• ঢাকা
  • রবিবার, ০৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ২৪ ভাদ্র ১৪৩১, ৩ রবিউল আউয়াল ১৪৪৫

ঘোষণা ছাড়াই টেস্টের ফি বাড়িয়েছে বিএসএমএমইউ


সংবাদ প্রকাশ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: জুন ২২, ২০২৪, ১১:২৬ এএম
ঘোষণা ছাড়াই টেস্টের ফি বাড়িয়েছে বিএসএমএমইউ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ)

চিকিৎসার খরচ মেটাতে গিয়ে মানুষের ওপর আর্থিক চাপ বাড়ছে। এমন সময়ে ঘোষণা না দিয়েই রোগ নির্ণয়ের সব পরীক্ষার ফি বাড়িয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ)। বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটের অনুমোদন ছাড়াই বর্ধিত ফি কার্যকর করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের চারটি বিভাগে প্রায় সব পরীক্ষার ফি বেড়েছে ২ থেকে ৪ হাজার টাকা পর্যন্ত। ফলে রোগীদের চিকিৎসা খরচ বেড়ে গেছে। 

জানা গেছে, নতুন ফি কার্যকর হওয়ার ফলে বিএসএমএমইউর সব পরীক্ষার ফি দেশের অন্য সরকারি হাসপাতালের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। অনেক পরীক্ষার ফি বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের চেয়েও বেশি। যদিও এটা সত্য যে ফি বাড়ানোর পরও অধিকাংশ পরীক্ষার ফি বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে বিএসএমএমইউর চেয়ে কয়েকগুণ বেশি। প্রতি বছর পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফি থেকেই ১০-১২ কোটি টাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাগারে জমা দেয় সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলো। এই হাসপাতাল পরিচালনার সব ব্যয় সরকার বহন করে, চিকিৎসা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা থেকে যে টাকা আয় হয়, তা হাসপাতাল ও বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার কোনো কাজে ব্যয় হয় না। তাহলে ফি বাড়ানোর যৌক্তিকতা কী? ফি বাড়াতে সিন্ডিকেটের অনুমোদনও নেওয়া হয়নি। এটি বেআইনি। এ কথা প্রশাসন জানলেও তারা বর্ধিত ফি আদায় বন্ধ করেনি।

তবে সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর দাবি, তারা যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করেই পরীক্ষার দাম বা ফি বাড়িয়েছে। ডলারের দাম বাড়ার কারণে রি-এজেন্টের দাম ৩০-৪৫ শতাংশ বাড়ানোর কথা জানিয়ে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো গত বছরের জানুয়ারিতে চিঠি দিয়েছে। বিভাগগুলোর পক্ষ থেকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে বিষয়টি নিয়ে চিঠি দেওয়া হয়। প্রশাসন বিভাগগুলোকে পরীক্ষার ফি বাড়ানোর প্রস্তাব দিতে বলা হয়। এরপর বিভাগগুলো তাদের প্রস্তাব জমা দেয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে দুটি আলাদা কমিটি প্রস্তাব পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন করে ১৫-২০ শতাংশ দাম বাড়ানোর অনুমোদন দেয়। তবে বিষয়টি সিন্ডিকেটে অনুমোদিত কি না, তা তারা জানাতে পারেনি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান একটি গণমাধ্যমে  বলেন, “ফি বাড়ানোর নীতিমালা কী, তা আমার জানা নেই। ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় সবকিছুর দাম বেড়ে যায়। ফলে আমাদের যারা রি-এজেন্ট সরবরাহ করে, তারা আগের দামে দিতে অপারগতা প্রকাশ করে। তাই আমরা বাধ্য হয়ে পরীক্ষার দাম বাড়ানোর বিষয়ে সংশ্লিষ্ট বিভাগের চেয়ারম্যানরা আলাদা আলাদা চিঠি দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে বিষয়টি জানাই। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও তৎকালীন প্রশাসন ১৫-২০ শতাংশ দাম বাড়াতে আমাদের লিখিত অনুমতি দেয়।”

