পড়েছি। আর ঈদের পর থেকেই দুই ছেলেমেয়ে অসুস্থ। আগে জ্বর ছিল, এখন নেই। তবে পেটের ব্যথা কমছে না। ডাক্তার টেস্ট (পরীক্ষা) দিয়েছিল। আজ (রোববার) আল্ট্রাসনোগ্রাফি করাতে এসেছি।”
সোনিয়া আক্তার জানালেন, আগে রোগীর চাপ কম ছিল। আজ অনেক বেশি। সকাল ৮টায় এসে দুপুর ১২টা বেজে গেল। রিপোর্টও পাবো না, ডাক্তারও দেখাতে পারবো না। তাই বাধ্য হয়ে চলে যাচ্ছি। এখানে আউট ডোরের চেয়ে ভর্তি রোগীদের গুরুত্ব বেশি। অন্যরা পড়ছে ভোগান্তিতে।
হাসপাতালটির পরিসংখ্যান বলছে, গত ১১ দিনের ব্যবধানে বহির্বিভাগে নিউমোনিয়া ও সাধারণ সর্দি-কাশি রোগে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা সেবা গ্রহণকারী রোগী সংখ্যা বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি। গত ১০ এপ্রিল নিউমোনিয়া ও সাধারণ সর্দি-কাশি রোগে বহির্বিভাগে মোট ৭৪ জন রোগী চিকিৎসা নেয়। দশদিন পর ২০ এপ্রিল রোগী বেড়ে হয় ১৪১ জন।
এর মধ্যে ১১ এপ্রিলে ৬২ জন, ১২ এপ্রিলে ৯৬, ১৩ এপ্রিলে ৯৯, ১৪ এপ্রিলে ২০২, ১৫ এপ্রিলে ২৮৩, ১৬ এপ্রিল ৩২৬, ১৭ এপ্রিল ২০১, ১৮ এপ্রিল ১৫৬ এবং ১৯ এপ্রিলে ৬২ জন নিউমোনিয়া ও সাধারণ সর্দি-কাশির রোগী বহির্বিভাগে সেবা নেন। গেল ২৪ ঘণ্টায় নিউমোনিয়া ও সাধারণ সর্দি-কাশিতে ১৪১ রোগী বহির্বিভাগে চিকিৎসা গ্রহণ করেছে আর ডায়ারিয়া রোগে করেছে ৫৩ জন রোগী।
প্রতিষ্ঠানটির দায়িত্বশীলরা বলছেন, চিকিৎসা সেবা কেন্দ্রে শয্যা সংখ্যা ৬৮১টি। গেল ২৪ ঘণ্টায় ভর্তি হয়েছে ১২৬ রোগী। এ বছর গরমে ডায়ারিয়ার প্রকোপ কম থাকলেও নিউমোনিয়া রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। তাদের মতে, শিশু রোগের প্রকোপ কমাতে বিশেষ নজর রাখতে হবে।
সন্তানকে হাসপাতালে নিয়ে আসা নীশি দাস নামের এক বাবা বলেন, প্রায় ৫-৭ দিন ধরে বাচ্চার জ্বর। ওষুধ খাওয়ানোর পর জ্বর কমলেও আবার আসে। গরমে বাচ্চাটাকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছি। রাতে কারেন্ট থাকে না। গরমে ঘাম বসে গেলে আরও সমস্যা দেখা দেয়।”
আব্দুল করিম নামে এক অভিভাবক বললেন, “বাচ্চাটা গরমের জন্য ৪-৫ দিন ধরে অসুস্থ। ডাক্তার দেখালাম, ওষুধ দিল। ডাক্তার বলেছে, দ্রুত ঠিক হয়ে যাবে। গরমের কারণে বাচ্চাকে নিয়ে সবাই টেনশনে আছে।”
গাজীপুর থেকে আসা জাহাঙ্গির বলেন, “সর্দির সাথে সাথে কাশি। গত কয়েকদিন ধরেই এমন। কী কারণে জানি না। ডাক্তার দেখালাম, বললো ঠিক হয়ে যাবে। গরম বেশি পড়ার থেকে জল প্রচুর খাচ্ছে। টিকিট কেটে দ্রুত ডাক্তার দেখাতে পেরেছি। ভোগান্তিতে পড়তে হয়নি।”
ঢাকা শিশু হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক ডা. ফারহানা আহমেদ স্মরণী বলেন, “গত মার্চ থেকেই গরমের কারণে রোগীর চাপ বেড়েছে। আবহাওয়া পরিবর্তন হচ্ছে। গরমে যে সব রোগ হয়, সেই রোগে আক্রান্ত রোগী এখন আসছে বেশি। যেমন সাধারণ জ্বর-কাশি, নিউমোনিয়া, ডায়ারিয়া ইত্যাদি। হাসপাতালটি ৬৮১ বেডের (শয্যার)। এর মধ্যে প্রতিদিন আমরা চেষ্টা করছি শতাধিক রোগীকে ছাড়পত্র দেওয়ার। যারা একটু বাসায় গিয়ে খাওয়ার মতো উপযোগী হচ্ছেন, তখন তাদের অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ দিয়ে বাড়িতে পাঠিয়ে দিচ্ছি।”
গরম থেকে শিশুদের সুরক্ষার জন্য অভিভাবকদের পরামর্শ দিয়ে ডা. ফারহানা আহমেদ বলেন, “একটু পর পর তরল খাবার খাবে। ছোটদের মায়ের দুধ খাওয়াতে হবে। পাশাপাশি ডাবের পানি, ফলের রস, অতিরিক্ত ঘেমে গেলে স্যালাইন অল্প পরিমাণ খেতে পারে। গরমে দীর্ঘ সময় ধরে খোলা রয়েছে এমন খাবার খাওয়ানো যাবে না। বাইরে থেকে বেরিয়ে সরাসরি এসে ফ্রিজের পানি না খেয়ে বরং একটু বিশ্রাম নিয়ে তারপর খেতে হবে। প্রতিদিন গোসল করতে হবে। সুতি কাপড় পরিধান করার পাশাপাশি ঠান্ডা জায়গায় থাকতে হবে। বাইরে গেলে ছাতা, সানগ্লাস এবং সাথে পানি রাখা উত্তম।”
একই হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, “শিশু হাসপাতালে আগের চেয়ে রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। এ বছর হাসপাতালে ডায়ারিয়ার রোগীর চাপ না থাকলেও নিউমোনিয়া রোগীর সংখ্যা বেশি। আমাদের প্রথম যে সমস্যায় পড়তে হচ্ছে তা হচ্ছে বেডের ক্রাইসিস (শয্যা সংকট)। সিট থাকা সাপেক্ষে এখানে আগে আসলে আগে ভর্তি হতে পারবে। তবে যারা ভর্তি হওয়ার যোগ্য নয় তাদের কাউন্সেলিং করে ফেরত দেওয়া হয়। প্রয়োজন বোধ করলে জরুরি বিভাগে নিয়ে আসার জন্য পরামর্শ দেওয়া হয়।”