আমরা এখন অনেক কাজের জন্যই ইন্টারনেটের সহযোগিতা নেই। সহযোগিতার ব্যাপারটা এমন হয়ে গেছে যে, অসুস্থ হলেও এখন ইন্টানেট দেখেই ওষুধ খেয়ে নেই। বিশ্ব জুড়েই এখন এই ট্রেন্ড চলছে। যখন যা কিছু হবে, সবই গুগলে গিয়ে টাইপ করে ফেলে। যেমন, কারও মাথা ব্যথা হলো সে গুগলে সার্চ করলো। অনেকগুলো ওষুধের নাম আসলো, সে হয়তো একটা কিনে এনে খেয়ে নিল। এতে তখন হয়ত ব্যথা কমেও যেতে পারে। কিন্তু মাথা ব্যথার নানান কারণ থাকতে পারে। অনেক রোগের উপসর্গগুলো এক হতে পারে কিন্তু চিকিৎসা পদ্ধতি এক হতে পারে না। ফলে গুগল দেখে ওষুধে মাথা ব্যথা তখন কমলেও মূল রোগ কিন্তু রয়েই যাবে আপনার শরীরে।
এক জন চিকিৎসক রোগীর চিকিৎসা করেন, কারণ রোগটার নাম জানা, রোগীই অচেনা। তাই চিকিৎসা কোন পথে হবে সেটাই আসল, এমনই মনে করছেন চিকিৎসক সুবর্ণ গোস্বামী। সাম্প্রতিক সময়ে এমন অনেক রোগীকেই তিনি দেখেছেন, যারা ইন্টারনেট ঘেঁটে ওষুধপত্র খেয়ে বিপদে পড়েছেন। চিকিৎসক বলছেন, ‘‘নেট হাতড়ে নিজের চিকিৎসা নিজেই করার এই অভ্যাসই এখন একটা রোগ হয়ে গিয়েছে। এর নাম ‘ইডিয়ট সিনড্রোম’। কমবয়সি ছেলেমেয়েদের মধ্যে এখন এই প্রবণতা বেশি। যদি নেট প্রযুক্তিই চিকিৎসা করতে পারত, তা হলে আর চিকিৎসকের দরকার পড়ত না। বই পড়ে বা গবেষণাপত্র দেখেই ওষুধ দিয়ে দেওয়া যেত। কিন্তু তা হয় না। রোগীকে দিনের পর দিন দেখে, তার উপসর্গ বুঝে, রোগের ধরন বুঝে তবেই এক জন চিকিৎসক সঠিক ভাবে চিকিৎসা করতে পারেন। প্রতিটা মানুষ একে অপরের থেকে আলাদা। তাই তাদের রোগের ধরন ও উপসর্গগুলিও আলাদা। চিকিৎসা পদ্ধতিও তাই এক হবে না। সুবর্ণ গোস্বামীর পরামর্শ, ইন্টারনেট দেখে বিভ্রান্ত হবেন না। রোগ হলে চিকিৎসকের কাছে যান। সঠিক ওষুধ খান।
মনের রোগ বুঝতেও আজকাল ইন্টারনেটে খোঁজাখুঁজি বেড়েছে! সমীক্ষা বলছে, লকডাউনের সময়ে ২০ থেকে ৪০ বছর বয়সিরাই সবচেয়ে বেশি মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে নেট দুনিয়ায় সার্চ করেছিলেন। এমনকি, দাম্পত্য কলহ, মানসিক চাপ থেকে বাঁচার উপায় জানতেও বিস্তর খোঁজাখুঁজি হয়েছে গুগলে। এখনও যে হচ্ছে না, তা নয়, বরং অনলাইনে মনের ব্যাধির ওষুধ খোঁজার হার এখন সবচেয়ে বেশি, এমনটাই বললেন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ শর্মিলা সরকার।
শর্মিলার কথায়, অতিরিক্ত চিন্তাভাবনা, মানসিক চাপ থেকে মুক্ত হওয়ার কিছু টোটকা গুগল দিতে পারবে ঠিকই, কিন্তু জটিল মনোরোগের চিকিৎসা করা কখনওই সম্ভব নয়। কারণ, একটা ওষুধের নানা রকম প্রয়োগ আছে। যে ওষুধ অবসাদের জন্য দেওয়া হয়, সেটি অন্য মানসিক রোগের জন্যও দেওয়া হতে পারে। কাজেই কোন ওষুধ কার জন্য ঠিক, সেটা একমাত্র চিকিৎসকই বুঝবেন। তা ছাড়া, চিকিৎসক যদি বোঝেন মনের অসুখ অনেক গভীরে, তখন রোগীর কাউন্সেলিং করানো হয়। রোগীর কথাবার্তা, আচার-আচরণ দেখে তবেই চিকিৎসা শুরু হয়। রোগীর মন ও মস্তিষ্কে কী চলছে, সেটা বোঝা খুব দরকার। প্রযুক্তি এই কাজটা করতে পারবে না। এর জন্য দীর্ঘ দিনের পড়াশোনা, অভ্যাস, বাস্তব থেকে নেওয়া অভিজ্ঞতার দরকার হয়।