তিনি আরও বলেন, “রোগ পরীক্ষার কাজে সরকার থেকে আমাদের কোনো বরাদ্দ দেওয়া হয় না। আমাদের আয় দিয়ে চলতে হয়। পরীক্ষা-নিরীক্ষা থেকে যে টাকা আয় হয় রি-এজেন্টের টাকা ছাড়া আর কোনো টাকা বিভাগের কাজে লাগানো হয় না, তা বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিলে জমা হয়।”

বিশ্ববিদ্যালয়ের হেমাটোলজি বিভাগের ৪২টি পরীক্ষার সবগুলোর ফি বাড়ানো হয়েছে। এ বিভাগের ইএসআর বা এরিথ্রোসাইট সেডিমেন্টেশন রেট পরীক্ষার ফি ৮০ থেকে ১০০ টাকা করা হয়েছে। ঢাকা মেডিকেলে ইএসআর পরীক্ষার ফি ৩০ এবং বেসরকারি বারডেম হাসপাতালে ১১৩, পপুলার ডায়াগনস্টিকে ১৫০ টাকা। এ বিভাগে বোনম্যারো (হাড়ের মজ্জা) পরীক্ষার ফি ২ হাজার থেকে বাড়িয়ে ৩ হাজার ৫০০ টাকা করা হয়েছে। এটা করাতে পপুলার ডায়াগনস্টিক হাসপাতালে খরচ হয় ৪ হাজার টাকা। আর ঢাকা মেডিকেলে ১ হাজার ৬০০ টাকা। একইভাবে কিটো কেমিস্ট্রি পরীক্ষার তিনটি ধরনের ফি বাড়ানো হয়েছে ৫০০ টাকা করে।

বিএসএমএমইউর রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ড. এবিএম আব্দুল হান্নান বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো সেবার মূল্য ইচ্ছামতো বাড়ানোর সুযোগ নেই। যেহেতু আগের প্রশাসন দাম বাড়িয়েছে এবং দাম কমানো বা বাড়ানোর বিষয়টি সিন্ডিকেটের অনুমোদন নিতে হয়, তাই আগামী সিন্ডিকেটে বিষয়টি তোলা হবে। আশা করি, একটা গ্রহণযোগ্য সমাধান আসবে।”

ভাইরোলজি বিভাগের ৪৫টা পরীক্ষার মধ্যে সবগুলোরই ফি বেড়েছে এবং নতুন কিছু পরীক্ষাও যুক্ত হয়েছে। হিউম্যান লিউকোসাইট অ্যান্টিজেন বা এইচএলএ টিস্যু টাইপিং (এ+বি+ডিআর) পিসিআর পরীক্ষার ফি ১১ হাজার থেকে বাড়িয়ে ১৫ হাজার টাকা করা হয়েছে। পরীক্ষাটি অঙ্গ প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একইভাবে এইচএলএ (এ+বি) পিসিআর পরীক্ষার ফি ৭ হাজার থেকে বাড়িয়ে ১০ হাজার টাকা করা হয়েছে। হেপাটাইটিস-সি ভাইরাসের পরীক্ষার ফি ৬ হাজার থেকে বাড়িয়ে ৭ হাজার ২০০ টাকা করা হয়েছে।

ল্যাবরেটরি মেডিসিন বিভাগের ৯৪টি পরীক্ষার মধ্যে ৯৫ ভাগ পরীক্ষারই ফি বাড়ানো হয়েছে। এ বিভাগের পরীক্ষাগুলোর ফি ৫০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। ব্লাড অ্যানালিসিসের ১২টি পরীক্ষার সবগুলোর ফি বেড়েছে। সর্বনিম্ন ৫০ থেকে সর্বোচ্চ ৫০০ টাকা বেড়েছে। টিউমার মার্কার পরীক্ষা করে ক্যানসারের উপস্থিতি বা ক্যানসারের আচরণ বোঝা যায়। এরকম ১২টি পরীক্ষায় ৭০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত ফি বাড়ানো হয়েছে। প্রস্রাব পরীক্ষার ১১টিতে ফি বেড়েছে ৫০ থেকে ১০০ টাকা।

