ইদানিং দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের নাম আবারো নারীদের নামে রাখার চল ফিরে এসেছে। অর্থাৎ নারীকেন্দ্রিক গল্পকে কেন্দ্র করে বানানো চলচ্চিত্রের নামও রাখা হচ্ছে নামবাচক বিশেষ্যে। এটা কেন? বাংলাদেশে অনেক চলচ্চিত্র মুক্তি পেয়েছে যেগুলোর গল্প নারী কেন্দ্রিক কিন্তু ছবিটির নাম ওই কেন্দ্রীয় চরিত্রের নামে নয়, যেমন সারেং বউ (১৯৭৮), সূর্য দীঘল বাড়ী (১৯৭৯), ভাত দে (১৯৮৪), হাঙর নদী গ্রেনেড (১৯৯৭) প্রভৃতি চলচ্চিত্রের নাম বলা যাবে। কিন্তু সারা দুনিয়াতেই একটি চল দেখা যায়, চলচ্চিত্রের শিরোনামটি নেওয়া হয় মূল নারী চরিত্র থেকেই।
বাংলাদেশে এই চলটি বেশ ভালোভাবে পরিলক্ষিত হয়, দেশ স্বাধীনের আগে থেকেই। এবং এই চর্চায় আরও একটি আগ্রহব্যাঞ্জক বিষয় হলো, এসব নারীনাম বহনকারী ছবির অধিকাংশ কাহিনিই নেওয়া হয়েছে আমাদের ময়মনসিংহ গীতিকার মতো গ্রামবাংলার লোককথা থেকে। ছবির নাম দেখলেই বোঝা যায় চলচ্চিত্রের গল্পে রয়েছে লোককথার শেকড়। আমি একটি তালিকা তৈরি করেছি এধরনের চলচ্চিত্রের, যদিও সেটি পূর্ণাঙ্গ নয়, তারপরও সেই তালিকায় চোখ বুলালে দেখা যাবে, আমাদের নির্মাতাদের বেশ পছন্দের একটি জায়গা হলো লোককাহিনি ভিত্তিক নারীদের গল্প। তালিকাটি এই লেখার শেষে যোগ করা হয়েছে।
লোককাহিনি হোক আর বাস্তব কাহিনি হোক, নারীকেন্দ্রিক চলচ্চিত্রের নাম মূল নারী চরিত্রের নামেই রাখা হয় কেন? আমার কাছে মনে হয় এর অনেকগুলো কারণ রয়েছে। প্রথম কারণ হলো, সারা দুনিয়াতেই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীরা অবদমিত ও নানা বেড়াজালে বন্দী। তাই তাদের নামে চলচ্চিত্রের শিরোনাম করে নারীজাতিকে গুরুত্ব দেওয়া হয় এবং পুরুষতন্ত্রকে চ্যালেঞ্জ জানানো হয়। দ্বিতীয়ত কারণ হলো, নারীর নাম ভালোবাসা, সৌন্দর্য, রহস্যময়তা ও ট্র্যাজেডির প্রতীকও বটে। বেশি নাম বলবো না, শুধু মনে করুন ‘হেলেন অব ট্রয়ে’র কথা। তাহলেই এই বিশেষণগুলোর মর্যাদা অনুভব করা যাবে। তো নারী নামের ভেতর দিয়ে এসব প্রতীকি ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করা সম্ভব বলেই হয় তো পরিচালকেরা চলচ্চিত্রের নাম হিসেবে বেছে নেন নারী নামকে।
সকলেই বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের ‘সুলতানার স্বপ্নে’র কথা জানেন। সুলতানার নিজস্ব বাসনার কথা বলা হলেও, তার সাথে যুক্ত করা হয়েছে তৎকালের সমাজ বাস্তবতা। আমার ধারণা, তৃতীয় কারণটি হলো, সামাজিক বাস্তবতার নিরিখে একক নারীর লড়াইকে একটি সর্বজনীন রূপ দেওয়ার প্রয়াস থেকেও নারীর নাম নির্ধারণ করা হয় শিরানামে। চতুর্থ কারণটি হতে পারে একেবারেই ব্যবসায়িক ও দর্শক আকৃষ্ট করার নিমিত্তে।
এই চারটি কারণের বাইরেও আরেকভাবে চলচ্চিত্রের নাম নারীর নামে হয়ে উঠতে পারে, যদি একই নামের কোনো সাহিত্য থেকে চলচ্চিত্রটি নির্মিত হয়। যেমন সম্প্রতি বেগম রোকেয়ার ‘সুলতানা’স ড্রিম’ নিয়ে একটি স্পেনিশ এনিমেটেড ফিল্ম বানিয়েছেন ইজাবেল হেরগেরা। তিনি তার ছবির নামটাও একই রেখেছেন। সাহিত্যিকের প্রতি আস্থা রেখে নাম অপরিবর্তিত রাখার ফলেও কিন্তু অনেক সময় চলচ্চিত্রের নামে নারীনাম চলে আসে।