ইন্টারনেটের আধুনিক প্রযুক্তির প্রয়োগ নির্ভুল তো হবেই না, উপরন্তু বিপজ্জনক হয়ে উঠবে বলেই মনে করেন চিকিৎসক রাজা নাগও। ডাক্তারি বই, বিভিন্ন গবেষণাপত্র খুঁটিয়ে দেখেই সমাধান বাতলায় গুগলের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। বাস্তবের সঙ্গে তার মিলমিশ না-ও হতে পারে। দশ জন হার্টের রোগী ইন্টারনেট ঘেঁটে একই উত্তর পাচ্ছেন। তারা একই রকম ওষুধের নাম দেখছেন। কিন্তু দশ জনের প্রত্যেকের হার্টের অবস্থা, হৃদ্গতি, স্পন্দন আলাদা। তাই চিকিৎসাও আলাদা হওয়া উচিত। শুধুমাত্র কিছু সাধারণ উপসর্গের মিল দেখে রোগীরা বিশ্বাস করে ওষুধ খেয়ে ফেলছেন। বিপদ হচ্ছে এখানেই।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা চিকিৎসা ক্ষেত্রে সহায়ক হতে পারে, কিন্তু চিকিৎসক হতে পারে না— এমনটাই মত ইউরোগাইনোকোলজিস্ট মল্লিনাথ মুখোপাধ্যায়ের। তার মতে, ভবিষ্যতে চিকিৎসার অনেক জটিল পদ্ধতি, রোগ নির্ণয়, ওষুধ আবিষ্কার ইত্যাদি বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমরা প্রযুক্তিকে ব্যবহার করতে পারি। এখন তো আধুনিক অস্ত্রোপচারে রোবোটিক্সের প্রয়োগ হচ্ছে। সেই যন্ত্র চালাচ্ছে এক জনই। তেমনই গুগলের এআই টুল কী উত্তর দেবে, তার প্রোগ্রামিং করছেন কোনও প্রযুক্তিবিদই। যন্ত্রের বুদ্ধি মানুষের বুদ্ধিকে ছাপিয়ে যায়নি এখনও। টেলি মেডিসিন পরিষেবায় বহু দূর থেকেই রোগীকে দেখে ওষুধ দেওয়া হয়। কিন্তু সেখানেও এক জন চিকিৎসকই থাকেন। কাজেই চিকিৎসা ক্ষেত্রে চিকিৎসকের ভূমিকা ও দায়িত্ব সব সময়েই আগে থাকবে।
তবে এই বিষয়টি নিয়ে এখনই কোনও সিদ্ধান্তে চলে আসতে রাজি নন প্রযুক্তিবিদেরা। কলকাতার এক বহুজাতিক সংস্থার উচ্চপদে রয়েছেন মিতালি বিশ্বাস। তিনি পেশায় সফ্টঅয়্যার ডেভেলপার। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে নাড়াঘাঁটা করতে হয়। তিনি বললেন, ‘‘আধুনিক চিকিৎসার খুব বড় সহায়ক হতে চলেছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। অনেক জটিল চিকিৎসার অস্ত্রোপচারের পদ্ধতি বিশ্লেষণ করতে পারে এআই। সিটি স্ক্যান, এক্স-রে, এমআরআই সবেতেই এআই-এর প্রয়োগ হচ্ছে। কোনও রোগীকে পরীক্ষা করা, রোগের ধরন বোঝা, মেডিক্যাল টেস্টের রিপোর্ট তৈরি করতেও প্রযুক্তির ব্যবহার হচ্ছে। ওষুধ নিয়ে উচ্চস্তরে গবেষণা করতে গেলেও এখন প্রযুক্তিরই প্রয়োগ হচ্ছে। চিকিৎসা ক্ষেত্রে নিত্যনতুন আবিষ্কারেও সেই প্রযুক্তিরই প্রয়োগ হচ্ছে। খুব দ্রুত কোনও রোগের নিরাময়ের উপায় খুঁজে বের করা, ভ্যাকসিন আবিষ্কারের মতো জটিল বিষয়গুলিতেও গবেষকেরা প্রযুক্তিরই সাহায্য নিচ্ছেন। তাই ডিজিটাল যুগে আধুনিক প্রযুক্তিকে হেলাফেলা করলে চলবে না বলেই মত তার। তবে মিতালির পরামর্শ, প্রযুক্তির সঠিক প্রয়োগ যারা জানেন তারাই এর সুবিধা নিতে পারবেন। সাধারণ মানুষ না জেনেবুঝেই নিত্যদিনের সমস্যার সমাধান খুঁজতেও যদি প্রযুক্তিকে কাজে লাগাতে চান, তা হলে তার ফল হিতে বিপরীত হতে পারে।
সূত্র: আনন্দবাজার পত্রিকা