এ হাসপাতালে বায়োকেমিক্যাল পরীক্ষা করা হয় ২৯ ধরনের। এসব পরীক্ষার ফি বাড়ানো হয়েছে ১০ থেকে ১০০ টাকা। একইভাবে দাম বাড়ানো হয়েছে বায়োকেমিস্ট্রি অ্যান্ড মলিকিউলার বায়োলজি বিভাগের বেশিরভাগ পরীক্ষার।

বিএসএমএমইউর নতুন ফি-রেট বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, চিকিৎসকরা বেশিরভাগ রোগীকে সিবিসি (কমপ্লিট ব্লাড কাউন্ট) পরীক্ষা করাতে দেন। এ টেস্টের মাধ্যমে রোগীর শরীরে কোনো সংক্রমণ ঘটেছে কি না, রক্তকণিকা স্বাভাবিক আছে কি না, হিমোগ্লোবিনের মাত্রা কেমন তা বোঝা যায়। বিএসএমইউতে আগে এ পরীক্ষা ৩৫০ টাকায় করানো গেলেও এখন ৪০০ টাকা লাগে। একই পরীক্ষায় ঢামেকে ১৬০ এবং পপুলার ও বারডেমে ৪০০ টাকা খরচ হয়। কিডনির কার্যকারিতা বিষয়ক ক্রিয়েটিনিন পরীক্ষার ফি ১০০ টাকা বাড়িয়ে ৩০০ টাকা করা হয়েছে। একই পরীক্ষা করাতে ঢামেকে ৫০, বারডেমে ৩০০ ও পপুলারে ৪০০ টাকা খরচ হয়।

১০০ টাকার লিভার ফাংশন পরীক্ষার ফি ৩০০ টাকা করা হয়েছে। একই পরীক্ষা করাতে ঢামেকে ৭০, বারডেমে ৩০০ ও পপুলারে ৪০০ টাকা খরচ হয়। হেপাটাইটিস প্যানেলের ১১টি পরীক্ষার ফি সর্বনিম্ন ৫০ থেকে সর্বোচ্চ ২০০ টাকা করা হয়েছে। সংক্রমণ পরীক্ষার টিওআরসিএইচ (টর্চ) প্যানেলের ১৩টির ফি সর্বনিম্ন ১০০ থেকে সর্বোচ্চ ১০০০ টাকা করা হয়েছে। এইচআইভি প্যানেলের দুটি পরীক্ষার ফি ১০০ টাকা করে বাড়ানো হয়েছে। এইচএলএ টিস্যু টাইপিং পরীক্ষার ছয়টির চারটিতে ১ হাজার থেকে ৪ হাজার টাকা পর্যন্ত ফি বাড়ানো হয়েছে। মলিকিউলার ভাইরোলজির সাতটি পরীক্ষা নতুন ফি যুক্ত করা হয়েছে। পুরনো দুটি পরীক্ষার ফি ৮০০ ও ১২০০ টাকা বাড়ানো হয়েছে।

বিএসএমএমইউতে আগে রক্তের ক্রস ম্যাচিং করাতে ১০০ টাকা লাগলেও এখন দিতে হবে ১৫০ টাকা। রক্তের ক্রস ম্যাচিং ও স্ক্যানিং করাতে আগে লাগত ৬০০, এখন গুনতে হবে ১ হাজার ৫০০ টাকা। ২০০ টাকার কম্বো টেস্টের ফি নির্ধারণ করা হয়েছে ৫০০ টাকা।

বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) মহাসচিব ইহতেশামুল হক চৌধুরী একটি গণমাধ্যমে, “দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো নয়। চিকিৎসা ব্যয়ের কারণে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস উঠছে। চিকিৎসা ক্ষেত্রে রোগীকে ৭০ ভাগ ব্যয় বহন করতে হয়। দৈনন্দিন খরচ মেটাতে গিয়েই মানুষ হিমশিম খাচ্ছে; চিকিৎসা ব্যয় মেটানো তাদের জন্য খুবই কষ্টকর। এমন পরিস্থিতিতে বিএসএমএমইউতে পরীক্ষার ফি না বাড়ালেই ভালো হতো। আমি কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করব তারা যেন ফি বাড়ানোর যৌক্তিকতা পুনরায় বিবেচনা করেন।”

সূত্র : দেশ রূপান্তর

Link copied!