গত চার বছরে বাংলাদেশে একাধিক নারীকেন্দ্রিক চলচ্চিত্র নারী চরিত্রের নামে হয়েছে। এবং সেগুলো দেশের মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করেছে, এমনকি বিদেশের বিভিন্ন চলচ্চিত্র উৎসবেও মনোনীত হয়েছে প্রদর্শনের জন্য। এগুলোর ভেতর আলাদা করে ‘রেহানা মরিয়ম নূরে’র কথা বলতেই হয়। এই ছবিটি ৭৪তম কান চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হয়। এই ছবির সাফল্যের পর থেকেই অনেকে আগ্রহী হন ছবির নামে নারীনাম রাখার ক্ষেত্রে। তবে এটা ভাবা ভুল হবে যে এই প্রবণতা সাম্প্রতিক। ষাটের দশকে দেখা যায় জহির রায়হান নিজেই দুটি ছবি করেছেন, যেগুলোর নাম তিনি রেখেছেন নারীদের নামে: ‘বেহুলা’ ও ‘আনোয়ারা’। সেসময় পৌরাণিক ও লোককাহিনি ভিত্তিক গল্প নিয়ে ছবি তৈরির একটি ঝোঁক দেখা যায়। বাংলাদেশ স্বাধীনের পর এই প্রবণতা অবশ্য ধীরে ধীরে কমতে শুরু করে। তালিকায় ছবির নামের পাশে বন্ধনীতে থাকা মুক্তির সাল দ্রষ্টব্য। কিন্তু ২০২৪ সালে এসে এই প্রবণতা বেড়ে গেছে। পুরাণ বা লোককাহিনি নয়, একবিংশ শতকের চলচ্চিত্রে জায়গা করে নিতে থাকে আধুনিক সময়ে জটিল সমীকরণে থাকা নারীদের গল্প। তারা ধীরে ধীরে স্বাধীন হতে শুরু করেছে। তাই তাদের নিয়ে আরও বেশি চলচ্চিত্র নির্মিত হবে সেটাই স্বাভাবিক। সৌদি আরবেও দেখা গেছে ২০১৮ সালের পর, যখন নারী স্বাধীনতা বেড়েছে, তাদের ইন্ডাস্ট্রিতেও নারীকেন্দ্রিক নারী নামের চলচ্চিত্রের সংখ্যাও বেড়েছে।
আমার এই লেখা নারীনামের চলচ্চিত্রে কোনো কিছু আবিষ্কারের জন্য নয়, বরং নারী নামে কেন আগ্রহ পরিচালকদের, সে সম্পর্কে একটু বোঝাপড়া করতে চাওয়া, আর পাশাপাশি আমাদের দেশে কি কি নারীনামের ছবি হয়েছে তার একটি মোটামুটি খতিয়ান হাজির করা। নিচে তাই একটি নারীনাম বহন করা চলচ্চিত্র ও তাদের পরিচালকের একটি তালিকা যুক্ত করে দিলাম।
গুনাই বিবি (১৯৬৬) সৈয়দ আউয়াল
গুনাই (১৯৬৬) বজলুর রহমান
রূপবান (১৯৬৬) সালাহউদ্দিন
বেহুলা (১৯৬৬) জহির রায়হান
জরিনা সুন্দরী (১৯৬৬) ইবনে মিজান
আনোয়ারা (১৯৬৭) জহির রায়হান
জুলেখা (১৯৬৭) আমজাদ হোসেন
সখিনা (১৯৬৮) কারিগর
চম্পাকলি (১৯৬৮) সফদার আলী ভূঁইয়া
মালকাবানু (১৯৭৪) ফয়েজ চৌধুরী
গোলাপী এখন ট্রেনে (১৯৭৮) আমজাদ হোসেন
মেহের বানু (১৯৭৮) স্বপন সাহা
রাজকুমারী চন্দ্রবান (১৯৭৯) শহীদুল আমিন
আনারকলি (১৯৮০) দিলীপ বিশ্বাস
আলতা বানু (১৯৮২) ফয়েজ চৌধুরী
হাসু আমার হাসু (১৯৮৩) এইচ আকবর
গুনাই বিবি (১৯৮৫) হারুনুর রশীদ
নাদিরা (১৯৮৫) ফখরুল হাসান বৈরাগী
চন্দ্রাবতী (১৯৮৬) মতিউর রহমান বাদল
মহুয়া সুন্দরী (১৯৮৭) শামসুদ্দীন টগর
সালমা (১৯৮৮) শেখ নজরুল ইসলাম
বেদের মেয়ে জোসনা (১৯৮৯) তোজাম্মেল হক বকুল
মাইয়ার নাম ময়না (১৯৯০) মহাম্মদ হান্নান
চাঁদনী (১৯৯১) এহতেশাম
দিলরুবা (১৯৯১) তোজাম্মেল হক বকুল
রানী আমার নাম (১৯৯২) আবু মুসা দেবু
সোনিয়া (১৯৯২) মুস্তাফিজ
সাগরিকা (১৯৯৮) বাদল খন্দকার
ম্যাডাম ফুলি (১৯৯৯) শহীদুল ইসলাম খোকন
আসিরন কেন ঢাকায় (২০০০) মোহাম্মদ ইউসুফ আলী
খাইরুন সুন্দরী (২০০৪) এ কে সোহেল
বস্তির রানী সুরিয়া (২০০৪) মনতাজুর রহমান আকবর
মালেকা সুন্দরী (২০০৬) নূর মোহাম্মদ মনি
জমেলা সুন্দরী (২০০৭) এ কে সোহেল
দুঃখিনী জোহরা (২০০৭) আজিজুর রহমান
সুতপার ঠিকানা (২০১৫) প্রসূন রহমান
রীনা ব্রাউন (২০১৭) শামীম আকতার
চন্দ্রাবতী কথা (২০২০) এন রাশেদ চৌধুরী
রেহানা মরিয়ম নূর (২০২১) আবদুল্লাহ মোহাম্মদ সাদ
হৃদিতা (২০২১) এম এন ইস্পাহানি
শিমু (২০২২) রুবাইয়াত হোসেন
বীরকন্যা প্রীতিলতা (২০২৩) প্রদীপ ঘোষ
ফাতিমা (২০২৪) ধ্রুব হাসান
কাজলরেখা (২০২৪) গিয়াসউদ্দিন সেলিম
সাবা (২০২৪) মাকসুদ হোসেন
প্রিয় মালতী (২০২৪) শঙ্খ দাশগুপ্ত
(অসমাপ্ত তালিকা)