প্রতিরোধযোগ্য হলেও দেশে জরায়ুমুখ ক্যানসারে আক্রান্তের অর্ধেকের বেশি নারী প্রতি বছর মারা যাচ্ছেন। বিশ্বব্যাপী অসংক্রামক রোগের মধ্যে নারীদের জরায়ুর ক্যানসার অন্যতম। নিয়মিত স্ক্রিনিংয়ের অভাব, বাল্যবিবাহ, ঘন ঘন সন্তান প্রসব, একাধিক নারী-পুরুষের সঙ্গে মেলামেশাসহ বিভিন্ন কারণে জরায়ুমুখে ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ে। ফলে নিয়মিত স্ক্রিনিং করা প্রয়োজন। আর কমবয়সি নারীদের ক্ষেত্রে হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস (এইচপিভি) টিকা নেওয়া জরুরি বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা।
তারা বলছেন, শুধুমাত্র সচেতনতার অভাবে বাংলাদেশের মেয়েরা জরায়ুর ক্যানসারের ঝুঁকিতে থাকে। দেশে প্রতি বছর ৮ হাজারের বেশি নারী জরায়ুমুখের ক্যানসারে আক্রান্ত হন। আক্রান্তদের মধ্যে ৫ হাজার নারী এই ক্যানসারে প্রতি বছর মারা যান।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই জরায়ুমুখের ক্যানসার প্রাথমিকভাবে ধরা পড়লে চিকিৎসায় রোগীকে সুস্থ করা সম্ভব। এই ক্যানসার প্রতিরোধে এইচপিভি নামের ক্ষতিকর ভাইরাসের বিরুদ্ধে টিকা নিতে হবে। বাল্যবিবাহ বন্ধ করতে হবে এবং এই ক্যানসারের ঝুঁকি ও প্রতিরোধ বিষয়ে ব্যাপক জনসচেতনতা বাড়াতে হবে এবং নিয়মিত স্ক্রিনিং করাতে হবে।
জানুয়ারি মাস জুড়ে বিশ্বব্যাপী পালিত হচ্ছে জরায়ুমুখের ক্যানসার সচেতনতা মাস-২০২৫। সচেতনতা বাড়াতে নেওয়া হয়েছে বিভিন্ন কর্মসূচি।
জন হপসকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডা. হালিদা হানুম আখতার বলেন, আমাদের দেশে তথা অনুন্নত দেশে যতজনের ক্যানসার ধরা পড়ছে, তার অর্ধেকের বেশি প্রতি বছর মারা যাচ্ছে। এটি একটি জরুরি পর্যবেক্ষণ। কেন মারা যাবে এতজন? যে রোগ প্রতিরোধযোগ্য, যেটি প্রাথমিক অবস্থায় নির্ণয় করা যায় এবং সুন্দর করে চিকিৎসা দেওয়া যায়, সেখানে কেন অর্ধেকের বেশি বা ৬০ শতাংশ ধরা পড়ার পর মারা যাবে? এটি একটি বড় প্রশ্ন। এর উত্তর হলো, আমরা নিজেরা সচেতন নই। আমরা জানি না, এই রোগ হতে পারে। আর এই সচেতনতার ক্ষেত্রে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।
তিনি বলেন, আমাদের জানতে হবে যে রোগটি প্রতিরোধযোগ্য। এখন নতুন বিজ্ঞান এসেছে, এইচপিভির ভ্যাকসিন বের হয়েছে। এই ভ্যাকসিন ৯ থেকে ১৫ বছর বয়সের মেয়েদের দিলে রোগটি প্রতিরোধ করা সম্ভব।
বাংলাদেশে এখন ইপিআইর মাধ্যমে স্কুল-কলেজের মেয়েদের এটি দেওয়া হচ্ছে। ২৬ বছর পর্যন্ত এই ভ্যাকসিন কাজে লাগে। তবে তিনটি ডোজ নিতে হয়। এসব তথ্য আমাদের জানতে হবে। এছাড়া নিয়মিত চেকআপ করতে হবে।
ডা. হালিদা হানুম আখতার বলেন, বিভিন্ন তথ্য ও গবেষণা থেকে দেখা গেছে, অনেক কম বয়সে মেয়ের বিয়ে দিলে, অধিক সন্তান জন্ম দেওয়া বা ঘন ঘন সন্তান হওয়ার কারণে জরায়ুমুখের ক্যানসার হতে পারে। আবার হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস বা এইচপিভির কারণে এই রোগ হওয়ার আশঙ্কা বাড়ে। এখন প্রশ্ন হলো, এই ভাইরাস কোথা থেকে আসে? এটি আসে যৌন সঙ্গমের মাধ্যমে। একজনের একাধিক যৌনসঙ্গী থাকলে, তার ঝুঁকি বেশি।
লক্ষণ :জরায়ুমুখের ক্যানসারের অনেকগুলো পর্যায় রয়েছে। প্রথম দিকে জরায়ুমুখে ঘা হতে পারে। জরায়ুমুখের কোষ পরিবর্তন হয়ে ক্যানসারে রূপান্তরিত হয়। এখান থেকে রক্তপাত হতে পারে, ব্যথা হতে পারে। রোগ আরও বেড়ে গেলে বা গুরুতর পর্যায়ে চলে গেলে আশপাশের যেসব অঙ্গ রয়েছে (যেমন: ব্লাডার, পায়খানার রাস্তা ইত্যাদি) সেগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা বাড়ে। তখন ভীষণ ব্যথা ও রক্তপাত হতে দেখা যায়। তবে, তখন রোগীকে আর বাঁচানো সম্ভব হয় না।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের গাইনি বিভাগের অধ্যাপক ডা. রাশিদা খানম বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা একুশ শতকের মধ্যেই জরায়ু ক্যানসারের ঝুঁকি দূর করতে চায়। এই লক্ষ্যে তারা ২০৩০ এর মধ্যে জরায়ুর ক্যানসার প্রতিরোধে ৯০ ভাগ ভেক্সিনেশন, ৭০ ভাগ স্ক্রিনিং এবং ৯০ ভাগ চিকিৎসার আওতায় আনতে সকলকেই উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শক্রমে বিদ্যালয়গামী মেয়েদের সরকারিভাবে বিনা মূল্যে জরায়ুর ক্যানসার প্রতিরোধে টিকাদানের ব্যবস্থা থাকলেও বাদবাকি মেয়েসহ সকলকে টিকাদানের ব্যাপারে উৎসাহিত করতে হবে।
জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউটের ক্যানসার ইপিডেমিওলজি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ডা. হাবিবুল্লাহ তালুকদার রাসকিন বলেন, নারীদের ক্যানসারের মধ্যে স্তন ক্যানসারের পরেই জরায়ুমুখের ক্যানসারের অবস্থান। এটা আন্তর্জাতিক সংস্থা আইএআরসির হিসাব। জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের প্রতিবেদন অনুযায়ীও নারীদের দ্বিতীয় প্রধান ক্যানসার এটি।