মনে হয় যেন মেঘলা আচ্ছাদন পড়েছে চোখের ওপর। স্বাভাবিক দৃষ্টি হয় বিঘ্নিত। ঘনিয়ে আসে ক্রমশ অন্ধত্ব। আমাদের দেশের অধিকাংশ বয়স্ক ব্যক্তি আক্রান্ত এই চক্ষুনাশক ব্যাধিতে। সহজ ভাষায় যাকে বলে ছানি। অথচ সময় থাকতে সতর্ক হলে এবং উপযুক্ত চিকিৎসা নিলে দৃষ্টিশক্তি বজায় রাখা সম্ভব। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডা. দিলীপ কুমার দেবনাথ দিচ্ছেন কিছু পরামর্শ।
কাকে বলা হয় ছানি
আমাদের চোখের ভেতরে রয়েছে স্বচ্ছ লেন্স, যার মাধ্যমে চোখে আলো প্রবেশ করে। এই আলো রেটিনাকে স্পর্শ করলেই আমরা দেখতে পাই। কিন্তু কোনো কারণে এই লেন্স যদি অস্বচ্ছ হয়ে যায়, তাহলে আলো ভেতরে প্রবেশ করতে বাধা পায়। একেই বলা হয় ছানি। যখন চোখের লেন্সের কিনারার দিকে ছানি পড়ে তখন দেখতে খুব একটা সমস্যা হয় না। কিন্তু লেন্সের মাঝামাঝি এসে পড়লেই তা দৃষ্টিশক্তিতে ব্যঘাত ঘটায়। ৬০-৭০ বছর বয়সেই এই সমস্যা বেশি দেখা দেয়। এ ছাড়াও নানা কারণে, নানা বয়সে এই রোগ হতে পারে। এমনকি ছানি নিয়ে জন্মগ্রহণ করতে পারে একটি শিশুও। কিন্তু সচরাচর এমন ঘটনা ঘটে না। তাই ছানিকে বয়সজনিত রোগ হিসেবেই ধরা হয়।
ছানির কারণ ও লক্ষণ
আমাদের চোখে যে লেন্সটি থাকে তা অনেকটা পেঁয়াজের মতো। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে বেড়ে যেতে থাকে এর স্তর। হতে থাকে লেন্সের গঠনগত পরিবর্তন। চোখের লেন্সের গঠনগত পরিবর্তনের পিছনে থাকতে পারে নানাবিধ কারণ। হতে পারে তা ডায়াবেটিস, স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধের ব্যবহার, আঘাত ইত্যাদি। অনেক ক্ষেত্রে কারণটা হতে পারে বংশানুক্রমিক। কোনো কোনো সময় ছানি আকারে ছোটই থেকে যায়। সেক্ষেত্রে এটা নিয়ে মাথা না ঘামালেও চলে। কিন্তু যখন তা দ্রুত বাড়তে থাকে এবং স্বাভাবিক কাজকর্মে বাধার সৃষ্টি করে, তখন তা নিরাময়ের কথা ভাবতেই হয়। সময় মতো চিকিৎসা করলে একশো শতাংশ আরোগ্য লাভ হয় বলেই চিকিৎসকদের দাবি।
ছানি পড়ার উপসর্গ
১. ঝাপসা বা ডাবল ভিশন।
২. কিছু কিছু রঙের তারতম্য করতে না পারা।
৩. ঘন ঘন চোখের পাওয়ার পরিবর্তন।
৪. কোনো কোনো ক্ষেত্রে রাতে আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে দিনের বেলায় দেখতে অসুবিধা হওয়া।
৫. বাড়াবাড়ি পর্যায়ে অনেক পাওয়ারের চশমাতেও দেখতে অসুবিধা হয়।
চিকিৎসা
ছানির অবস্থা নির্ধারণ করতে চোখের নানা রকম পরীক্ষা করতে হয়। যেমন : ভিজ্যুয়াল অ্যাকুইটি, কন্ট্রাক্ট সেন্সিটিভিটি, নাইট ভিশন, কালার ভিশন, সাইড অ্যান্ড সেন্ট্রাল ভিশন টেস্ট ইত্যাদি। কিন্তু ওষুধ দিয়ে ছানির চিকিৎসা সম্ভব নয়। অপারেশনই একমাত্র পথ। তবে ভয়ের কিছুই নেই। একবারে একটা চোখই অপারেশন করা হয়ে থাকে, তাও লোকাল অ্যানাস্থেশিয়ার মাধ্যমে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ক্ষতিগ্রস্ত লেন্স বের করে কৃত্রিম লেন্স বসিয়ে দেওয়া হয়। হাসপাতালে থাকারও ঝামেলা নেই। স্বাভাবিক কাজকর্মেও ফেরা যায় সপ্তাহখানেকের মধ্যেই। তবে রেটিনার সমস্যা থাকলে ছানি অপারেশনের পরও দেখতে অল্প সমস্যা হতে পারে। তাই অপারেশনের পর দেখতে অসুবিধা হলে তা অপারেশনের ত্রুটি নয়, বুঝতে হবে রেটিনার গণ্ডগোল। সেক্ষেত্রে আলাদাভাবে রেটিনার চিকিৎসা করানোর প্রয়োজন হয়। তাই ছানি অপারেশনের আগে থেকেই রোগীর রেটিনার যত্নআত্তি খুব জরুরি।
অপারেশন পরবর্তী যত্ন
ছানি অপারেশন যদিও ঝুঁকিপূর্ণ নয় তারপরও ঠিকমতো সাবধানতা অবলম্বন না করলে আরোগ্য লাভ করা কঠিন। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী নিয়ম মেনে নিতে হবে চোখের যত্ন। নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ব্যবহার করতে হবে চোখের ড্রপ। কয়েক মাস চশমা ব্যবহার করতে হবে, বিশেষ করে পড়ার সময়। চোখ ঘষাঘষি করা যাবে না। বেশি ওজন বহন করা নিষেধ। সাঁতার কাটা বা অতিরিক্ত পরিশ্রম করা থেকে বিরত থাকতে হবে। চোখে ধুলা-ময়লা যেতে দেওয়া যাবে না। সাবান বা শ্যাম্পু যেন চোখে না ঢুকে যায় সেদিকে সতর্ক নজর রাখতে হবে।